×

সাময়িকী

প্রত্যেকটা সৌন্দর্যসৃষ্টিই শিল্পীর সামাজিক দায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২০, ০৩:০৮ পিএম

প্রত্যেকটা সৌন্দর্যসৃষ্টিই শিল্পীর সামাজিক দায়

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়। জন্ম ১৯৩৬ সালে, বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। পরে পরিবারের সঙ্গে দেশত্যাগ করে ভারতের জলপাইগুড়িতে চলে যান এবং কলকাতায় স্থায়ী হন। কর্মজীবনে শিক্ষকতা ও পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী দেবেশ রায় রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন, জেলও খেটেছেন। পরে সাহিত্যে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : মফস্বলি বৃত্তান্ত, তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, শিল্পায়নের প্রতিবেদন, দাঙ্গার প্রতিবেদন, খরার প্রতিবেদন, তিস্তাপুরাণ, যযাতি, মানুষ খুন করে কেন, বেঁচে বত্তে থাকা, ইতিহাসের লোকজন, বরিশালের যোগেন মণ্ডল ইত্যাদি। কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় গত ১ মে প্রয়াত হয়েছেন। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে। তখন সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন : বিমল গুহ

আপনার লেখা প্রথম গল্প, আমরা জেনেছি, সেটা আপনি কলেজ জীবনে লিখেছেন।

দেবেশ রায় : আমি লেখালেখি শুরু করতে গল্পই লিখছিলাম। সেটার দুটো-একটি ওই সময় কলেজ ম্যাগাজিন বেরিয়েছিল। আমাদের কলেজে ‘কলেজ ফাউন্ডেশন’ থেকে কম্পিটিশন হতো। তাতে আমি কবিতাতেও প্রাইজ পেতাম, গল্পতেও প্রাইজ পেতাম। তারপর স্বাভাবিকভাবে একদিন মনে হলো যে, একটা গল্প লিখে দেশ-এ পাঠিয়ে দেই। পাঠিয়ে দিলাম। ছাপা হলো।

আপনার প্রথম লেখার উপজীব্য কী ছিল? স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, না সমাজবাস্তবতা- কোনটি?

দেবেশ রায় : দেখুন, আমি লেখা শুরুর আগে- অনেক ছোট বয়স থেকেই নিবিষ্ট পাঠক। অজস্র পড়তাম। আমি তো আর ইংরেজি স্কুলে পড়িনি। পড়েছি জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলে। খুবই নামকরা স্কুলে। কিন্তু আমি বলতে পারি, যতদূর পর্যন্ত আমার স্মৃতি যায়, তখন থেকে গল্প পড়ি। দাদার কাছে বইপত্র থাকে। পড়ি। আমার তখন ভীষণ অসন্তুষ্টি কাজ করত- যেগুলো পড়ছি, সেগুলো গল্প নাকি!

আপনার লেখায় নামকরণের বেলায় আপনি যে-নামগুলো নির্বাচন করেন, এত সাদামাটাভাবে কীভাবে করলেন?

দেবেশ রায় : বাংলা গল্প সম্পর্কে আমার আপত্তিটা শুরু হতো নামকরণ থেকেই। আমার একমাত্র ভালো লাগত রবীন্দ্রনাথের নাম। গল্পগুচ্ছের নামগুলো। এখানে নামের কোনো চেষ্টা নেই। কোনো বানানো নাম না। যেমন ধরুন- একটা গল্পের নাম ‘দেনা-পাওনা’। এখানে ভালো লাগত যে, গল্পের একটা মূল পয়েন্ট বলে দিচ্ছেন। শুধু উল্লেখ মাত্র। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘একরাত্রি’, ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’- এই নামগুলো অদ্ভুত লাগত। বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পের নাম আমার খুব ভালো লাগত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম সাংঘাতিক লাগত। খুব খারাপ লাগত সুবোধ ঘোষের নাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম- একেবারে বানানো। তারাশঙ্করের গল্প খুব ভালো লাগত, অভিভ‚ত করে দিত, কিন্তু নামকরণ খুব খারাপ লাগত। বনফুল কোনো দিনই ভালো লাগত না। না গল্প, না নাম- কোনোটাই না। বিভ‚তিভ‚ষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘রানুর কথামালা’ আমার কাছে অসামান্য লাগত। শরৎকুমার রায়চৌধুরীর গল্পগুলো খারাপ লাগত না, নামগুলো ভালো লাগত না।

অনেকে আবার নামের চমৎকারিত্বও পছন্দ করেন।

দেবেশ রায় : না, এটা একসময় বাংলা গল্প-উপন্যাসে ছিল। বিশেষ করে চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে তো এটা খুবই ছিল যে, নাম দিয়ে পাঠক ধরা বা নাম দিয়ে ক্রেতা ধরা। তখন তো বিয়ের বাড়িতে বইপুস্তক দেওয়ার রেওয়াজ ছিল বেশি। নাম শুনে যাতে মনে হয় যে, এর মধ্যে একটা রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার আছে।

আত্মগোপন লেখকের ধর্ম হওয়া উচিত।

দেবেশ রায় : লেখক কখনো আইডল হতে পারে না। লেখক কখনো সামাজিক সেলিব্রেটি হতে পারে না। লেখক কখনো হিরো হতে পারে না। লেখকের সমস্ত কাজ হবে নেপথ্যে থেকে। লেখক সত্তাটা খুব বেশি প্রাইভেট রাখতে হয়। বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমি প্রায়শ বলি- একজন লেখকের প্রয়োজন এনোনিমিটি, লেখকের অপরিচয়- এটা একজন লেখককে লালন করতে হয়।

উভয় বাংলায় তরুণরা যেভাবে সাহিত্যচর্চা করছে, সে বিষয়ে আপনার বিস্তর পাঠ আছে।

দেবেশ রায় : আমার ভীষণ প্রত্যাশা বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস নিয়ে। আমি বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাস যা পড়েছি এবং এখানকার লেখকদের নিয়ে বই লিখেছি। আমার ধারণা- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে-পরে যাদের জন্ম, তারা এখন দারুণ গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এটার অনুমোদন আছে। কিন্তু এটা দুঃখের কথা যে, এরকম যে হচ্ছে, চিরকালই তা-ই হয়, ইউরোপে অবশ্য হয় না। বাংলাদেশে যারা গল্প-উপন্যাসের সমালোচনা করেন। বিচার করেন, বিবেচনা করেন, তারা এটা বুঝতে পারছেন না। আমাদের ওখানেও বুঝতে পারছে না। তারা এটাকে কোনো প্রায়োরিটি দিচ্ছেন না। কিন্তু আমার কাছে এটা এক বিরাট ঘটনা। কোনো দেশের কোনো সাহিত্যেই প্রত্যেক বছর বিরাট লেখা বেরোয় না। মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে, আমি নাম ধরে ধরে বলছি, বাংলাদেশের বয়স্কতম লেখক হাসান আজিজুল হকের ‘বিধবাদের কথা’, জাকির তালুকদারের ‘পিতৃগণ’, শাহীন আখতারের ‘সখী রঙ্গমালা’, সালমা বাণীর ‘ইমিগ্রেশন’, পারভেজ হোসেনের কয়েকটা বড়ো গল্প, প্রশান্ত মৃধার কয়েকটা বড়ো গল্প, আমি মাত্র ৫-৬ জনের নাম উল্লেখ করলাম। এদের প্রত্যেকটা লেখা হচ্ছে ল্যান্ডমার্ক। এ কথা কখনো বলতে চাই না যে, আমি যে ৫-৬ জনের নাম বললাম, এঁরাই বর্তমান বাংলাদেশের লেখক। আরও লেখক আছেন। একটা দেশে বা একটা ভাষায় মাত্র ৪-৫ বছরের মধ্যে যদি এরকম দারুণ কাজ হয়ে থাকে, তাহলে আমি কি অন্ধ নাকি যে, আমি বুঝতে পারব না। বাংলাদেশের লেখকদের এ আত্মবিশ্বাস থাকা দরকার যে তারা বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কিছু গল্প, শ্রেষ্ঠ কিছু উপন্যাস লিখছেন।বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে রীতিমতো বিস্ফোরণ হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূগোল নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে। সবকিছু যে মাটির তলা থেকে ফুঁড়ে উঠছে। যেখানে হাসানকে সম্পূর্ণ নতুন শক্তিতে দেখা যাচ্ছে। আমি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকেও ধরছি। তিনি নেই এখন। হাসান ও আখতারুজ্জামান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের আজকের তরুণতম গল্পকাররা একটা অসম্ভব সম্ভাবনার ক্ষেত্রে তৈরি করে ফেলেছেন।

সবিশেষ কি বলবেন দেবেশ রায় : আমি একজন বাঙালি লেখক হিসেবে, বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে কখনো মনে করি না যে, আমি আন্তর্জাতিক লেখক নই। আমি ইংরেজিতে লিখি না বলে আমি আন্তর্জাতিক লেখক নই, এটা মনে করি না। একজন আন্তর্জাতিক পাঠকের যদি আমার লেখা পড়তে হয়, তবে সে বাংলা ভাষা শিখে আমার লেখা পড়বে। একজন লেখক তার ইমিডিয়েট পাঠকের জন্যই লেখে। আসলে, কলোনিয়াল ইমেজটা আমাদের মাঝে এত বেশি যে, আমরা যেটুকু ইংরেজি জানি, সেটুকুই আমাদের ক্ষতি করছে। (সংক্ষেপিত)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App