নিভৃতের চিত্রশিল্পী শফিকুল ইসলাম
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২০, ০৭:৫১ পিএম
চিত্রশিল্পী শফিকুল ইসলাম
শিল্পের গর্ভে এক জাদু আছে। আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনের হারিয়ে যাওয়া স্রোতকে এটি ধারণ করে জন্ম দেয় স্থিতি আর অবিনশ্বরতা। জীবন ফুরিয়ে যায়, হারিয়ে যায় চেনা দৃশ্য কিংবা সময় অথচ শিল্প এইসব কিছুকেই চিরদিনের করে রাখতে ব্যস্ত থাকে। কালোত্তীর্ণ শিল্পের চিত্রকর যারা তারা এই ধ্রুব সত্যেকে হৃদয়ে ধারণ করেই কাজ করে গেছেন চিরকাল। শিল্পী শফিকুল ইসলামও ব্যতিক্রম নন। তিনি আজন্ম ছিলেন এই চিত্র জাদুকরদের দলেই। তবে কালোত্তীর্ণ হওয়ার বৈভব আর স্বীকৃতির বিত্ত মাড়িয়ে মূলত শিল্পের চিরায়ত রূপদানে এই চিত্রী উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শিল্পমানস। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অনেকটা নিভৃতে, নীরবে খুঁজবার চেষ্টা করেছিলেন রং-তুলির নানা অদেখা ভাষা। প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সংগ্রামে রত এই শিল্পী গড়ে তুলেছিলেন নিজের চিত্রকলার অনন্য এক জগৎ। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ১৯৪৪ সালে জন্ম নেন এই কীর্তিমান শিল্পী। চিত্রকলা আর শিল্পের সাথে তার প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অফ আর্টস এন্ড ক্রাফটসের মাধ্যমে। সেখান থেকে স্নাতক শেষে ১৯৭৪-এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে লাভ করেন মাস্টার্স অফ ফাইন আর্টস ডিগ্রি। তারপরের ৩৩ বছর কেটে যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতা করে। তবে সহকর্মী আর পরিবারের চোখে দেখা শিক্ষক শফিকুলকে বরাবরই ছাপিয়ে গেছেন শিল্পী শফিকুল। শিক্ষকতার সীমা আর প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডির মাঝে অসীম হওয়ার বাসনায় তাঁকে লালন করত সবসময়। ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট অন্তিমের পথে পাড়ি জমিয়েছেন চিত্রকলা জগতের এই প্রাজ্ঞ। বড্ড অকালে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে শিল্প জগতের এই নিভৃতচারী হয়েছেন দূরের নক্ষত্র। শফিকুলের শিল্পের সাথে পরিচিতরা তাঁর প্রয়াণ মেনে নিলেও সৃষ্টিগুলো হারিয়ে যাওয়ার পক্ষে নন কোনোভাবেই। শফিকুলের চিত্রকর্মের প্রতি ভালোবাসার সুর শোনা গেল বাংলাদেশের খ্যাতনামা কার্টুনিস্ট, চিত্রকর রফিকুন নবীর কণ্ঠে। জানালেন শফিকুলকে যতটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে তা থেকে বোঝা গেছে তিনি বেশ নিভৃতচারী অথচ গুণী একজন চিত্রী। ‘আগে চট্টগ্রাম গেলে শফিকুলের সাথে আমার দেখা হতো। তাঁর নিজস্ব ধাঁচের ছোট ছোট অনেক ড্রইং দেখার সুযোগ আমার হয়েছে, এগুলো চিত্রকলার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাইরে অনন্য কিছু শিল্পকর্ম বলেই মনে হয়েছে’- বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়েই বললেন রনবী। তাঁর মতে, চিত্রকলার ক্ষেত্রে অনুকরণের প্রবৃত্তি দেখা গেলেও শফিকুল সেই দলের ছিলেন না। জানালেন প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক সব ধারার চিত্রকর্মকে সম্পূর্ণ নিজস্ব শিল্পী মানসে শফিকুল প্রাণ দিতেন। নিজের কাজের প্রতি খুব মনোযোগী এবং নিজের সৃষ্টির প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকায় শেষমেশ শফিকুলের আঁচড়ে ফুটে উঠত অনবদ্য সব চিত্রকর্ম। গুণী এই শিল্পীর স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে রফিকুন নবী আরও বললেন, ‘আমি লক্ষ করেছিলাম শফিকুলের মধ্যে বেশ শিল্পীসুলভ একটা ব্যাপার ছিল। সচরাচর নিজের শিল্পকর্ম নিয়ে খুব একটা মাতামাতির অভ্যাস তাঁর ছিল না। আমি প্রায়ই তাঁকে তাগিদ দিতাম যাতে ছোট ছোট ড্রইংগুলোকে নিয়ে বড় পরিসরে প্রদর্শনীর আয়োজন করে।’ বাংলাদেশের চিত্রকলা জগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রয়াণকে মেনে নিতে পারেননি এই বরেণ্য চিত্রশিল্পীও। শফিকুলের মৃত্যুকে বড্ড অকালের বিদায় বলে আফসোস মাখানো কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘যখন শিল্প জগতের সাথে নিজের দীর্ঘ ভ্রমণকে আরো বড় পরিসরে জানান দেয়ার সময় এসেছিল, যখন নিজের চিত্রকর্মগুলো নিয়ে আরো বড় কিছু ভাবার সময় এসেছিল ঠিক তখনই শফিকুল চলে গেল। এইটা একটা শিল্পীর অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার মতো ঘটনা।’ তাই মৃত্যুর পরও চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় শফিকুলের চিত্রকর্মগুলো নিয়ে বড় পরিসরে প্রদর্শনীর প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি অনুভব করেন রফিকুন নবী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষকের সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরাও বিশ্বাস করেন মূল্যায়িত হলে শফিকের চিত্রকর্ম বাংলাদেশের শিল্প জগতকে আরো সমৃদ্ধ করবে। শিল্পীর বড় ছেলে ফায়জুস মাসুম জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একক চিত্র প্রদশর্নী করেছিলেন শফিকুল ইসলাম। ১৯৭২ সালে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী। চট্টগ্রামে তখনকার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। ‘বাবা দেশে ও বিদেশের চারটি একক প্রদর্শনীসহ মোট উনিশটি চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর জীবনে তিনি হাজারেরও বেশি চিত্রকর্মের জন্ম দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে আরো অসংখ্য প্রদর্শনী করা যেতে পারে। তাই তাঁর সব অনবদ্য সৃষ্টি, শিল্প সমঝদারদের কাছে পৌঁছে দিতে আমরা বড় পরিসরে প্রদর্শনী করার কথা ভাবছি।’ শফিকুলের চিত্রকর্মের ভাণ্ডার সম্পর্কে জেনে যে কেউই হারিয়ে যাবেন বিচিত্রতায়। শিল্পীর অন্যতম উদ্দেশ্য বাহিরের জগতকে মনের অন্দরে ধারণ করে তা আবার নিজের হৃদয় দিয়ে প্রকাশ করা, এ কথায় যেন জানান দিবে শফিকুলের সব সৃষ্টি। শিল্পীর মনের স্পর্শ ছাড়া যে শিল্প তা কেবলই যান্ত্রিক অনুকরণ, কথাটি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন শিল্পী নিজেও। শফিকুলের চিত্রের পটভ‚মিতে কেবল ট্র্যাডিশনাল বিষয়বস্তুই আধিপত্য করেনি, সেখানে ফুটে উঠেছে পাশ্চাত্য ঢংয়ের নানা সৃষ্টিও। প্রাচ্যের মানুষের জীবন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, নিত্যদিনের হাসি-কান্না, কষ্ট ও কল্পনা, প্রকৃতির রং বৈচিত্র্যের পাশাপাশি পাওয়া যাবে পশ্চিমের নাগরিক সভ্যতার নানা রূপ। আছে জীবন আর মানুষের জটিলতার মূর্ত-বিমূর্ত ছাপ, ধূসরতা এবং বিচ্ছিন্নতার নানামুখী প্রকাশ। যতই তাঁর চিত্রকর্ম চোখে পড়বে ততই শিল্পী সম্পর্কে নতুন কিছু আবিষ্কার করবেন দর্শকরা। তাঁর আঁকায় বড় জায়গা দখল করেছে অয়েল পেইন্টিং, স্কেচ আর প্যাস্টেল। প্যারাডাউজ অব ফ্রিডম, ১৯৭১, স্ট্রাগলিং, পাখি ও নারী, মাদারহুডের মতো শিল্পীর সব চিত্রকর্মগুলো দেখে মনে চমৎকার এক অনুভ‚তি দোলা দেয়ার পাশাপাশি আসবে অদ্ভুত, গম্ভীর এক ধরনের বোধ। এক্সপ্রেশান আর অরিয়েন্টাল আর্টে শিল্পীর দখলও যে কোনো শিল্পবোদ্ধাকে নাড়া দিবে। তাঁর এই ধারার নির্মাণে সূ² বিবেচনাপ্রসূত আঁচড়ের দখলের সাথে সাথে দেখা মিলবে রঙের পিঠে রং লাগিয়ে অনুভ‚তি ফুটিয়ে তোলার খেলাও। রং আর সাদামাটার ভেতর যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস, জীবনের গূঢ় প্রকাশ, প্রতিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার উপস্থাপন সেটিকেই তিনি সর্বজনীন করার প্রয়াস চালিয়েছেন নিজস্ব আলোয়। শিল্পী শফিকের জীবনবৃত্তান্তে গিয়ে চোখে পড়ল তাঁর হাত কেবল রং-তুলিতেই আলো ছড়ায়নি। ১৯৮৯ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘প্রাচ্যরীতির শিল্প’ নামের একটি মৌলিক গ্রন্থ। বাংলাদেশের শিল্পকলার পাঠ ও পঠনে এই বিষয়ক গ্রন্থ খুবই দুর্লভ। তাই শিল্পকলার শিক্ষার্থীদের জন্য আজো এই গ্রন্থটি বেশ প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। শিক্ষকতা জীবনের পুরোটা শিল্পকলার উন্নয়নে নিভৃতেই অনেক অবদান রেখেছেন এই সমাদরহীন চিত্রকর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারের নকশা করার পাশপাশি চারুকলা বিভাগের অনেক পরিবর্তনই হয়েছে তাঁর হাত ধরে। স্বীকৃতি আর প্রচারের লণ্ঠন না ছুঁয়ে আজীবন শিল্পকে রাঙাতে গিয়ে নিভৃতে বিদায় নেয়া শিল্পকলার এই নক্ষত্রের কথা যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় দারুণভাবে প্রকাশিত হয়। “প্রভাতে যে পাখি সবে গেয়েছিল কলরবে থামুক এখন। প্রভাতে যে ফুলগুলি জেগেছিল মুখ তুলি মুদুক নয়ন। প্রভাতে যে বায়ুদল ফিরেছিল সচঞ্চল যাক থেমে যাক। নীরবে উদয় হোক অসীম নক্ষত্রলোক পরম নির্বাক”।