×

সাময়িকী

মুর্তজা বশীরের অস্তহীন স্মৃতিপূর্ণিমা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২০, ০৯:০৭ পিএম

মুর্তজা বশীরের অস্তহীন স্মৃতিপূর্ণিমা

চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীরের সদ্য প্রকাশিত মুক্তস্মৃতি ও গদ্য সংকলন আমার জীবন ও অন্যান্য। ‘দেয়াল’, ‘শহীদ-শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রমণী’ ইত্যাদি বহুখ্যাত সিরিজ চিত্রমালার শিল্পী মানুষটি আমাদের সাহিত্য সংসারেও এক সুজ্ঞাত নাম। তোমাকেই শুধু, ত্রসরেণু, এসো ফিরে অনুসূয়া শীর্ষক কবিতাগ্রন্থ, গল্পগ্রন্থ কাঁচের পাখির গান, উপন্যাস আলট্রামেরিন আর গবেষণাগদ্য মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবসী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ এবং নানা অগ্রন্থিত লেখাপত্রে তাঁর লেখকসত্তা অনন্য বিশিষ্টতায় ভাস্বর।

বর্তমান বিশালায়তন গ্রন্থটি শুরু হয়েছে ‘আমার ছেলেবেলা’ নাম্নী আত্মকথার প্রাথমিক- লেখা দিয়ে আর সমাপ্তি নোঙর বেঁধেছে ‘তৃষিত নদী’ শীর্ষক শ’খানেক পৃষ্ঠার সম্পূরক স্মৃতিভাষ্যের মধ্য দিয়ে। ‘প্রসঙ্গ-কথা’য় বইয়ের প্রকাশক বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের পক্ষে আবুল হাসনাতের আশাবাদ ‘আশা করি পাঠক শিল্পী মুর্তজা বশীরের বৈচিত্র্যময় ও বহুকৌণিক এই রচনাগুচ্ছ থেকে বৃহত্তর এক ভুবনের সাক্ষাৎলাভ করবেন।’ এই আশাবাদ নিয়ে বইটির পাঠ-সমাপনান্তে মোটেও হতাশ হতে হয় না। কারণ প্রায় অর্ধশত পৃথক রচনায় গাঁথা এই স্মৃতি ও গদ্যগুচ্ছ লেখকেরই কথামতো সমুদ্রগামী খণ্ড খণ্ড নদীতৃষ্ণারই যেন সংকেত রেখে যায় পাঠকমনে। ভাষা ও বোধে সৃষ্ট অমল জোয়ারের ঘ্রাণে এই বই পাঠককে জাগিয়ে তুলে, জাগিয়ে রাখে, উৎসুক করে ব্যক্তি লেখকের জীবন এবং সেই সঙ্গে ফেলে আসা সময়ের সরণিতে চক্কর দিতে যেখানে জীবন ও শিল্প অদ্বৈত অন্বয়ে বাঁধা পড়ে আছে।

এই বইভুক্ত রচনার অধিকাংশই আত্মস্মৃতি আর আছে অমর একুশেকেন্দ্রিক পাঁচটি লেখা, পণ্ডিত পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কিত তিনটি লেখা, শিল্পী জয়নুল আবেদিন-কামরুল হাসান-এস এম সুলতান-আমিনুল ইসলাম-কাইয়ুম চৌধুরী-সোমনাথ হোর-রশিদ চৌধুরী, কবিবন্ধু শামসুর রাহমান, উর্দু কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ সম্পর্কে স্মৃতি, রাজনৈতিক জীবন ও জেলখাটা, ’৪৩-এর দুর্ভিক্ষ থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ঢাকার অলিগলি-মহল্লা থেকে চট্টগ্রামের সমুদ্রটিলা নিয়ে নোনা ও মিষ্টি সব স্মৃতি। আছে চিত্রশিল্পের ব্যাকরণ নিয়ে নানা কথা, ভ্যান গগের নন্দনতত্ত¡ থেকে হাসনাত আবদুল হইয়ের ভ্রমণসাহিত্য নিয়ে আলোচনা আর অনিবার্যভাবেই আছে শিল্পকলা-সংস্কৃতির নানা নিবিড় নির্যাস।

দুই. এই আত্মকথা প্রকৃতার্থে আকাক্সক্ষার গল্প; ব্যক্তি যখন ব্যক্তিগত স্থ‚ল আকাক্সক্ষার গণ্ডি ছাপিয়ে আকাশমুখী হয়ে ওঠে তখন সাফল্য-ব্যর্থতার বাইরে এক সদাচঞ্চল জীবন সে পায় যা আমাদের জন্য হয় বিপুল কৌত‚হল জাগানিয়া। মুর্তজা বশীর তাঁর জীবনকথার সমান্তরালে যে দর্শনবিভ‚তির ইঙ্গিত দিয়ে যান তাই তাকে সমকালীন হুল্লোড় থেকে নির্জন একক রূপে চেনায়- ... জীবনটা একবারই আসে। জীবনটা হলো নদীর জোয়ারের পরে যখন ভাটা হয়, তখনকার সেই বালিয়াড়ির মতো নরম। তুমি চেষ্ট করো একটা হাতি হওয়ার, যেন সেখানে একটা গভীর ছাপ তুমি রেখে যেতে পারো। কিন্তু তুমি যদি একটা পিঁপড়া হও, তাহলে ছাপটা এত ক্ষুদ্র হবে যে, দেখাই যাবে না।

হ্যাঁ, দিনানুদৈনিকের জীবনক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বচারী এক মহাজীবনের সাধনাই যেন ছিল শিল্পী লেখকের আরাধ্য-পরম। এই দিগন্তভিসারী জীবনদৃষ্টি থেকেই তিনি অংশ নেন মাতৃভাষা মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে, মেহনতি মানুষের মুক্তির মিছিলে আর রেখা ও রঙের শৈল্পিক সংগ্রামে।

তিন. অমর একুশে তাঁর জীবনের এক মহত্তম অধ্যায়। একুশেকেন্দ্রিক বেশ কিছু স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে আবুল বরকতের শাহাদাৎ-মুহূর্তের দুর্লভ তথ্য- ... দেখলাম প্যান্টের মধ্যে শার্ট গোঁজা, লম্বা শেভ করা একজনকে। তার সারা মুখে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘামের বিন্দু। আর কল খুলে দিলে যেমন পানি পড়ে তেমনি রক্ত ঝরছে। সে বারবার জিভ বের করছে আর বলছে- পানি পানি। আমার হাতের রুমালটা ঘামে পানিতে ভেজানো ছিল। আমি ইতস্তত করছিলাম রুমালটা নিংড়ে দিব কি না। সে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল। অবশেষে আমি নিংড়ে দিলাম। সে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নাম আবুল বরকত, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পল্টন লাইন, আমার বাড়িতে খবর দিয়েন’...

ভাষা আন্দোলনের এমন রক্তাপ্লুত ইতিহাস বয়ানের সঙ্গে যখন তিনি ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনের সঙ্গে তাঁর যুক্ততার কথা উল্লেখ করে নিরাসক্ত নৈর্ব্যক্তিকতায় আত্মসমালোচনা করেন এভাবে ‘যে জন্য শহীদেরা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে, সেই চেতনার সঙ্গে কি নিজেকে জড়িয়ে রাখতে পেরেছি? সেই চেতনাকে কি এগিয়ে নিতে পেরেছি? যখন দেখি পারিনি, মনে হয় আমি কাপুরুষ এবং পলাতক’ তখন তাঁর এই আত্মোপলব্ধি হয়ে ওঠে আমাদের সমষ্টিরই প্রাণকথা।

আর একুশের উত্তরপর্বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচর্যায় চোখ দিলে দেখব ব্যক্তিগত স্মৃতি ও প্রামাণ্য তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে তিনি একাত্তরের উত্তাল মার্চে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিসেবীদের সংগ্রামী ভ‚মিকার কালপঞ্জি প্রণয়ন করেছেন যা মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় বিশেষ তাৎপর্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে। ১৯৫০-এর ৭ জুন তারিখে কমিউনিস্ট কর্মী হিসেবে জেল-যাত্রাকে যখন তিনি আক্ষরিক কারাবাসের বৃত্তভেদী ‘দ্রোহ ও সৃজনের জেলজীবন’ শিরোনাম দেন তখন পূর্বোক্ত সেই জীবনদৃষ্টির কথাই বলতে হয় যে জীবন; জীবনের সীমিত সীমায় দাঁড়িয়ে গায় মহাজীবনের গান- তাই কারাবাসের কষ্টের চেয়ে তাঁর বর্ণনায় সজীব হয়ে উঠে জেলের ভেতরে বসে রজনীগন্ধার ড্রইং আঁকা কিংবা নয়াচীনের অভ্যুদয় নিয়ে কবিতা লেখার স্মৃতি।

খ্যাতিমান পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সঙ্গে পুত্র মুর্তজা বশীরের সম্পর্কটা নির্দ্বান্দ্বিক ছিল না মোটেও। এ বিষয়ে অকপটে লেখক বেশ কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তাঁর লেখায়। এক জিজ্ঞাসার জবাবে শহীদুল্লাহ্ যখন বলেন ‘আধুনিক চিত্রের মতোই আমার ছেলে দুর্বোধ্য’ তখন উত্তরপ্রজন্মের সঙ্গে দূরত্বের প্রসঙ্গ এবং একই সঙ্গে তাদের স্বীকৃতির বিষয়টিও আড়াল থাকে না। পুত্রের কাছে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ শুনে কালো পরিধেয় বস্ত্র ছিঁড়ে নিজের বাহুতে তার টুকরো বেঁধে ভাষা শহীদদের স্মরণে ব্যক্তিগত শোক উদযাপনের সঙ্গে সঙ্গে যখন শহীদুল্লাহ্র এমন মন্তব্য আমরা পাই- ‘নিজের মাতৃভাষার জন্য যদি তোমার প্রাণ যেতো আমার কোনো দুঃখ থাকতো না’ তখন আমরা লেখকের পিতা শহীদুল্লাহ্কে ছাপিয়ে সেই মাতৃভাষাব্রতী শহীদুল্লাহ্কে প্রত্যক্ষ করে উঠি যিনি সবসময় মা আর মাতৃভাষাকে সমমর্যাদায় স্থান দিয়েছেন।

চার. আমার জীবন ও অন্যান্য ঋদ্ধ হয়েছে ১৯৫০-এ অঙ্কিত ‘বর্জন’ শীর্ষক পেনসিল-কাজ থেকে ২০০৩-এর ‘হলুদ গোলাপ হাতে রমণী’র মতো তেলরঙের কাজের একটি সুনির্বাচিত সংগ্রহের প্রতিলিপি সংযুক্তিতে। এর মধ্য দিয়ে লেখক মুর্তজা বশীর আর শিল্পী মুর্তজা বশীর যেন ধরা দেন অভিন্ন আলকেমিতে। এই অভেদাত্মার বোধ কেবল চিত্রকাজ ও লেখকতার মধ্যে সীমায়িত থাকে না, বৃহদার্থে জীবন ও শিল্পের অভেদ রূপের সাধক মুর্তজা বশীরকেই খুঁজে পাই যিনি জীবনের আশি বসন্ত পেরিয়েও যুগপৎ জীবনসংগ্রাম ও শিল্পসৃষ্টিতে মুখর। জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হয়ে কখনো জাঁ ককতোর কথা স্মরণ করেনÑ ‘বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা জিনিয়াসকে স্বীকৃতি দেয় কিন্তু কেড়ে নেয় তার বাঁচার অধিকার’ কিন্তু না, পরক্ষণেই মনে করেছেন তাঁর সমুদ্রসম জীবনতৃষ্ণার কথা তাই জীবনপথে যেতে যেতে চেয়েছেন শিল্পসুন্দরের দেখা; কি প্যারিসে, কি চট্টগ্রামে।

জীবনের কোনো পর্ব বা অভিজ্ঞতাকেই ঊন-জ্ঞান করেননি তিনি ফলে চট্টগ্রাম বাসের স্মৃতিতে মফস্বলে থাকার সমস্যার কথা উঠে আসলেও শেষ বিচারে চট্টগ্রামে বসবাসের সময়খণ্ডকে নিজের শিল্পঅভিজ্ঞতার পূর্ণতাপ্রাপ্তির পথরেখা হিসেবে বিবেচনা করেন যেখানে বাঙালির মিশ্র ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্রোতধারায় নিজেকে অভিষিক্ত করার পাঠ পেয়েছেন।

পাঁচ. ১৯৫৪-তে মুর্তজা বশীর লিখেছিলেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস আলট্রামেরিন। এর ছয় দশক পর প্রকাশিত হয়েছে আত্মকথাধর্মী বই আমার জীবন ও অন্যান্য। আলট্রামেরিন উপন্যাসে ভ্যান গগ উঠে এসেছিলেন বশীরের লেখকসত্তায়। গগ যেমন তীব্র একাকীত্বের ভেতর লালন করতেন সৃষ্টির গুরুতর যন্ত্রণা বশীরেরও ছিল তাই। আমরা বিশ্বাস করতে চাই প্রথম জীবনের আলট্রামেরিন- কালপর্ব জীবনের উপান্ত পর্যন্ত পেরোয়নি প্রিয় শিল্পী ও লেখক মুর্তজা বশীরের। তাই মুর্তজা বশীর ধূসর রঙের দর্পণে নিঃসঙ্গ নিজেকে নিয়ত আবিষ্কার করলেও তাঁর আমার জীবন ও অন্যান্য বইয়ের মধ্যে পাঠক পেয়ে যায় ভবিষ্যৎ শিল্পসৃষ্টির অজর আশামন্ত্র।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App