×

সাময়িকী

বাবলি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২০, ০৮:০৯ পিএম

বাবলি
বাবলি

বাবলি বলল, আপনি আসার আগেই আমাদের এলাকা, আমাদের স্কুল সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য আপনাকে একটি চিঠি লিখি। চিঠিটা বড় হয়ে যাওয়ায় কেমন করে কোন ঠিকানায় পোস্ট করব বুঝতে পারিনি। তাছাড়া যে উদ্দেশ্যে আমি চিঠিটি লিখেছিলাম সে উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়ে আসছে। তবুও যেহেতু কষ্ট করে লিখেছি, পড়ে দেখবেন।

স্কুল থেকে এক কিলোমিটার হাঁটাপথে আমার নতুন আবাসন, চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি। হেডস্যারের নির্দেশে আমার স্যুটকেস বহন করছে স্কুলের দপ্তরি মোনায়েম। তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া আছে। কিন্তু মাঝপথেই সে বাড়ির এক ভৃত্য এবং ক্লাস সিক্স-এ পড়া বালক শুভ্র দপ্তরিকে বিদায় করে দিল। শুভ্র বলল, সে খুব ভালো ছেলে, তার বাবা ঢাকা গেছেন, আরো দুদিন পর আসবেন। চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেট থাকবে, চাল-গম-টিন আত্মসাতের টাকায় তার বাড়ি পাকা হবে, তিন তলা চার তলা হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আমি ধরেই নিয়েছি আমার রুমটাতে একটা অ্যাটাচড বাথও থাকবে। এক তলাতে এক প্রান্তে যে রুমটিতে আমাকে নিয়ে তারা ঢুকল দেখি সুশ্রী সেই মেয়েটি হাতে হাতুড়ি তারকাঁটা ও মশারি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে; আমাকে দেখে বলল, স্যার আমি বাবলি। ওল্ড ক্লাস টেন। আমি বললাম মশারি লাগবে না, আমি ঠিক মশারিতে অভ্যস্ত নই। মেয়েটি ঠিক তখনই বলল, ও? তাহলে মশায় অভ্যস্ত! স্যার ক’বার আপনার ম্যালেরিয়া হয়েছে? স্যার চিকনগুনিয়ায় কখনো ভুগেছেন? একবার চিকনগুনিয়া হলে হেঁটে আর স্কুলে যেতে পারবেন না, হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। স্যার দখিনদুয়ারির মশা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই, মশাগুলো এখানকার মানুষের মতো একই রকম খারাপ। শিক্ষক হিসেবে একটি দূরত্ব বজায় রাখতেই তার কথার জবাব দিলাম না। তাদের ভৃত্যটিকে দিয়ে দুই দেয়ালে তারকাঁটা পুঁতে মশারির দড়ি টানানোর ব্যবস্থা করল। বাবলি বলল, আপনার কি কি লাগবে তার একটি তালিকা করুন। কাল বিকেলের মধ্যে সব এসে যাবে। টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। বাবা বলেছেন, খরচ কর, আমি তো টাকা আর কবরে নিয়ে যাব না। তারপর নিজে থেকেই বলল, আজ পড়ানোর দরকার নেই। কাল থেকে পড়াবেন। আপনার রাতের খাবার, সকালের নাস্তা পাঠিয়ে দেওয়া হবে, স্কুল ছুটি থাকলে দুপুরের খাবারে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন স্কুল খোলা থাকবে তখন তাড়াতাড়ি বাসায় এসে খেয়ে যাবেন না পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলবেন। আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কি করো? বাবলি বলল, তার একটা পাতলা টিফিন বাটি আছে, স্কুলে যাবার সময়ই তাতে এ খাবার সে খাবার ভরে নিয়ে যায়। আমিও তাহলে তা-ই করব। একটা টিফিন বাটি কিনে নেব। আপনার কিনতে হবে না, আমারটা আপনাকে দিয়ে দেব, আমি আরেকটা বের করে নেব। এভাবেই বাবলির এটা বাবলির ওটা নিতে নিতে স্কুলের অংক স্যার এবং বাবলিদের বাড়ির লজিং মাস্টার হিসেবে আমার অবস্থান দৃঢ় হয়, স্থিতিকাল বেড়ে যায়। অংক স্যার হিসেবে আমিও সাফল্যের মুখ দেখি। এসএসসিতে পাঠানো সাতাশ জনের একজন পরীক্ষা শেষ করেনি, পরীক্ষার মাঝখানে কোনো এক বখাটের সাথে পালিয়ে যায়। খাতুনে জান্নাত শেষ পর্যন্ত অংকসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে ফেল করে, মেহের নিগার ও নয়নতারা বেগম টেনেটুনে পাস করে। বাবলি গড়পরতা শতে পঞ্চান্ন পেলেও অংকে ছেষট্টি নম্বর পায়। এই নম্বর তার পরিবারে অংকের ভালো টিচার হিসেবে আমার সম্মান আরো বাড়িয়ে দেয়। বাবলির মা একদিন উঁকি দিয়ে দরজার ভেতর কেবল মাথাটুকু ঢুকিয়ে বললেন, শোনেন মাস্টার সাহেব আমাদের লাইজু এসএসসি পাস না করা পর্যন্ত আপনার কিন্তু এই বাসাতেই থাকতে হবে। তারপরই তিনি হুট করে ঢুকে আমার হাতে পাঁচশত টাকার কয়েকটি নোট গলিয়ে দিয়ে বললেন, আরো লাগলে বলবেন, লাইজুকে আপনিই পড়াবেন। আপনার কসম লাগে। দখিনদুয়ারিতে সাধারণ মানুষের সাথে মিশলে সবাইকেই মনে হবে আপনার শুভানুধ্যায়ী। তাদেরই একজন, স্কুল আর চেয়ারম্যান বাড়ির মাঝামাঝি একটি চায়ের টং ঘরের চাওয়ালা কাপে লিকার ঢালতে ঢালতে আমাকে বলল সাবধানে থাকবেন স্যার। বাড়িটা বড় অভিশপ্ত। আমি যখন তার দিকে চোখ তুলে তাকাই তিনি বুঝে নেন আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি। বলল, আপনার মতোই লজিং মাস্টার ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বিএ ক্লাসে পড়ত, চেয়ারম্যানের ভাই বোনদের পড়াত। চেয়ারম্যানের ছোট বোনের সাথে তার ভালোবাসা হয়। চেয়ারম্যান নিজেই দাড়িওয়ালা দু’জনকে কাজি সাজিয়ে বাসায় ডেকে এনে বিয়ের নাটক করে। ভাইয়ের উদারতায় মুগ্ধ হয়ে বোন যখন তাকে জড়িয়ে ধরে ভাই জিজ্ঞেস করে তোর বিয়ের আশ তো মিটেছে এইবার মাস্টারের বিয়ের আশ মিটাই, বলেই পকেট থেকে পিস্তল বের করে বুক বরাবর দুটো গুলি করে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বোনকে পাশের ঘরে নিয়ে যায় আর সেই ঘরেরই মেঝে খুঁড়ে মাটির অনেক গভীরে লাশটা ঢুকিয়ে আবার মেঝে প্লাস্টার করে দেয়। আমি জিজ্ঞেস করি, বোনটির কি হয়? আঞ্জুমানের কি হয়, সে-ই তো আমাদের এমপি গোলাম হাক্কানের প্রথম স্ত্রী, গোলাম রাব্বানের মা। আমি ততদিনে ছোট হরফে লেখা একটি খাতা পেয়ে যাই। বাবলি বলল, আপনি আসার আগেই আমাদের এলাকা, আমাদের স্কুল সম্পর্কে ধারণা দেবার জন্য আপনাকে একটি চিঠি লিখি। চিঠিটা বড় হয়ে যাওয়ায় কেমন করে কোন ঠিকানায় পোস্ট করব বুঝতে পারিনি। তাছাড়া যে উদ্দেশ্যে আমি চিঠিটি লিখেছিলাম সে উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়ে আসছে। তবুও যেহেতু কষ্ট করে লিখেছি, পড়ে দেখবেন। আমি খাতাটা তার হাত থেকে নিয়ে বললাম, আচ্ছা। বাবলি বলল, এটাকে আবার প্রেমপত্র ভেবে বসবেন না যেন। আমি আবারও বললাম, আচ্ছা। বাবলির বোন পুষ্পকে দেখেছি, এক দু’বার চোখাচোখিও হয়েছে। কতোজনের সাথেই চোখাচোখি হয় তাতে কি এসে যায়। স্কুলের ইংলিশের জুনিয়র টিচার সুমনা রহমানের সাথে তো আরো অনেক বেশিবার চোখাচোখি হয়েছে। হোক, হতে থাকুক, এক সময় চোখ চোখের ভাষা বুঝবে, কিংবা কখনও বুঝবে না। আমার চেয়ে অনেক ভালো এক পাত্র ভুরুঙ্গামারি থানার এএসআই কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পুষ্পের বিয়ে হয়। পাত্রপক্ষ পুষ্পকে দেখে এতোটাই মুগ্ধ যে বিয়ে করে তখনই তুলে নিয়ে যায়। দখিনদুয়ারি থেকে ভুরুঙ্গামারি পৌনে দু’শ কিলোমিটার দূরে। পুষ্প চলে যাবার পরপরই বাবলি এসে নোটিস দিয়ে গেল, আজ রাতে ছুটি। আমাদের মন খারাপ, আমরা পড়ব না। আমি বললাম, আচ্ছা। আমারও একটু জ¦র জ¦র লাগছে। অসুবিধে নেই, প্যারাসিটামল খেয়ে নেব। বাবলি বলল, প্যারাসিটামল এখনই খাবেন না, খালি পেটে খেলে ক্ষতি হয়। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। খাবার পাঠিয়েই দেওয়া হয়। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যে বাবলি খাবার নিয়েই এলো, দুটো খালি প্লেট সাথে। বলল, স্যার আমি আপনার সাথে খাবো। আপত্তি নেই তো? আছে, চেয়ারম্যান সাহেব কিছু মনে করতে পারেন। বাবা দু’ঘণ্টা আগেই ঢাকা রওনা হয়ে গেছে, কাল পরশু দু’দিন ঢাকার ওসমানি মিলনায়তনে চেয়ারম্যানদের কনফারেন্স। ও আচ্ছা, তা হলে বসো। বেশ আয়োজন, বিয়ের খাবারেরই একটা অংশ নিয়ে এসেছে। অসুখ-বিসুখের সম্ভাবনা দেখা দিলে আমি এমনিতেই একটু বেশি খাই। ইমমিউনিটি ফল করতে দেয়া যাবে না। বাবলি বলল, স্যার এটা কিন্তু পুষ্পের বিয়ের খাবার। আমি বললাম, আজকের খাবার তো সেটাই হবার কথা। খাবারটা আপনার কাছে তিতকুটে বিষের মতো হচ্ছে না। না তো তা হবে কেন? যথেষ্ট টেস্টফুল খাবার। তা হলে ঠিক আছে স্যার। যদি খাবার টেস্টফুল মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে পুষ্পের জন্য আপনার কোনো ফিলিংস গ্রো করেনি। আমি আপনার গা ছুঁয়ে বলছি, আমি এটাই চাচ্ছিলাম। বাবলি আবার জিজ্ঞেস করল, স্যার আপনার কি মন খারাপ? মন খারাপ হবে কেন, শরীরটা একটু খারাপ, জ¦র জ¦র লাগছে। বাবলি আবার বলল, আমি এটাই চাচ্ছিলাম। মন খারাপ হলে এর ভেতর পুষ্প থাকতে পারে, কিন্তু শরীর খারাপ হলে এর ভেতর থাকবে মশা, ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া এসব যেহেতু আপনার মন খারাপ নয়, সান্ত¡না দেবার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু যে কথাটা সরাসরি বলতে পারি তা হচ্ছে পুষ্প গেছে যাক, আপনার জন্য আমি আছি। এখন মনে করতে পারেন আপনাকে দেখার আগে আপনাকে লেখা আমার দীর্ঘ পত্রটি আসলে একটি প্রেমপত্র। সরাসরি ভালোবাসি কথাটি লিখতে পারিনি বলে এতোসব বাহানা করেছি। বাবলি বলল, আপনার প্যারাসিটামল কোথায়? চিন্তা করো না, আমি খুঁজে বের করতে পারব। কোথাও নিশ্চয়ই রেখেছি। দুটোই ছিল। বাবলি বলল, চলুন আপনার রুমে, দেখি প্যারাসিটামল কোথায়? আমি ড্রয়ার টানলাম, এক, দুই, তিনটা ড্রয়ার। পেলাম দুটো প্যারাসিটামলের খোসা। বললাম, হয়তো আগেই খেয়ে ফেলেছি। অসুবিধে নেই। জ্বর থাকলে কাল কিনে নেব। বেরোবার সময় বাবলি বলল, দরজা বন্ধ করবেন না, আমি দশ পনেরো মিনিটের মধ্যে আবার আসব। আমি বললাম, না না না, রাত হয়ে গেছে আর আসতে হবে না। বাবলি ধমক দিল, চুপ, একটা কথাও বলবেন না। আধঘণ্টা পর থার্মোমিটার ও প্যারাসিটামল নিয়ে বাবলি ফিরল এবং বলল, হা করুন, আমি মুখে থার্মোমিটার ঢুকাচ্ছি। আমার জ¦র যে বাড়ছে বেশ বুঝতে পারছি। বাবলি থার্মোমিটার টেনে বলল, অবস্থা খারাপ ১০২; শরীর তো পুড়ে যাচ্ছে, আমি প্যারাসিটামল খাই, খুব শীত লাগছে, চাদর বা কাঁথায় পোষাচ্ছে না। আমি শুধু এটুকুই বলি, খুব শীত। বাবলি বলে, দরজা বন্ধ করবেন না কিন্তু। আসলে তখন আমার উঠার শক্তিই কমে গেছে। ন্যাপথালিনের গন্ধমাখা একটি লেপ আমার শরীরের উপর। বাকি রাতের কাহিনী আমার আর জানা নেই। সকালের দিকে জ¦র নেমে যায়, লেপ ঠেলে দিই, পায়ে কোমল কিছুর স্পর্শ লাগে, ওঠে বসি দেখি আমার পায়ের দিকটাতে বাবলি ঘুমাচ্ছে। আমি আতঙ্কিত হই, সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার এ নিবাস আমার চাকরি সব যাবে, তাছাড়া চেয়ারম্যান সাহেব ভয়ঙ্কর মানুষ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App