×

সাময়িকী

যে রাতে আমার স্ত্রী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০৭:২৮ পিএম

যে রাতে আমার স্ত্রী

৯০ দশকে রাজধানীর ভূতের গলিতে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বাসায় শিল্পী রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, হাশেম খান এবং সাইফুদ্দিন আহমদ

যে রাতে আমার স্ত্রী

শবনমের কথাটা বলে দেয় নাদেরা। আমি বলি, এ জন্যই তো প্রোলেতারিয়েত!

নাদেরা বেগম একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল। সবসুদ্ধ আটজন শিক্ষক, একজন প্রিন্সিপাল- আপু ওয়াক্কাস চেহারা খানিটা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনেরই মতো। প্রিন্সিপালের রুমেই বসেন দু’জন ভাইস-প্রিন্সিপাল। নাদেরা বেগম, ক্লাসিক্যাল নাচ শেখান। আর একজন ভাইস-পিন্সিপাল বখতিয়ার খিলজি, তিনি টাকা পয়সার হিসব রাখেন, মাসের শেষে আমাদের কিছু বেতন দেন আর নিজের হাতে বড় আর্ট পেপারের উপর নকশা করেন- প্রোলেতারিয়েত একাডেমি ভবন, ১৪ তলা, সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশনড।

পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি একতলা বাড়ি আমরা ইজারা নিয়ে গানের স্কুল এবং স্কলার্স সামিট চালিয়ে যাচ্ছি। একাধিকবার উচ্ছেদ নোটিশ পেয়েছি, তবুও আঁকড়ে ধরে আছি।

স্কলার্স সামিট আসলে একটি সাপ্তাহিক দু’ঘণ্টার ক্লাস। পনের থেকে কুড়ি জন হাজির হয়। কোনো হাজিরা খাতা নেই, শিক্ষার্থীদের কোনো বেতন নেই, কথিত স্কলারদেরও কোনো মাসোয়ারা নেই। আমি মার্ক্সীয় অর্থনীতির নিয়ে কোনো মাসে দুটো কোনো মাসে একটা লেকচার দিই। আবু ওয়াক্কাস পড়ান প্রোলেতারিয়েত বিদ্রোহ ও রুশ বিপ্লব। রাশিয়া থেকে টুকরো টুকরো হয়ে যাবার পরও আবু ওয়াক্কাস বলেন, ও কিছু না। সব ঠিক হয়ে যাবে। গর্ভাচেব একটা আস্ত বেঈমান। পশ্চিমের প্রোপাগান্ডায় কান দেবেন না। শবনম শুরুতে স্কলার্স সামিটে শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দিয়েছিল। জায়ানটের ডিগ্রি ছিল, গলাও ভালো, আবু ওয়াক্কাস তাকে নিয়ে নিণেন নজরুল গীতির শিক্ষকের শূন্য পদে এবং এটাও বললেন, বেতন যা পাবে তাতে রিকশা ভাড়াটা হয়ে যাবে, এর বেশি কিছু আশা করো না।

আমি সঙ্গীত বিভাগের পার্ট-টাইম শিক্ষক, তবলা বাজাই, তবলা শেখাই, একাডেমির অনুষ্ঠানে (বছরে ছয়টা- পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, নজরুল জন্মজয়ন্তী হেমন্ত ও বসন্ত উৎসব এবং প্রোলেতারিয়েত একাডেমির প্রতিষ্ঠা দিবস। ১২ নভেম্বর।)

আমন্ত্রিত শিল্পীদের সাথে তবলা সঙ্গত করি।

সেদিন আমি সিনেমার গল্প বলে অর্থনীতি বোঝাচ্ছি- মার্ক্সীয় অর্থনীতি : কাপড়ের কল চলছে। হঠাৎ একজন শ্রমিকের একটি হাত কলের ভেতর ঢুকে পড়ল। সাদা কাপড়ের রোলে রক্তাক্ত কাপড় পেঁচাতে থাকে। এক সময় হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে কলের তলায় পাটাতনে পড়ে যায়। কাপড়ে রক্ত লাগা বন্ধ হয়ে আসে।

মালিকের প্রতিনিধি এবং কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার এসে রোল ঘুরিয়ে রক্তলাগা সাদা কাপড়ের অংশ দু’পাশ থেকে ছিঁড়ে ফিতে দিয়ে মেপে বলল, দশ গজ নষ্ট করেছিস।

ক্ষুব্ধ চাহনিতে শ্রমিকের দিকে তাকয়ে বলল, হারামজাদা তোর বেতন থেকে কেটে রাখব। শ্রমিক তখন হাত বিচ্ছিন্ন কাঁধের দিকে তাকিয়ে থকাতে থাকতে এক সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।

ক্লাস শেষ হলে শবনম বলল, ভাই, (আমরা স্যার বলা নিরুৎসাহিত করে থাকি) আপনি যখন গল্পটা শোনাচ্ছিলেন আমি কাপড়ের কলে সাদা কাপড়ের আছড়ে পড়া বিচ্ছিন্ন হাতটা দেখতে পাচ্ছিলাম। আপনি খুব ভালো পড়ান।

আমি জানি অর্থনীতিকে বলে বিমর্ষ বিজ্ঞান।

আমি এটাও জানি, যত বিমর্ষই হোক, শিক্ষার্থীকে পাঠের আনন্দ পেতে হবে। সে জন্যই গল্প কৌতুক, গান এসব মিশিয়ে আমি অর্থনীতি পড়াই। আমি বিশ্বায়নের কথা বলি, মাল্টিন্যাশনালের দৌরাত্ম্যের কথা শোনাই একদিন বলি বিশ্বায়নের সবচেয়ে সুন্দর গানটি বাংলায় লেখা হয়েছে:

হরিদাসের বুলবুল ভাজা টাটকা তাজা খেতে মজা এ ভাজা খেলে রুচবে না আর খাজা গজা। মহারানী ভিক্টোরিয়া এ ভাজা খায় রোজ কিনিয়া ভাজা খেয়ে বোঝে না সে কেইবা রানী কেইবা প্রজা।

ম্যাকডোনাল্ডস-এর বার্গারের আগেই এ খাবারটি বিশ্ববাজারে ঢুকে পড়ে, এমনকি মহারানী ভিক্টোরিয়াও তা গাটের পয়সা দিয়ে কিনে খান। এই বুলবুল বাজার একটা মাদকতা আছে এটা খেলে অন্য কিছু মুখে রোচে না। বুলবুল ভাজার একটি সাম্যবাদী প্রতিক্রিয়াও রয়েছে- এ ভাজা খাবার পর মহারানী নিজেই বুঝতে পারেন না- কে রানী কে প্রজা।

ক্লাস শেষ শবনব বলল, দারুণ! তখন আমি একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। অর্থনীতি পড়াই। আমার কেবল বেঁচে থাকার চেয়ে বড় কোনো স্বপ্ন নেই। কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। অবশ্য স্কলে ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় আমি ডাক্তার হতে চেয়েছি, টমাস আলভা এডিসনের মতো বৈজ্ঞানিক হতে চেয়েছি, জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের মতো চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছি।

এখন আমি কিছুই হতে চাই না। বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থেকে অবন্তীর বড় হওয়া দেখতে চাই।

(তিন)

শবনমের ৭২ ঘণ্টা যদি ৯৬ ঘণ্টাতেও গড়ায়, আমি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন নই। প্রথমত, আমি ভালোই আছি, দ্বিতীয়ত, আমাকে আর একটা সংসার করতেই হবে এমন কোনো প্রতিজ্ঞাও আমি করিনি। শবনমই আমার মধ্যে সমস্যা দেখেছে সমাধানের একটা দায়ও সে নিয়ে নিয়েছে।

আমি প্রকৃতিগতভাবে গম্ভীর মানুষ নই। আবদুল খালেকরা সাধারণত গম্ভীর হয় না। অন্তত এ নামের কোনো গম্ভীর মানুষ আমার চোখে পড়েনি।

শবনমকে দেখায়, মানে তার সাথে চোখাচোখি হবার পর আমি যতো নৈর্ব্যক্তিক থকাতে চেষ্টা করি না কেন আমার চোখের মলিন চাহনিতে সম্ভবত একটা জিজ্ঞাসা ছিল, কি ব্যাপার কী সলুশন বের করলে? শবনম তাকে তুমি সম্বোধন করতে আমাকে বলেনি, আমি তবু হঠাৎ তুমি সম্বোধনেই কথা বলতে শুরু করলাম।

শবনম এগিয়ে এসে বলল, সরি, আমি ৭২ ঘণ্টা বলেছিলাম। তারপর ঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে ৭৭ ঘণ্টা হয়ে গেছে। আমি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললাম, সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বেশি- এমন বেশি কিছু নয়। সমস্যার সমাধান খুঁজতে কেউ কেউ তো জীবনও পার করে দিয়েছেন। শবনব বলল, চা ঘরে চলুন।

ব্যাগ থেকে টিফিন বক্স বের করে ঢাকনা খুলে সামনে রেখে। দুটো মাঝারি স্যান্ডউইচ, দু’ভাগ করা সেদ্ধ ডিম, ফালি করা কাটা শসা। বলল, অর্ধেক আপনার, অর্ধেক আমার। হুজুরের লাঞ্চ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়, এর নাম পলিটিক্স। বুঝুন ব্যস্ততা কাকে বলে। প্রধান অতিথি আসার কথা তিনটায়। তাহলে মিটিং শেষ হতো পাঁচটায়। তিনি স্বীকার করেছেন, দুপুরের ঘুমটা তো আর বাদ দেওয়া যায় না, তাহলে প্রেসার ফ্ল্যাকচুয়েট করে। ঘুম শেষ করে হাজির হয়েছে সাড়ে পাঁচটায়। মিটিং শেষ হলো সাতটায়।

ঠিকই শুনেছি, বাম নেতারা একটু বেশিই ঘুমান। পৃথিবীতে যে কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে, তারা টের পাচ্ছেন অনেক পরে। টের পেলেও উড়িয়ে দেন- বলেন পশ্চিমের প্রোপাগান্ডা।

আমিও বামদিকে। নেতা নই, সক্রিয় কর্মীও নই। সমাজতন্ত্রের বাজার যতো খারাপই হোক আমি শোষণহীন সমাজের কথাই ভাবি। শোষণহীন সমাজের পত্তন যে ইহকালেও ঘটবে না, এটাও জানি। শোষণই তো সভ্যতার ভিত্তি। জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ পড়ার পর এটাও বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রের নেতাদের বড় অংশই ‘মোর ইকুয়াল দ্যান দ্য আদার্স’। তারা গাছের খান, তলারও কুড়ান। লেজুড়বৃত্তি করে যতোটা পাওয়া যায় তাও কবুল করে নেন।

শবনম মেহনাজ চিশতি তার স্যান্ডইউইচে কামড় বসিয়ে বলল, আপনি তো দুটো সমস্যার কথাই বলেছেন। আমি এ নিয়ে ভেবেছি এবং একটা মোটামুটি গোছের সমাধানও পেয়ে গেছি।

আমি চোখ তুলে তাকাই। শবনব চা-ঘরের কুক-কাম ওয়েটারকে বলে বেশি করে দুধচিনি দিয়ে দু’কাপ চা।

আমি বেশি দুধচিনি নিই, এটা সত্যি। শবনম বলেছে, বেশি দুধ নিলে চায়ের ফ্লেভার থাকে না। বেস্ট হচ্ছে ব্ল্যাক টি।

শবনম এবার শসাতে কামড় দিয়ে বলল, শুনুন, প্রথমত আবদুল খালেক কোনো সমস্যা নয়। আমি আবদুল শুনে অভ্যস্ত। আমার বাবা আবদুল আলী চিশতি, আমার বড় ভাই আবদুল মইন চিশতি আর আমার সাবেক হাজব্যান্ডের নাম তো জানেনই আবদুল মোবারক আখন্দ। আমি পুলকিত হই এবং বলি সমস্যাটা তোমার ঘাড়ে নিতে কে বলেছে?

শবনম বলল, বাচ্চাটা যদি স্টিলবর্ণ না হতো তাহলে অবন্তীর চেয়ে বছর খানেকের বড় হতো, প্রায় দেড় বছর।

শবনম সম্ভাব্য একটি দীর্ঘশ্বাস ঢাকতে চা-ঘরের দেয়ালে সাঁটা রবীন্দ্র জয়ন্তীর পোস্টারের দিকে তাকায়। চার বছর আগে লাগানো পোস্টার। শবনব এবার খুব স্মার্ট মেয়ের মতো বলল, নাদেরা আপাকে আর টোকা দিতে চাচ্ছি না, কারণ আপনি নিজের ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। আমিই যদি আপনাকে বিয়ে করতে চাই নিজেকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন, সাড়া দেবে কি না? এখনই জবাব দেবার দরকার নেই। দু’নম্বর বিষয়টা আমার কাজেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ- অবন্তী।

তারপর শবনম একাই কথা বলে।

অবন্তীকে কিছুদিনের আমার সাথে মেলামেশা করার সুযোগ দিন। আমি মায়ের মতো ম্যানেজ করতে পারি কি না দেখুন। এক মাসের মধ্যেই বুঝে যাবেন। আমার পারফরম্যান্স আপনার মূল্যায়নে সন্তোষজনক মনে না হলে সরাসরি না বলে দেবেন। আমার ব্যাপারে আপনার কোনো অবলিগেশন থাকবে না। মানে?

এটাকে একটা ফ্রেন্ডলি পাতানো খেলা হিসেবে নেবেন।

আমার কথা বন্ধ হয়ে যায়। শবনম টিফিন বক্সটা তুলে নেয়। দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে চা-ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আমি ফিরি অনুশীলন ঘরে। এটাই নাম- একবেলা এখানে গানের প্র্যাকটিস চলে, একবেলা নাচের। তবলা ও বায়া কাঠের আলমারিতে ঢুকিয়ে টিপ তালা মেরে দিই। এসব বাদ্যযন্ত্রের আবেদন কমে গেছে। কি বোর্ড সংস্কৃতি সেতার তানপুরার মতো বাদ্যযন্ত্রকেও বাতিল করে দিচ্ছে।

[caption id="attachment_181213" align="alignnone" width="700"] ৯০ দশকে রাজধানীর ভূতের গলিতে শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বাসায় শিল্পী রফিকুন নবী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, মোহাম্মদ কিবরিয়া, হাশেম খান এবং সাইফুদ্দিন আহমদ[/caption]

একাডেমির ঠিক বাইরে ফুটপাতের চায়ের দোকানে লম্বা বেঞ্চের এক প্রান্তে বসি। আদা, পুদিনাপাতা, এক টুকরো মরিচ পেষা পেস্ট সাথে চিনি ফুটন্ত পানি আর একটা টি-ব্যাগ- বেশ ঝাঁঝালো এককাপ চা খেয়ে, দু’টাকা দাম শোধ করে বাড়ি ফিরে আসি।

ফেরার সময় অবন্তীর জন্য একটা না একটা কিছু কেনা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমার বাজেট দশ টাকা। পাঁচ টাকা দামের দুটো ললিপপ লজেঞ্চ কিনি।

আমার মেয়ের কাছে ফিরতে দেরি হবার দায়টা বরাবর একজনের উপরই ছেড়ে দেই। কল্পিত বস। বস আমাকে আটকে রেখেছেন, আমাকে দিয়ে বেশি কাজ করিয়েছেন, আমাকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে দেয়নি। আমি আসতে চাইলে বকাবকি করেন।

অবন্তী খুব ক্ষেপে আছে আমার বসের উপর। অবন্তী বলল, আমি বেশি ললিপপ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। মানে? আমি তো পরশু দিনও তোমাকে খেতে দেখেছি। আমি ভেবেছি ললিপপ তোমার খুব প্রিয়।

অবন্তী বলল, বাবা সেটা ঠিক। কিন্তু টিচার বলেছে এসব খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়, ছেলেরা এসব খেলে হয়ে যাবে ফোকরা বুড়ো আর মেয়েরা হবে ফোকরা বুড়ি।

তাই নাকি? টিচার ফোকলা বুড়ির ছবি দেখিয়েছে। বাবা আমি তো মেয়ে, সে জন্য ললিপপ খেলে আমি হবো ফোকলা বুড়ি। কিন্তু আমি যে ফোকলা বুড়ি হতে চাই না। তা হলে তো সমস্যা। এ দুটোর কি হবে? অবন্তী বলল, আমি তো বলেছি বেশি ললিপপ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। দুটো খেলে কোনো সমস্যা নেই। বাঁচালে। ললিপপের পাতলা মোড়ক খুলে, দুটি হাত মুখের কাছে এনে ক্রস করে ডান হাতেরটা বাম গালে এবং বাম হাতেরটা ডান গালে ঢুকিয়ে দু’গাল ফুলিয়ে রাখে। আয়নার সামনে গিয়ে চেহারা দেখে। তারপর কাঠিওয়ালা গোলাকার দ্রব্য দুটো বের করে বলে, আমি দেখতে মোটেও ফোকলা বুড়ির মতো নই। তাই না বাবা? টিক বলেছ। আমি কার মতো বাবা? মিসেস অবন্তীর মতো। অবন্তী হেসে উঠে। জিজ্ঞেস করে, তোমার বস কি আজ তোমাকে বকেছে? কোনো কথা লুকোবে না কিন্তু। আমি বললাম, বস বকে, কিন্তু আজ বকেনি। অবন্তী বলে, তাহলে ভালো। আর একদিনও যদি বকা দেয় তাহলে তুমি আমাকে বলো। তোমাকে বললে কি করবে? যখন করব তখন তোমার বস টের পাবে। আমি অবন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকি।

অবন্তী বলে, বাবা আমি খুব পচা একটা গালি শিখেছি। একটাবার গালিটা প্র্যাকটিস করে মুখস্ত করেছি। তোমার অফিসে গিয়ে বসকে ঐ গালিটা দিয়ে আসবো। এটা পৃথিবীর সবচেয়ে পচা গালি। আমি তোমার অফিসে গিয়ে বসকে বলব, শালার ব্যাটা, তুই একটা পুঙ্গের পুত। আমি বললাম, মানে।

অবন্তী বলল, মানেটানে জানি না বাবা। রানু ফুপু যখন আমাকে নিয়ে চায়ের পাতা, পান আর ডিম কিনতে গেল তখন একটা লোক দোকানদারকে বলল, শালার ব্যাটা, তুই একটা পুঙ্গের পুত। এই কথাটা তিনবার বলেছে, আমি নিজের কানে শুনেছি।

বসের উপর অবন্তীর সঙ্গত রাগের কারণ আমার কিছু কিছু মিথ্যাচার। বাবার মিথ্যে খুব সহজে চেলেমেয়েদের কাছে ধরা পড়ে না। একদিন রাত এগারটায় বাসায় ফিরে দেখি অবন্তী বাবার জন্য বসে আছে। আমি কোলে নিতেই তার ঝাপসা চোখ থেকে ঝরঝর করে কান্না নেমে আসে। চোখ মুছে, অবন্তী বলে, টিচার বলেছেন ছোট বাচ্চাদের সাথে বাবা-মাকে অনেক বেশি সময় কাটাতে হবে।

আমি অবন্তীর সামনে নিজের কান ধরে সরি বলি এবং দোষটা দিয়ে দিই কোনো এক বসকে। বলি, বস বলেছেন আজ দশটার আগে বাড়ি ফিরলে কেউ বেতন পাবে না। বেতন না পেলে কি চলবে? অবন্তী বলে, সেটা অবশ্য ঠিক।

আমি বললাম, কাল তো শুক্রবার। আমি বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত একটানা তোমার সাথে থাকব। অবন্তী আমার গালে একটা চুমু বসিয়ে বলে, বাবা তুমি অনেক ভালো। পাঁচটায় প্রোলেতারিয়েত একাডেমি, ক্লাস শেষে হলে নো টি, নো গোসিপ। সোজা বাসায়। যাবার সময় একটা গ্যাস বেলুন আর কুড়ি টাকার বুন্দিয়া কিনে নিয়ে যাব। মিনি-মিষ্টি বুন্দিয়া অবন্তী একটা একটা করে মুখে দেবে, দশ টাকার বুন্দিয়া শেষ হতে দেড় ঘণ্টা লেগে যাবে।

ন’মাস ধরে আমি আর অবন্তী এক বিছানায় ঘুমাই। তখন সকাল সাড়ে নয় কি দশ হবে। আমরা দু’জনই বিছানায়। দু’জনেই খালি গা। কলিং বেল বাজে। আমার ফুপোতো বোন রানু, আমার মায়ের প্রায় সমবয়সী দরজা খোলে। আদুরে গলার স্বর শোনা যায়, ‘অবন্তী ম্যাডাম কি বাড়ি আছেন?’

নিজের নাম শুনে অবন্তী কান খাড়া করে। অবন্তী বলে আমি এখানে, বাবার পেটের উপর বসে আছি। সুশ্রী মহিলাটি কোথায় অবন্তী, কোন ঘরে বলতে বলতে রানুকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং সোজা আমাদের বেডরুমের খোলা দরজায়। অবন্তী ঘাড় ফিরিয়ে আগন্তুককে বলে, স্টপ। আমার বাবা এখন খালি গায়ে। অবন্তী আমাকে বলে, বাবা মেয়ে মানুষ, তুমি তাড়াতাড়ি শার্ট পরো। আমি ঘাড় উঁচিয়ে ইতঃস্তত কণ্ঠে বলি, শবনম, তুমি! অবন্তী আবার বলে, বাবা তাড়াতাড়ি শার্ট পরো, তোমার সবকিছু দেখে ফেলবে। শবনমও সম্ভবত বিব্রত হয় এবং ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমি দু’হাতে বুকের উপর গুণ চিহ্নের মতো করে নিজের কিছুটা অংশ ঢেকে শার্টের জন্য উঠে দাঁড়াই। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App