×

সাময়িকী

আমাদের কৃপণ দাদি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২০, ০২:৩১ পিএম

আমাদের কৃপণ দাদি

নয়নতারা বেগম দুপুরে ভাত মুখে দিয়েই বিরক্ত। এইডা কোনো রান্না হলো? জন্মের তেল পিঁয়াজ ঢালছে তাও মুখে দেয়া যায় না। গোস্ত দেখা যায় না সারা পাতিল ভরা খালি তেল আর তেল। মাগনা তেল পাইছে আর ঢালছে। বড় বউকে উদ্দেশ্য করে গজগজ চলল আরো কিছুক্ষণ। পাশে মুখ বন্ধ করে ভাত খাচ্ছে নয়নতারার স্বামী আজগর আলি, তার দুই ছেলে, ছেলের বউ এবং চার নাতি-নাতনি। ওরা সবাই জানে রান্না যথেষ্ট ভালো হয়েছে। নয়নতারার এটা অভ্যাস মাংস রান্না হলেই তার খুঁত বের করা। ভালো কোনো রান্না মানেই খরচ আর খরচ মানেই নয়নতারার নয়নে অন্ধকার দেখা।

নয়নতারা আমার দাদির নাম। বয়স ৬৫। এই গ্রামে আমরা একনামে পরিচিত। গ্রামে পরিচিতি আমাদের সম্পত্তি প্রচুর ব্যাপারটা তা না। দাদির কারণে আমরা পরিচিত। দাদিকে গ্রামের সবাই একনামে চিনে তার কৃপণতার জন্য। বাড়িতে মা আর চাচি সারাক্ষণ দাদির ভয়ে থাকে। বিলাসিতা কি জিনিস আমরা জানি না। যতটুকু শিখেছি তা চাচির কাছে। দাদির চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রয়োজনের চেয়েও একটু খরচ করা যায় চাচি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে।

আমার মা চাচির তুলনায় অনেক বোকা। তাই দাদির কাছে সবসময় কোনো না কোনো ব্যাপারে বকা খেতেই থাকে। চাচি মাঝেমাঝে মাকে একটু বেশি বকা খাওয়ানোর জন্য দাদির সামনে যেয়ে বলে, দেখছেন মা বড় ভাবির কাজ কেমন? সাথী-বিথিরে দুই টাকা করে টিফিন দিছে। এইটুকু মাইয়ার হাতে এতো টাকা দেয়ার দরকার আছে? তারপর চাচি সামনে থেকে মাকে চোখ টিপ দিয়ে হাসতে হাসতে সরে যায়। দাদি সেই সমস্ত বেলা মাকে বকতেই থাকে আর হাপিত্যেস করে দুই টাকা নষ্ট হওয়ার শোকে। আড়ালে চাচির এমন কাজের জন্য আমরা সবাই হাসি।

দাদির প্রধান শুত্রু দাদা। দাদা বাজারের দোকানে যেয়ে চা খায়। কাপপ্রতি দুই টাকা। দিনে সে ৬ থেকে ১০ টাকার চা খায়। মাসে প্রায় ৩০০ টাকার চা। দাদার এই চা খাওয়ার হিসাব আমাদের বাড়ির আশপাশের প্রায় সব বাচ্চা যাদের কথা বুঝার বুদ্ধি হয়েছে তারা সবাই জানে। কারণ দাদাকে উদ্দেশ্য করে দাদি প্রতিদিন দুই-তিনবার এ হিসাব মনে করিয়ে দেয়। দাদা কথাটা শুনেনি এমন ভাব করে বাজারে যায়।

অনেক দিন হয়ে গেলেও যখন দাদি বাড়িতে মাংস রান্নার নাম নিতে চাইতো না অথচ আমরা খাওয়ার জন্য মা আর চাচির কাছে বায়না করতাম দাদা তখন দাদিকে অনেক বুঝিয়ে পাশের গ্রামে দাদির ছোট বোনের বাড়ি বেড়াতে পাঠাতো। আমরা যে অভাবী ছিলাম তা না। আমার বাবা এবং চাচার বাজারে অনেক বড় দোকান আছে। দাদারও জমিজমা অবস্থা বেশ ভালো। অভাব কি আমরা জানি না। তবু ও দাদি তিনবেলা ডাল ভাতের বাইরে কোনো খাবার কিংবা কেনাকাটা সহ্য করতো না।

মা, চাচি এবং দাদির জন্য বাবা এক ঈদে নতুন শাড়ি কিনে আনে। তিন তিনটা শাড়ি কেনার শোকে দাদির জ্বর চলে আসে। তারপর থেকে কোনো ঈদে আমার মা এবং চাচি নতুন কাপড় কেনার কথা চিন্তাও করতে পারতো না। আমরা দুইবোন এবং চাচার একছেলে একমেয়ে কোনোরকমে কাপড় কিনলেও স্যান্ডেল লুকিয়ে রাখতাম। দাদির চোখ ফাঁকি দিয়ে দূরে যেয়ে ঈদের জামা আর নতুন স্যান্ডেল পরে পাড়া বেড়ানো শেষে বাড়ির কাছে এসে স্যান্ডেল খুলে তারপর বাড়ি আসতাম।

একদিন দাদা বাজার থেকে খুব বিরক্ত হয়ে বাড়িতে ফিরেছে কারণ দোকানের ছেলে দাদাকে নিয়ে ইয়ার্কি করেছে। ঘটনা হলো দাদার একবন্ধুর সাথে দেখা হলে দাদা চা খেতে দোকানে বসে। দুইকাপ চা দিতে বলে। দোকানের ছেলেটা ইয়ার্কি করে বলে, দুই কাপ চা দিমু দাদি কিছু কইবো না তো দাদা? মনে মনে দাদা ঠিক করে আজ দাদিকে কিছু বলতেই হবে। আর কত? এলাকায় নাতির বয়সী পোলাপান হাসাহাসি করে। বাড়ি এসে দেখে দাদি প্রায় বিছানাগত। বাড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে দাদির হার্টবিট এখনও আছে তবে ভীষণ দুর্বল হওয়ার কথা। আমার নানা এসেছিল তাই মা এক কেজি গরুর মাংস পুরোটা রান্না করে ফেলেছে। এই কথা শুনে দাদির মুখে কথা বন্ধ হয়ে গেছে। এ..ক.. কে..জি মাংস! আগেই বলেছি আমার মা ভীষণ বোকা। এতোদিনে দাদির পালস ধরতে পারেনি। চাচিও তখন পাশে ছিল না। যা হবার তা হয়েছে। দাদির এ কৃপণতার জন্য দাদার সাথে ঝগড়া হলেও তার দুজন ভালো বন্ধুও ছিল। সুখ-দুঃখের গল্প করে দুজনের সময় খারাপ কাটতো না।

সন্ধ্যার পর দাদি বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। ততক্ষণে একটু এক কেজি মাংসের শোক কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। দাদা খুব শান্ত সুরে দাদিকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, আমাদের তো খুব অভাব নাই তুমি এতো কৃপণতা করো কেন? আর কয়দিন বাঁচবো? এ বয়সে একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া করবা তা না খালি কৃপণতা। তোমার জন্য আমার সাথে বাচ্চা পোলাপান ইয়ার্কি করে। দুই টাকার জন্য হাসাহাসি করে। এককাপ চা বেশি খাইলে তোমার ভয় দেখায়। কতোবড় অপমান। দাদি বিরক্ত হয় দাদার অপমানের ঘটনা শুনে। তুমি আছো অপমান নিয়ে আর এদিকে বড়বউ যে এক কেজি মাংস একদিনে শেষ করে দিল সে খবর নাই। দাদা হতাশ চোখে দাদির দিকে তাকিয়ে থাকে।

আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীরা কখনো লবণের অভাব হলেও লবণ ছাড়া তরকারি রান্না করবে তবুও আমাদের বাড়ি খোঁজ করতে আসে না। দাদির এমন স্বভাবের জন্য আমি কিংবা আমার অন্য ভাইবোনরা দাদির সাথে কোথাও বেড়াতে যেতে চাইতাম না। ছোটবেলায় একবার দাদি আমাকে স্কুল থেকে আনতে যায়। স্কুল ছুটির পর আমি আইসক্রিম খেতে চাইলে দাদি খুশিমনে আমাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছিল তবে ফেরত পাবে এক টাকা। খুচরা না থাকায় আইসক্রিম ওয়ালা দিতে পারছিল না। দাদি প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করে এক টাকা নিয়ে তবে বাড়ি ফিরে। সেদিন থেকে আইসক্রিমওয়ালা আমাকে চিনতো। দেখা হলে দাদির খোঁজ নিত। আশপাশে যেই থাকতো দাদির সেদিনের ঘটনা হেসে হেসে বলতো।

এখন আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি। দাদি কোনোভাবেই মেলাতে পারে না কেন আমাকে টাকা খরচ করে ঢাকা পড়তে হবে? বাড়ির পাশে কলেজে যতদিন সরকারি টাকায় পড়েছি ততদিনই যথেষ্ট এখন কেন টাকা খরচ করে বাইরে হোস্টেলে থেকে পড়তে হবে।

চাচি দাদিকে অনেক পানি পড়া দেয় প্রতিনিয়ত। পড়ালেখা না করলে ভালো বিয়ে হবে না। সারাজীবন বাড়িতে বসে অন্ন ধ্বংস তার চেয়ে বরং এখন টাকা খরচ করে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়ে ভ্যাজাল পার করলেই ভালো। দাদির সম্ভবত চাচির যুক্তি পছন্দ হয়েছে। মাঝেমাঝেই আমার পড়া শেষ হতে আর কতদিন বাকি খোঁজ নেয়। অনেকদিন আমার বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে আনতে চেয়েও চোখের তারায় নয়নতারার কৃপণতার চিত্রগুলো ভেসে ওঠে। গ্রামে সবাই একনামে চিনুক বন্ধুদের মধ্যে সেই একই নামে পরিচিত হতে ইচ্ছে করে না। ভয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে আসি না।

হঠাৎ করে দেশে অচেনা অদেখা এক ভাইরাসের কবল পড়লো। দেশে নতুন রোগের আবির্ভাব হয়েছে। এক অদৃশ্য ভাইরাসের কারণে সারা পৃথিবী আতঙ্কিত। বাড়ি এসে আমার দিনগুলো কাটছিল কোনোমতে। দাদিকে এ রোগের কিছু বিষয় বুঝালাম। দাদি শুনে বলল ভালো এমন রোগ আল্লাহর দান। দাদিকে প্রশ্ন করলাম, এই রোগের কথা শুনে তুমি খুশি হলে মনে হয়? দাদির ঝটপট উত্তর- হ। যে রোগ আছে পথ্য দামি না। আবার খাইতে হবে খালি পানি, শরবত, মানুষের কাছে যাওয়া যাবে না। এমুন রোগই তো ভালো। অন্য রোগে টাকা খরচ। এই দুঃখের দিনেও আমরা হাসলাম।

তার দিনকয়েক পর এক সন্ধ্যায় আমার দাদা মারা গেলেন। কোনোরকম অসুস্থতা নেই। একেবারেই সুস্থ একজন মানুষ। দাদি একা হয়ে গেল। জ্ঞান হওয়া অবধি দাদিকে সারাক্ষণ সংসারের চিন্তাই করতে দেখেছি। এই প্রথম তাকে এমন উদাসীন হতে দেখলাম। কোনো ব্যাপারেই কোনো আগ্রহ নেই। ততদিনে দেশে করোনা ভাইরাসের কারণে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ। সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছ। গ্রামে অনেক মানুষ কাজ হারিয়ে ?ঘরে বসে আছে। অনেকের আয়-রোজগার একেবারে বন্ধ। এই মহামারির প্রাদুর্ভাব নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো কেউ কেউ হাত পাতছে। প্রতিবেশীর কাছে। দাদির ভয়ে কেউ আমাদের বাড়ি আসার সাহস পায় না। মা-চাচি লুকিয়ে লুকিয়ে যাকে যতটুকু পারে সাহায্য করে।

একদিন সন্ধ্যায় দাদি আমাদের সবাইকে তার ঘরে ডেকে পাঠালো। আমরা দাদির আদেশ শুনার অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দাদি বলল এই যে রোগটা আইলো গ্রামে এতো মানুষ না খাইয়া ঘরবন্দি। আমি এদের জন্য কিছু করতে চাই। দাদির মুখে একথা শুনে আমরা সবাই কথা বলা ভুলে গেলাম। দাদি মানুষকে সাহায্য করতে চাচ্ছে? বাবা বলল মা তুমি কীভাবে সাহায্য করতে চাও বলো। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। সবাইকে আবারো অবাক করে দাদি জানালো তোদের কারো টাকা আমি নিতে চাই না। তোদের আব্বা এ বছর হজ করতে চাইছিল। টাকা জমাইছিলাম আমরা। হজ তার কপালে জুটলো না। কিন্তু সে টাকাটা আমি গ্রামের এই না খাওয়া মানুষগুলারে দিতে চাই।

আমি অপলক দাদির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই কি সেই দাদি? মনে হলো আমি এ শুভ্র শাড়ি পরা মহিলাকে চিনি না। মনে হলো কোনো দেবদূত আমার সামনে বসা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App