×

সাময়িকী

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:২৮ পিএম

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

আমি মনে মনে বলি জুতো মেরে গরু দান। আমাকে তুলে দিতে এসেছিল পার্সোনাল অফিসার মি. হরিপদ নাগ। হরিপদ ম্যানিলা মিশনে পোস্টিংয়ে আসার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমার পার্সোনাল অফিসার ছিল। তখন আমি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং জাতীয় সংসদ বিষয়ক ডেস্কের প্রধান।

ম্যানিলায় নিনয় একুইনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি। ঘড়িতে ন’টার বেশি হবে। লাউঞ্জ হোস্টেস জিগ্যেস করল, কফি দেব স্যার?

না, গ্রিন টি।

গ্রিন টি হবে না স্যার। রেড টি পাওয়া যাবে।

দুধ ও চিনির দরকার নেই। শুধু চা।

গ্রিন টি কেন পানীয় হিসেবে চা-ই তেমন জনপ্রিয় নয় ফিলিপাইনে। ফিলিপিনোরা পছন্দ করে কফি। কেন করে জিগ্যেস করা হলে অনেকেই বলবে আমেরিকানরা পছন্দ করে তাই। মার্কিনিদের কাছে কফি প্রিয় হলে ফিলিপিনোদেরও যে তা ভালো লাগবে তার কোনো যুক্তি নেই। তা সত্ত্বেও অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় ফিলিপিনোরা মার্কিনিদের অনুসরণ করে। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশ ছিল ফিলিপাইন। ১৮৯৮ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি।

আমার গন্তব্য পালাও। পালাও প্রশান্ত মহাসাগরের একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। প্রায় চারশ মাইল দীর্ঘ এই রাষ্ট্রের চারপাশে পাপুয়া নিউগিনি, গুয়াম ও ফিলিপাইন। প্রশান্ত মহাসাগরের নীলজল ফুঁড়ে বেরুনো আরো প্রতিবেশী রয়েছে দেশটির। মাইক্রোনেশিয়া, কিরিবাতি, মার্শাল আইল্যান্ডস, নাউরু, সলোমোন দ্বীপপুঞ্জ ও টুভালু। মানচিত্রের দিকে তাকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই রাষ্ট্রকে লাগে বিন্দুর মতো। মনে হয় মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি এই বুঝি ও বিন্দুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। চারপাশে শুধু আদিগন্ত জলকল্লোল আর ওই জলকল্লোলের বিপরীতে সাগরের বুকে উইয়ের টিবির মতো মাথা উঁচিয়ে থাকা প্যাসিফিকের এই দেশমালা। দেশগুলোর সঙ্গে পালাওয়ের কোনো ভূ-যোগাযোগ নেই। প্যাসিফিক মহাসাগরের মাঝে ডুবুডুবু এই রাষ্ট্রের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ আকাশ ও সমুদ্র পথে। আকাশ পথে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে পালাও যাওয়ার জন্য লাউঞ্জে অপেক্ষা করছি। রাত ১০টা ১০ মিনিটে প্লেন ছাড়বে। পালাওয়ের এক সময়ের রাজধানী কোরোর পৌঁছব রাত ১টা ৫০ মিনিটে। ২২ জানুয়ারি ২০১০-এর রাত। লাউঞ্জের অধিকাংশ স্টাফই আমার পরিচিত। রাষ্ট্রদূত হয়ে যেদিন ফিলিপাইনে এলাম সেদিন থেকেই এই লাউঞ্জ আমি ব্যবহার করছি।

আমার চা এলো। এশীয় আতিথেয়তা পাশ্চাত্যের মতো নয়। পাশ্চাত্যের চেয়ে অনেক উষ্ণ।

পালাওয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক যোগাযোগ নেই। কিন্তু দশটিতে আমাদের ছ-সাতশ নাগরিক নানা পেশায় কর্মরত রয়েছেন। সেখানে তাদের সুবিধা-অসুবিধা রাষ্ট্রের পক্ষ হতে দেখার মতো কেউ নেই। শুধু তাই নয়, দেশটিতে আজ অবধি কোনো সরকারি প্রতিনিধি কার্যোপলক্ষে ভ্রমণ করেননি বা করার প্রয়োজন হয়নি। পালাওয়ের সবচেয়ে নিকটবর্তী রাষ্ট্র ফিলিপাইন। সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পালাওয়ে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের কনস্যুলার সার্ভিসেসসহ অন্যান্য সেবা দেয়া হয়। সেটিও সহজ হয় না। অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। অভিবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানত বাস করেন দেশটির প্রধান শহর কোরোরে। সম্প্রতি অভিবাসনজনিত নানা জটিলতায় সেখানে তারা তীব্র অসুবিধার মুখোমুখি। একটি বিশেষ মিশনে বাংলাদেশ সরকার আমাকে তাই সেখানে যাবার নির্দেশ দিয়েছে। দেশটির উঁচু পর্যায়ে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে। পালাও ফিলিপাইন নিকটবর্তী দেশ হলেও আকাশ পথে রাষ্ট্র দুটোর দূরত্ব সাড়ে তিন ঘণ্টারও বেশি। ম্যানিলা ও কোরোরের মাঝে একমাত্র কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইনন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে। তাও সপ্তাহে দুবার। নির্ধারিত রিটার্ন রুট ম্যানিলা-কোরোর-গুয়াম। পালাওয়ে প্রায় চার-পাঁচ হাজার ফিলিপিনো অভিবাসী শ্রমজীবী রয়েছে। এক সময় এশিয়া স্পিরিট ম্যানিলাসেবু-কোরোর ফ্লাইট পরিচালনা করত।

সাড়ে ন’টার পর কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের একজন স্টাফ এলো ভিভিআইপি লাউঞ্জে। পরিচয় জানিয়ে বলল, সে আমাকে বোর্ডিংয়ের জন্য নিয়ে যেতে চায়। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। সেকথা জানাতেই উত্তর দিল, বোর্ডিংয়ের আগে আপনাকে কন্টিনেন্টাল এয়ারের পলিসি অনুযায়ী সার্চ করতে চাই।

এ হলো নাইন-ইলেভেন উত্তর পৃথিবীর বড় নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা। নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার সন্ত্রাসী হামলায় ২০০১-এ বিধ্বস্ত হওয়ার আগে আকাশ পথে ভ্রমণের সময় যাত্রীদের ব্যাপক হারে দেহ তল্লাশির পূর্বেকার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত করেছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর নাগরিকদের আমেরিকা ইউরোপে ভ্রমণের বেলায় অনেক সময় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। সে সারিতে যেমন আছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি আবুল কালাম আজাদ তেমনি আমার মতো কূটনীতিবিদ হয়ে সাধারণ অভিবাসী শ্রমিকেরা। লাউঞ্জে আমি ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। সেবা প্রদানকারী স্টাফেরা তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। তাদের উৎসুক চোখ খেয়াল করে কন্টিনেন্টাল স্টাফকে বললাম, একজন রাষ্ট্রদূতও কি তোমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি?

অবশ্যই নয়। তবে এটি আমাদের এয়ারলাইন্সের পলিসি। পলিসিটি একটু স্ববিরোধী হয়ে গেল না।

স্টাফটি কোনো জবাব দিল না। অবশ্য তাকে এ বিষয়ে বলা অর্থহীন। সামগ্রিক ও নিখুঁত নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এমন পদক্ষেপ নিয়েছে হয়তো। সে আমার দেহ তল্লাশির পর জুতো খুলতে বলল। জুতো খুলে স্টাফটিকে জিগ্যেস করলাম, আমাকে কি এখন প্যান্টের বেল্ট খুলতে হবে?

এমন জিজ্ঞাসার অবশ্য হেতু রয়েছে। কারণ অধিকাংশ যাত্রীবাহী বিমান সংস্থা তথাকথিত নিরাপত্তার স্বার্থে যাত্রীদের কোমরের বেল্ট পর্যন্ত খুলে তল্লাশি করে।

না স্যার, তার আর দরকার হবে না।

আমাকে আর সবার মতো ইমিগ্রেশন চেক ইন-এর আগে তল্লাশি করা যেত।

কথাটা আমি বললাম এ জন্য যে শত শত যাত্রীর সঙ্গে নিরাপত্তার এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে আমাকে আর একা এভাবে হেনস্থা হতে হতো না। না, না তা কী করে হয় স্যার। আপনি আমাদের একজন সম্মানিত যাত্রী। আপনার যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে এই বিশেষ ব্যবস্থা। আপনাকে সবার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে তাই হয় নাকি।

আমি মনে মনে বলি জুতো মেরে গরু দান। আমাকে তুলে দিতে এসেছিল পার্সোনাল অফিসার মি. হরিপদ নাগ। হরিপদ ম্যানিলা মিশনে পোস্টিংয়ে আসার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমার পার্সেনাল অফিসার ছিল। তখন আমি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং জাতীয় সংসদ বিষয়ক ডেস্কের প্রধান। সে দাঁড়িয়েছিল ভাবলেশহীন। কারণ হরিপদও সাম্প্রতিক পৃথিবীর এক তরফা পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে অনবহিত ছিল না। তবে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আজ অবধি এমন দুর্দান্ত তল্লাশির অভিজ্ঞতা এই প্রথম। এ হলো মার্কিনিদের অতি মোড়লিপনার বিন্দুবৎ প্রকাশ।

ম্যানিলা থেকে প্লেন ছাড়ল শিডিউল মতো। কোরোর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছতে রাত দুটো।

সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল প্রবাসী বাঙালিরা। অতল অসীম প্যাসিফিকে, দেশ হতে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে আমার একমাত্র স্বজন। এই প্রবাসী ভাইবোনেরা যথার্থই স্বজন। কিন্তু সমস্যা হলো তাদের অমোচনীয় বিভক্তি। বিভক্তির কারণ

তাদের ভাষায়ই বলা যায়।

স্যার মিল হয় কীভাবে? শুক্রবার-শুক্রবার এই দেশে যার আটদিন সেও নেতা হতে চায়। এটা কি মানার মতো?

পালাওতে বাংলাদেশিদের দুটো দল। আশ্চার্যজনকভাবে তা আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি ঘরানার নয়। নির্দলীয়। বাঙালির সংখ্যা এখানে মাত্র ছ-সাতশ। সংখ্যা বাড়লে হয়তো দল উপদলের সংখ্যা বাড়বে। যুক্তরাজ্যে আমি এক সময় সহকারী হাইকমিশনার ছিলাম। আমার অধিক্ষেত্রাধীন এলাকা বার্মিংহাম ওয়েস্ট মিডল্যান্ডে বাঙালিদের শত শত সংগঠন ছিল। কাজ করতে হলে সংগঠনের প্রয়োজন। তারচেয়ে বেশি প্রয়োজন পদ পদবি। প্রয়োজন নয় কি?

গভীর রাতের এই অভ্যর্থনায় উপস্থিত রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ইন পালাওয়ের নেতা জনাব আমীন নূরুল ও তার সমর্থকরা। এই সফর আয়োজনে তিনি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ দূতাবাস ম্যানিলাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে আসছিলেন। প্রধানত তিনিই এখানে কর্মরত প্রবাসী বাঙালিদের অসুবিধাগুলো আমাদের গোচরে এনে তা প্রতিকারে অনেক দিন ধরে সচেষ্ট আছেন।

বিমানবন্দরের বাইরে এসে বাঙালিদের আরেকটি গোষ্ঠীর মুখোমুখি হলাম। বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের নেতা আলাউদ্দিন আল আজাদ বললেন, স্যার, আপনি জার্নি করে এসেছেন। আপনাকে বিরক্তও করব না, সময়ও নেব না। আমার লোকজনেরা আপনাকে একটু ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাবে। সে পর্ব তো বিমানবন্দরের ভেতরে হলো একবার।

আমীনেরা ইতোমধ্যেই আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে ছোট একটি ফটো সেশন করেছে। ছবি ওঠানোর কোনো দরকার ছিল না কিন্তু সাংগঠনিক তৎপরতার দু-চারটে চিহ্ন এবং সেই চিহ্ন অবলম্বনে একটু প্রচার না থাকলে সংগঠনের গোড়াটা মজবুত হয় না। আপনি তো সবই বুঝতে পারছেন স্যার।

রওনা হওয়ার আগে আজাদ ম্যানিলায় আমাকে ফোন করেছিল। বলল, আপনি পালাও আসছেন জেনে খুব খুশি হয়েছি স্যার। আমরা আপনাকে নেয়ার জন্য এয়ারপোর্টে থাকব। আমি প্রমাদ গুনি। তাদের থাকার অর্থ আমীন ও আজাদের সমর্থকদের মাঝে বিরোধের কারণে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়া। বললাম, কোনো দরকার নেই। আমীনেরা থাকবে। আপনি সকাল ১০টায় হোটেলে দেখা করুন।

তাই কি হয় স্যার। আপনি আসছেন শুধু এই বলে নয় এই প্রথম একজন সরকারি প্রতিনিধি আমাদের প্রয়োজনে পালাও আসছেন। আমরা তাকে রিসিভ করব না তাই হয় নাকি।

আপনারা সবাই একত্র হয়ে আসুন না। তাতে যেমন নিজেদের একতা বাড়বে দেশেরও সম্মান বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দলাদলি বিদেশিরা ভালো চোখে দেখে না।

আমরা তো চাই মিলেমিশে থাকতে কিন্তু কী যে স্বার্থে অনেকে তা চায় না। আপনি আসুন সব বলব।

না, না আমার শোনার দরকার নেই। আপনাদের গোলমাল মেটাতে তো আর আমার পালাও আসা নয়। এরচেয়ে অনেক জরুরি কাজ রয়েছে। আমি জানি স্যার।

আজাদ কথায় নম্র। তাকে বললাম, বিমানবন্দরে দেশের জন্য অপ্রীতিকর কিছু যেন না ঘটে।

আমীন নূরুলকেও সতর্ক করা হয়েছিল এ বিষয়ে। বিমানবন্দরে তারা উভয়েই সংযত আচরণ করায় আজাদদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো নির্বিঘ্ন হলো। তখন রাত ৩টার মতো। মেঘাচ্ছন্ন পালাওয়ের আকাশ। মাঝেমধ্যে মেঘ কেটে বেরুচ্ছে অস্পষ্ট আসমান। এই মুহূর্তে প্রকৃতি বৃষ্টি ভেজা। আমি ভাবছিলাম দেশের কথা। জন্মভূমি থেকে কতদূরে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটি সবুজ বিন্দুতে ভেসে আছি। সেই সবুজ বিন্দুর পোশাকি নাম রিপাবলিক অব পালাও। সাগরের বুক চেরা দীঘল একটি ভূখণ্ড। পাহাড়ি। একে অনেকেই রক আইল্যান্ডসও বলে। আয়তন মোটে চারশ পঞ্চাশ বর্গকিলোমিটার। দেশটি উত্তর-দক্ষিণে প্রায় চারশ মাইল লম্বা আর লোকসংখ্যা মাত্র বিশ হাজার। এই জনসংখ্যার তুলনায় এখানে বাঙালিদের সংখ্যা নগণ্য নয়। শতকরা প্রায় চার ভাগ। পালাওয়ের চারপাশে শুধুই আদিগন্ত জলরাশি। তার মাঝে ছোট্ট একটি ভূখণ্ড। আর সেই ভূখণ্ডে একদল কর্মমুখর বাঙালি। আমার স্বদেশি। বৃষ্টিস্নাত গভীর রাতে খোলা আকাশের পানে তাকিয়ে আর চারপাশের সামুদ্রিক জলের লোনা উচ্ছ্বাস অনুভব করে আমার অদ্ভুত লাগতে থাকে।

জনা পঁচিশেক বাংলাদেশি জড়ো হয়েছিল বিমানবন্দরে। তাদের কাছ থেকে বিদায় নেই। শুধু আমীনরা তিনজন আমার সঙ্গে এলো। পালাও সরকারের গাড়িতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল কর্মকর্তা আমাকে হোটেল প্যালেশিয়াতে পৌঁছে দিল।

২. প্যালেশিয়া ফোর স্টার হোটেল। কোরোরের কেন্দ্রস্থলে। তিন তলায় রুম পেলাম। সিংগেল ডিলাক্স রুমের বুকিং ছিল। হোটেল ম্যানেজমেন্ট তা আপগ্রেড করে জুনিয়র স্যুইট করে দিল। স্যুইটের এক রুমে সিটি ভিউ। অন্যরুম থেকে চোখে পড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের বিশালতা। দূরত্ব এক কিলোমিটার হবে হয়তো। হোটেল থেকে হাঁটার দূরত্বেই রেস্টেুরেন্ট, গ্রোসারি, ফাস্ট ফুড সপ। প্যালেশিয়া তাইওয়ানি বিনিয়োগ। তাইওয়ানিজ মালিকের বাসা হোটেলের কাছেই। সকালে আমীন তার ডেলিগেশন নিয়ে আমার স্যুইটে দেখা করতে এলে তাদের একজন পরিচয় দিল, আমি প্যালেশিয়া হোটেল মালিকের কার্পেন্টার।

ও তাই। তা আপনার কাজ কি এই হোটেলেই? না, মালিকের বাড়িতে। ওখানেই তার কারখানা। আমি ওই কারখানার প্রধান কাঠমিস্ত্রি।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় প্যালেশিয়ার মালিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা হয়নি। অনেক রাতে ঘুমিয়েছি। ব্রেকফাস্টে যেতে দেরি হলো। যখন নিচতলায় রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম তখন প্রাতঃরাশ প্রায় শেষ। ওয়েটার ওয়েট্রেসরা টেবিল সাজাচ্ছে লাঞ্চের জন্য। একটি টেবিলে কফি ও পত্রিকা নিয়ে বসেছিলেন মালিক ভদ্রলোক। বসার সঙ্গে একটু-আধটু কাজের তদারকিও চলছিল। এতবড় হোটেলের মালিক কিন্তু কাজের বেলায় ধনী মানুষ সুলভ কোনো জড়তা নেই। তিনি আমাকে মাঝেমধ্যেই খেয়াল করছিলেন। আসলে হোটেলে কী ধরনের গেস্ট আসেন বা থাকেন তা সব সময়ই টপ ম্যানেজমেন্ট খেয়াল রাখে। প্রয়োজনে তারা শুভেচ্ছা কার্ড সঙ্গে ঝুড়িতে কিছু ফল অথবা দু-এক বোতল ওয়াইন অতিথিদের রুমে পৌঁছে দেন। এ হলো সৌজন্য প্রকাশের উপলক্ষ ধরে হোটেলের সুনাম বৃদ্ধির প্রয়াস।

আমার ধারণা প্যালেশিয়ায় আমার অবস্থান মালিক ভদ্রলোকের অজানা নয়। কারণ হোটেল ম্যানেজমেন্টকে আগেই জানিয়ে রাখা রয়েছে অনেক অভিবাসী বাঙালি আমার সঙ্গে সময়ে-অসময়ে দেখা করতে আসবে। তাদের নিয়ে প্যালেশিয়ার হলরুমে একটি সভাও করব আমরা। এতে অন্য অতিথিদের একটু অসুবিধা হতে পারে তা যেন তারা খেয়াল রাখেন। হোটেলের সিংহভাগ বোর্ডার জাপানিজ এবং তাইওয়ানিজ ট্যুরিস্ট। তাদের অনেকেই ভ্রমণ করছেন সপরিবারে। এদের মধ্যে অনেকে আবার বয়স্ক। আমরা বাঙালিরা চলাফেরায় সব সময় অন্যের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়ে খেয়াল রাখি না। এতে করে প্যালেশিয়ায় কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতি হতে পারে অনুমান করে ম্যানেজমেন্টকে আগাম সতর্ক রাখা।

তাইওয়ানিজ মালিকের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো। সে হয়তো তখন জানল এই আমি তার প্রধান কাঠমিস্ত্রির দেশের রাষ্ট্রদূত। তাতে অবশ্য কোনো অসুবিধা নেই। সারা পৃথিবীতে আমাদের বর্তমানে সত্তর লাখেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিক। তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন নিয়ত ভারসাম্য রাখছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। সচল রেখেছে অর্থনীতির চাকা। উপসাগরীয় দেশগুলোয় আমাদের সবচেয়ে বেশি লোকজন কাজ করছেন। বলাই বাহুল্য তাদের অধিকাংশই পছন্দমতো পেশায় কাজ পাননি। এদের বিশাল একটি অংশ সৌদি আরব, আমিরাত, কুয়েত, কাতার প্রভৃতি দেশে সুইপার। আর ওইসব দেশে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তাই রসিকতা করে বলা হয় অ্যাম্বাসেডর অব সুইপারস্।

বাংলাদেশের এখন সময় এসেছে বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক কর্মী না পাঠানোর। অ্যাম্বাসেডর অব সুইপারস্্ গ্লানি থেকে কাউকে মুক্ত করবার জন্য নয়। বিদেশে কর্মী প্রেরণ করে আমরা যে উপার্জন করি তা বাড়াতে। অর্থাৎ ভ্যালু অ্যাডিসনের জন্য। দ্বিতীয়ত শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের মাধ্যমে দেশের ইমেজ বাড়াতে। স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছর পর বাংলাদেশ এ ল্যান্ড অব সুইপারস্ হয়ে বিশ্ব সমাজে থাকতে পারে না।

আমাদের দক্ষ পরিশ্রমী হাতের অভাব নেই। আমাদের সামর্থ্য কেন বাইরের পৃথিবী জানবে না। ফিলিপাইন বাংলাদেশের মতোই একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ। আমাদের তুলনায় সামান্য বেশি অভিবাসী ফিলিপিনো দুনিয়ার নানা দেশে ছড়িয়ে আছে। তাদের অধিকাংশই দক্ষ। যে কারণে তাদের জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের চেয়ে ভ্যালু অ্যাডিসন বেশি। বর্তমানে ফিলিপাইন এই সেক্টরে বছরে ১৭ বিলিয়ন ডলার আয় করে। সেখানে বাংলাদেশের উপার্জন মাত্র ১১ বিলিয়ন ডলার।

আমাকে চুপ করে ভাবতে দেখে প্রধান কাঠমিস্ত্রি বলল, মালিককে আমি বলেছি আপনি কয়েকদিন এখানে থাকবেন। কোনো অসুবিধা হলে বলবেন স্যার। খুবই আন্তরিক একটি প্রস্তাব। প্রধান কাঠমিস্ত্রির বাড়ি নোয়াখালী। তিনি আমীন নূরুলদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্গানাইজেশন ইন পালাওয়ের একজন নেতা। উত্তর দেই, অসুবিধা হলে অবশ্যই বলব। তবে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। এ ধরনের হোটেলে সাধারণত কোনো অসুবিধা হয় না। আর প্যালেশিয়ায় স্টাফদের সহযোগী বলেই মনে হচ্ছে।

আমীন ও হেড কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে শরীফ এসেছে। সে কালরাতে বিমানবন্দরে ছিল। শুধু তাই নয়, হোটেল অবধিও এসেছিল। তাদের জিগ্যেস করিÑ আজাদরা এলো না? একসঙ্গে কথা বললে আপনাদের অসুবিধাগুলো একবারে জেনে নিতে পারতাম।

আজাদ এখানে একটি ভালো কোম্পানিতে সিকিউরিটি গার্ড। আমীনের পেশাও তাই। শরীফ কাজ করছে একটি জাপানিজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। আমীন জবাব দিল, বলেছিলাম স্যার। তারা আপনার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চায়।

আমার খারাপ লাগতে থাকে। পৃথিবীতে আজ বাঙালিরা যেখানেই আছে সেখানেই অনৈক্য- নেতৃত্বের কোন্দল।

(চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App