সূর্য ওঠার আগে
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০১৯, ০৩:৫৬ পিএম
দুর্বল বললে ভুল হবে, সে হচ্ছে অতীনের ভালোবাসার জায়গা। নাম তার নার্গিস। সহপাঠী তারা। বছরখানেক হলো তারা প্রেমে মজেছে। ক্যাম্পাসের অনেকেই জানে। তবু গোপন করার কী যে অদ্ভুত চেষ্টা। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেয়ে হাস্যকর সেই প্রচেষ্টা! বন্ধুদের মধ্যে কেউ ভালো করে চেপে ধরলে তখন গাঁইগুঁই করে বলে নার্গিসের সোসাল স্ট্যাটাসটা দেখতে হবে না। আফটার অল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে সে। এখনই যদি কথাটা ওর গার্জেনের কানে চল যায়...।
ধানমন্ডি থেকে ফেরার পথে নীলক্ষেতের মোড়ে এসে হাফিজুর জিজ্ঞেস করে,
যুদ্ধ যুদ্ধ করে এত যে নাচছিস তুই, নার্গিসের কী হবে ভেবেছিস?
কী হবে মানে? অতীন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে, তার সঙ্গে আলাপ করেছিস?
ইয়ার্কি হচ্ছে কেমন!
না না, তার একটা মতামত নিবি না তাই হয়! চল, রোকেয়া হয়ে ঘুরে যাই।
রোকেয়ায় গিয়ে কী হবে! পাখি ফুড়–ৎ।
কী বলছিস! কবে হলো ফুড়–ৎ!
এই তো গত পরশু ওর স্বৈরাচারী পিতা এসে খাঁচার দুয়ার খুলে নিয়ে গেল পাখি!
তাই নাকি? তুই তখন কী করলি?
দূর থেকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম।
অমা, সীতা উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়িসনি?
নারে গাধা, তাহলে যে আমাকে দস্যু তস্কর বলে চিহ্নিত করা হতো!
হাফিজুর বেশ জ্ঞানীর মতো মন্তব্য করে,
আজ হোক, কাল হোক, নার্গিসকে পাবার জন্য কিন্তু তোকে দস্যুবৃত্তি করতেই হবে।
হা হা করে হেসে ওঠে অতীন। হাসির লাগাম টেনে বলে,
মাথা খারাপ! স্বাধীন দেশ দস্যুবৃত্তির কোনো প্রয়োজনই হবে না।
তাই নাকি! তখন নার্গিসের বাপ এসে তোর মতো বামুন ঠাকুরের হাতে বুঝি কন্যা সম্প্রদান করবে?
আহা, নার্গিসকে পাবার জন্যই তো আমি যুদ্ধে যাব। স্বাধীন দেশেও এই জঘন্য জাতপাতের ভেদ থাকবে ভেবেছিস!
হাফিজুর এবার তর্কে না গিয়ে মনে মনে হাসে আর ভাবে হায়রে প্রেমার্থ হৃদয়! ভালোবাসার কণ্টকাকীর্ণ পথে কে কবে কুসম ছিটিয়ে দিয়েছ! আর তুমি আছ সেই ভরসায়! হাফিজুরকে নীরব থাকতে দেখে অতীন তার কাঁধে হাত রেখে জানতে চায়,
আচ্ছা বলতো তোদের বাড়ি থেকে কুমারখালি কতদূর?
তা মাইল পঞ্চাশে হবে। কেন, যাবি নাকি নার্গিসদের বাড়ি?
না, এমনিতেই জেনে রাখছি।
শোন অতীন, আমাদের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার পশ্চিম সীমান্তে গাংনী থানায়। তুই বরং শিলাইদহে আয়, রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়ি থেকে নার্গিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবি। ওটা কুমারখালি থানাতেই পড়ে।
একটুখানি ফুঁসে ওঠে অতীন,
নার্গিসের সঙ্গে যোগাযোগের কথা আমি বলেছি!
আহা, রাগ করছিস কেন ভাই! নার্গিসও তো তোকে দেখতে চাইতে পারে!
আচ্ছা সে দেখা যাবে। লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে তাহলে দেখা আমাদের হবেই, এপারে-ওপারে যেখানেই হোক। আমি তোদের বর্ডার হয়ে ইন্ডিয়ায় যাব, এটাই ফাইনাল।
বেশ তো, তুই একা যাবি কেন! যখন প্রয়োজন হবে আমরা সবাই যাব।
এই কথা শুনে বড্ড খুশি হয় অতীন। উচ্ছ¡সিত হয়ে ফরিদপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বলে ওঠে, এইডা হালায় কামের কতা কইছস। ল, তাইলে আম্যু কাল বিহানে বাড়িত যাইগা। সেটাই ভালো, হাফিজুর সমর্থন করে প্রস্তাব চল, একসঙ্গে আরিচা পর্যন্ত তো যাই।
অতীন হঠাৎ যেন বাঁকা সুরে বলে ওঠে,
এদিকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে যত পারে বৈঠক করুক বঙ্গবন্ধু, তাই তো!
হ্যাঁ, তাই। আমাদের কাজ এখন ঢাকায় নয়, গ্রামে। চল, গ্রামে যাই।
চার.
বাড়ি আসার পর আব্বাকে দেখতে না পেয়ে মন খারাপ হয়ে যায় হাফিজুরের।
বাড়ি আসার চেয়ে মায়ের প্রতি সব সন্তানেরই একটু বেশি টান থাকে, ব্যাখ্যার ঊর্ধ্বে সেই টনটনে টান, হাফিজুরের ক্ষেত্রেও সত্যি, কিন্তু এইবার সে জন্মদাতা পিতার প্রতিও বিশেষ রকমের টান অনুভব করেছে। বিশেষ করে ঢাকায় দেখা সেদিনের বিপন্ন বিপর্যস্ত চেহারাটা দুচোখের পর্দা থেকে মোটেই সরাতে পারে না।
শৈশব থেকেই বাবার সঙ্গে দৃশ্যমান তার অতীত এক প্রকার দূরত্ব রচিত হয়ে আছে সন্তানদের। হাফিজুর তিন বোনের পর এসেছে বলে তার অবস্থান একটু অন্য রকম হবারই কথা, কিন্তু বাস্তবে তেমনটি হয়নি। অনতিক্রম্য এক সম্ভ্রমের পাঁচিল পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পাঁচিল টপকানো কখনো হয়ে ওঠেনি। কেবলমাত্র বড় মেয়ে শেফালি দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে বাবার বুকের সব ক’টা দরজা-জানালা খুলে দেয়, তখন এই চেনা মানুষটা কেমন করে যেন বদলে যায়; তারপর শেফালি না থাকলে বদলে যাওয়া মানুষটাও আর থাকে না। ঢাকায় হাফিজুরের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন তার আব্বার আদলের মধ্যে সেই বদলে যাওয়া মানুষটিকে যেন বিশেষভাবে দেখতে পায়। সারাটা চেহারা জুড়ে তার লেপ্টে আছে ক্লান্তি-শ্রান্তি অনিন্দ্রা-দুশ্চিন্তার ধূলিছাপ, তবু চোখ দুটো ভীষণ উজ্জ্বল মাঝ আকাশের তারার মতো। কী যেন সম্মোহনী দ্যুতি ঠিকরে বেরুচ্ছে সে চোখের দৃষ্টি থেকে। সম্মোহনের সেই জাদুকরী জাল ফেটে নিজেকে বের করে আনতে কী পরিমাণ বেগ পেতে হয়েছে, হফিজুর ছাড়া সে কথা কেউ জানে না। বাপরে বাপ, পরদিন তাঁকে আরিচামুখী বাসে তুলে দেয়ার পরও হাফিজুরের পা উঠতে চায় না। তার কেবলই মনে হয় মাথার পেছনদিকেও দুটো চোখ গজিয়ছে আববার, দ্রুতগামী বাস ঢাকা ছেড়ে সামনে ছুটে চললেও তিনি ঠিকই পেছনের চোখ দিয়ে পুত্রের সমস্ত কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছেন; দৃষ্টি তার পড়েই আছে হাফিজুরের মাথার উপরে।
বাড়িতে ঢোকার আগে হাফিজুরের মনে হয়েছে, সদর দরজা পেরিয়েই সে দেখতে পাবে উঠোনের পশ্চিমে বাতাবিনেবুতলায় হাতলভাঙা চেয়ারটায় শরীর হেলিয়ে বসে আছে তার জন্মদাতা শেখ মোঃ মুজিবুর রহমান। দৃষ্টি তাঁর দিগন্তজোড়া বিস্তৃত মনে হতে পারে, আসল তিনি সতর্ক দৃষ্টি ছড়িয়ে রেখেছেন পুত্রের আগমনপথের দিকে। পুত্রের কদমবুসি সম্পন্ন হবার আগইে তনি বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরবেন, চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, তারপর বিলম্বে আসার জন্য মৃদু তিরস্কার করবেন এবং গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দেবেন শেফালির মা, খোকা হাতমুখ ধুয়ে আসুক, তুমি ওকে খেতে দাও; কথাবার্তা পরে হবে।
সব ঠিক আছে, শুধু তিনি নেই বাড়িতে। গিয়েছেন বড় মেয়ের বাড়ি। দিনে দিনে ফিরে আসার কথাই বলে গেছেন, তবে সবাই জানে ফেরা তার হবে না। অন্য দুই মেয়ের শ্বশুরবাড়ি গেলে তার যে কথা সেই কাজ। সূর্য পাটে বসতে না বসতে ঠকই বাড়ি ফিরবেন। কেবল বড় মেয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলেই কথা নড়চড় হয়ে যায়। এটা যে শুধু শেফালি এবং জামাই বাবাজির পীড়াপীড়ির কারণেই ঘটে তাও বলা যাবে না। এর পেছনে আরও একজনের শক্তিশালী হাত ক্রিয়াশীল আছে। তিনি কেদারগঞ্জ ইশকুলের দোয়াজ মাস্টার, মুজিবুর রহমানের শৈশবের বন্ধু। বন্ধুই তো, দু’এক ক্লাস আগে-পরে লেখাপড়া করলে কি বন্ধুত্ব হয় না? দেশ ভাগের আগে তারা একই ইশকুলে পড়তেন। বাড়ি এক গ্রামে নয়, কিন্তু ইশকুল একটাই চাপড়া কিং এডওয়ার্ড মিশন ইশকুল। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সব ধর্মের ছাত্রেরই আনন্দময় বিদ্যাপীঠ। দোয়াজউদ্দীন ছিলেন দুই ক্লাস নিচে। তবু মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে একটুও বাধেনি। দুজনের মাঝখানে অবনীমোহন বসু নামে আরও একজন হৃদয়বান বন্ধু ছিলেন। দেশভাগের পর অবনী বাবুকে সেই এডওয়ার্ড মিশন ইশকুলে রেখে মুসলিম বন্ধুদ্বয় এপারে চলে আসেন, কিন্তু দু’জনের ঠিকানা হয় দুই জায়গায়। দোয়াজউদ্দীন জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করেন, আর মুজিবুর রহমান ভর্তি হন মাদ্রাসা লাইনে। শিক্ষাজীবন শেষে দু’জনেই ইশকুল-শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করায় নতুন করে যোগাযোগের ক্ষেত্র রচিত হয়।
দু’জনের ইশকুলের এবং বসবাসের দূরত্ব প্রায় পঁচিশ মাইল, তবু ছুটিছাটায় পরস্পরের যাওয়া-আসা এবং পুরনো স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে পুরনো বন্ধুত্বে আবারও প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সূত্র ধরে দোয়াজ মাস্টারের ইশকুলের গণি বিএসসির সঙ্গে শেফালির বিয়ে এবং সংসার-যাপন। মুজিবুর রহমান মেয়ের বাড়ি এলে পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা না করে পারেন? কত বিষয়ে তাদের মতের মিল হয় না, তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়, তবু বন্ধুত্বে কোনো আঁচ লাগে না, বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যায় মুজিবুর রহমানের।
এদিন মুজিবুর রহমান বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিলেন।
শেফালি মন খারাপ করেছে, অবশেষে মুখ আঁচল চেপে কান্নাকাটি করেছে, জামাই বাবাজি হাত কচলে অনুনয় অনুরোধ করেছে যথেষ্ট, তবু তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টাননি। মেয়ে জামাইকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন দেশের অবস্থা ভালো না, কখন কী ঘটে বলা মুশকিল; এ সময় রাতে বাড়ি না ফিরলে তোমার মা খুব দুশ্চিন্তা করবে। এসব কোনো যুক্তিতেই শেফালির কান্না থামেনি। অগত্যা মেয়ের মাথায় হাত রেখে তিনি কথা দেন দিন দশেকের মধ্যে আবার আসবেন এবং তখন শেফালিকেও সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাবেন। শেফালির ছেলে পরাগ ঝুল ধরে বসে, সেও যাবে নানুভাইয়ের সঙ্গে। সেই পরাগকেও কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেন হ্যাঁ, যাবিই তো! ক’দিন বাদে মায়ের সঙ্গে যাস। এ আশ্বাসে কাজ হয় না, সে নানুর সঙ্গেই যাবে। তখন নিরুপায় হয়ে তিনি অন্য কৌশল গ্রহণ করেন, আচানক বলে বসেন তোর মামা আসবে যে নানুভাই! মামার সঙ্গে যাবি না?
মামার কথায় কী যে কাজ হয়, পরাগ তার অনড় অবস্থা থেকে সরে আসে, মায়ের মুখের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে। শেফালিও তখন শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করে হাফিজুর কবে আসবে আব্বা?
এ প্রশ্নে মুজিবুর রহমান যেন হঠাৎ চমকে ওঠেন।
অথচ তিনি যে হাফিজুরকে বাড়ি আনার জন্য কয়েকদিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন, বিচিত্র সেই ঢাকা-ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা মেয়ে এবং জামাইয়ের সামনে বিস্তাতরিত বলেছেন। ঢাকা শহরের উত্তাল অবস্থা এবং হাফিজুরের গভীর সম্পৃক্ততার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথাও প্রকাশ করেছেন। কিন্তু হাফিজুর কবে ফিরবে সরাসরি এ প্রশ্নের উদয় হয়নি। এখন এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মনে হয় হাফিজুর আজই ফিরবে। কেন এমন মনে হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যাও জানা নেই, ফলে মেয়ে কিংবা নাতিকে জোর দিয়ে সে কথা বলতেও পারেন না। কিন্তু তার নিজের ভেতরে সেই কথার প্রতিধ্বনি হয়, হাফিজুর আজই বাড়ি ফিরবে, আব্বাকে দেখতে না পেলে তার মন খারাপ করবে; না না, তিনি আজই বাড়ি ফিরবেন।
একেবারে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ান, এখনই চলে যাবেন। শেফালি আবারও জানতে চায়, কবে আসবে হাফিজুর?
হাফিজুর এসে কি বাড়িতে দাঁড়ায়! মুজিবুর রহমান মেয়েকে মনে করিয়ে দেন, সে তো তোর কাছেই চলে আসে!
এবার আসবে তো আব্বা?
আসবে আসবে। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, আসবে না কেন?
না মানে দেশের যা অবস্থা...
অবস্থা আর কী! আগে ঢাকা শহরে মিছিল মিটিং হতো, এখন তো গ্রামে গ্রামে হচ্ছে; সে বাড়ি এসেও তাই করবে।
আচ্ছা, হাফিজুরকে তাহলে পাঠিয়ে দেবেন।
কী মুশকিল! সে কি বাড়ি এসেছে নাকি?
আজ হোক কাল হোক, সে আসবে তো!
হ্যাঁ, আমার পাঠানোর অপেক্ষায় সে থাকলে তো!
এতক্ষণে পরাগও জানতে চায়,
মামা আসবে তো নানুভাই?
সহসা নিজেকে সামলে নেন, এক গাল হাসি ছড়িয়ে বলেন,
আসবে আসবে।
এরপর আর কথা না বাড়িয়ে মুজিবুর রহমান সতি সত্যি সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে বড় মেয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু গেরোটা বাঁধে বাড়ির সামনেই। ইশকুলে গণি বিএসসির কাছে খবর পেয়ে দোয়াজ মাস্টার ছুটে আসেন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি সাইকেলের হ্যান্ডেল চেপে ধরে বলেন,
কী ব্যাপার মুজিবুর, তুমি কি আমার সঙ্গে দেখা না করেই পালিয়ে যাচ্ছ?
মুজিবুর রহমান ইতস্তত করেন,
না না, এই তো সেদিন দেখা হলো তোমার সঙ্গে!
সেদিন মানে, সে তো দু’মাস আগের কথা!
দু’মাস কোথায়! এর মধ্যে তো তামারই কথা ছিল আমার ওখানে যাবার!
হ্যাঁ, যাব তো, নিশ্চয় যাব। কিন্তু তাই বলে তুমি এভাবে চলে যাবে?
আজ আমার বাড়ি ফেরাটা খুব জরুরি ভাই।
দাঁড়াও তোমার বাড়ি যাওয়ার মজা দ্যাখাচ্ছি। তুমি চলো আমার সঙ্গে।
না না, তুমি আর বাগড়া দিয়ো না তো!
নিকটাত্মীয় না হলেও গ্রাম সুবাদে দোয়াজ মাস্টার ফুপ্পা হন আব্দুল গণির। বন্ধুর মেয়ে শেফালি বিয়ের পর হয়েছে বউমা। কিন্তু তিনি প্রায়শ উল্টোধারার সম্মোধন করেন, ডাকেন শাশুড়ি বলে। বন্ধুর একগুঁয়েমি দেখে তিনি হুমকি দেন, শাশুড়ি, তোমার বাপের কিন্তু বিপদ আছ আজ!
মুজিবুর রহমান না না করতেই থাকেন। শেফালি মাথার ঘোমটা একটু টেনে দিয়ে মিটমিট করে হাসে। দোয়াজ মাস্টার তখনো গজরাতে থাকেন,
কই, আব্দুল গণি কোথায়? দ্যাখচ্ছি মজা তোমার বাপের।
শেফালি সামনে এসে বিনম্রভাবে বলে,
আপনারা ভেতরে এসে বসেন। আমি চায়ের পানি চাপাই।
এতক্ষণে মুজিবুর রহমান একটু নরম হন। মেয়েকে বলেন,
দে তাহলে তাড়াতাড়ি দু’কাপ চা দে। চা খেয়েই উঠব।
এই চায়ের ভেতরে কোনো চক্রান্ত ছিল কিনা কে জানে! দু’কাপ শুধু নয়, আরো অনেক কাপ চায়ের জোগান দিতে হয়েছে শেফালিকে। পুরনো দুই বন্ধু প্রথমে গল্পে এবং পরে প্রবল তর্কে জমে ওঠেন। তর্কটা দেশের এই বেহাল অবস্থা এবং ভয়াবহ ভবিষ্যৎ নিয়ে। শুরু হয় সংগ্রাম কিমিট গঠন নিয়ে। ওই যে সাতই মার্চে রেসকোর্স থেকে বলা হয়েছে প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম কমিটি গঠনের কথা, অমনি শুরু হয়ে গেছ ঠেলাঠেলি। কার নাম বাদ দিয়ে কার নাম সামনে দিতে হবে সেই কুৎসিত প্রতিযোগিতা। দোয়াজউদ্দীনের নেতৃত্বে এই দূর সীমান্তেও ১১ মার্চ গঠন করা হয়েছে বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটি। আয়ুব হোসেন, মোমিন চৌধুরী, রুস্তম আলী, পটল, সুশীল, রফিকুল, হজরত, খোকন মণ্ডল, আনারুল এই সব উজ্জ্বল নাম আনন্দের সঙ্গে বলে যান দোয়াজ মাস্টার। মোট ১৩ সদসের কমিটি। কী ভেবে তিনি হুট করে প্রশ্ন করে বসেন,
তোমাদের ওখানে সংগ্রাম কমিটি হয়ে গেছে?
এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর হ্যাঁ অথবা না হতে পারতো, মুজিবুর রহমান উত্তর দিলেন অন্য রকমভাবে,
কমিটি দিয়ে কী হবে? সংগ্রাম করবে কারা দেশের মানুষ, নাকি কমিটির লোক?
না না, সংগ্রাম পরিচালিত হবে কমিটির নেতৃত্বে। সংগ্রাম তো করবে সবাই!
কী যে সংগ্রাম করবে, তাই নিয়ে আমার ভাবনা হয় বুঝেছ?
ভাবনা তো হয়ই, দুর্ভাবনা হয়। কিন্তু তোমার কথা কেমন যেন বেসুরো মনে হচ্ছে।
তা তোমার মনে হতেই পারে। আমি তো ভাই মাদ্রাসা পড়–য়া মওলানা, তোমাদের সুরের সাথে নাও মিলতে পারে।
দোয়াজউদ্দীন একটু উষ্মাভরে বলেন, মানছি বটে তুমি মওলানা-শিক্ষক, তাই বলে আমি কখনো তোমাকে মওলানা বলে ডেকেছি? তোমাকে আমি চিনি না?
আমার ভয় করে দোয়াজ। ঘর পোড়া গরুতো!
মানে?
আন্দোলনের নামে যা কিছু হচ্ছে, এ সবের মানে আবার তো সেই ভাগাভাগি!
আমরা স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত চেয়েছি, ওরা মানেনি। এখন মনে হচ্ছে ভাগাভাগিটাই অনিবার্য। তোমার অসুবিধা কোথায়?
ভারত তো এটাই চেয় পাকিস্তান ভেঙে টুকরো টুকরো হোক। স্বাধীনতার নামে আমরা সবাই সেই ভারতকেই সহযোগিতা করছি না তো!
এতক্ষণে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে দোয়াজউদ্দীনের বুক থেকে। এত চেনা এত জানা বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কেমন অচেনা দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টির গভীরতা বন্ধুকে স্পর্শ করে কিনা বুঝা যায় না। তিনিই আবার প্রশ্ন করেন,
চুপ করে আছ কেন?
না ভাবছি তোমার মাথায় ভারতের ভ‚ত এইভাবে বাসা বেঁধেছে জানতাম না!
তুমিও তো ভারত থেকে তাড়া খেয়ে এপারে এসেছ! (চলবে)