×

মতামত

হিমু: এমন অদ্ভুত, উদ্ভট ও ইন্টারেস্টিং চরিত্র দ্বিতীয়টি কি আছে?

Icon

মোহাই মেনুল নিয়ন

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৪, ০৪:৩৮ পিএম

হিমু: এমন অদ্ভুত, উদ্ভট ও ইন্টারেস্টিং চরিত্র দ্বিতীয়টি কি আছে?

মোহাই মেনুল নিয়ন

জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম জনপ্রিয় একটি চরিত্রের নাম হিমু। হিমু সিরিজের বইয়ের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়! তবে সাহিত্যের মানদণ্ডের বিচারে অবশ্যই হিমু সিরিজের বইগুলো উচ্চমানের কোন রচনা নয়! কিন্তু এরপরও হিমু নিয়ে আসলে কি বলা যায়? শুধু বাংলা নয়, বিশ্বসাহিত্যে হিমুর মতো এমন অদ্ভুত, উদ্ভট ও ইন্টারেস্টিং চরিত্র দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই।

হিমুকে অনেকে পছন্দ করে আবার অনেকেই করেন না। কেউ ভাবে হিমু খুবই বিরক্তিকর এবং অদ্ভুত চরিত্র। তার অদ্ভুত আচরণ, উদ্ভট কর্মকাণ্ড কারো মনে বিরক্তির ভাবের উদয় করে, আবার কেউ তার মতো হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটাহাঁটিও করে। প্রেমিকা রূপার সঙ্গেও হিমুর আলাপচারিতা কিংবা সম্পর্ক অনেকক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক!

হিমু সিরিজের বেশ কিছু বই আমার একাধিকবার পড়া হয়েছে, এখন অবশ্যই সেসব বইয়ের রিভিউয়ে যাচ্ছি না। কেননা, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য বইয়ের রিভিউ নয়! আমার মনে হয় হিমু নামক এই অদ্ভুত চরিত্র দিয়ে লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমাদের দেশের ও সমাজের কিছু নিষিদ্ধ, গোপনীয়, কঠিন সত্য ও বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন।

ঠিক কিভাবে? আসলে হিমু কেন্দ্রিক প্রতিটি লেখনীতে সমসাময়িক ঘটনার একটি চমকপ্রদ বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। একজন ধনী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে একজন ভিক্ষুক, রিক্সাচালক, মাস্তান, সন্ত্রাসী, পবিত্র ও শুদ্ধতম মানুষ, জঘন্যতম মানুষ, ভন্ড সাধু, আস্তিক, নাস্তিক, বেশ্যা সব ধরনের মানুষের দেখা হয়েছে এই হিমুর সঙ্গে। এসব দেখা কেবল সাক্ষাৎ নয়, বরং ভয়ংকর খুনি থেকে শুরু করে শুদ্ধ মানুষের জীবনযাপনের ধরন ও চিন্তা ভাবনা লেখক তুলে এনেছেন এই হিমুর কথোপকথনে। আর হ্যাঁ! এসব কথোপকথন আমার মনে হয় হিমু ছাড়া অন্য কোন চরিত্রের সাথে এত গভীরতা ও সরলতা খুঁজে পাওয়া যেত। আমার মনে হিমুর স্বকীয়তা এখানেই!

নতুন পাঠক কিংবা অনেকদিনের পড়ুয়া পাঠকের যখন মাথায় জট বেঁধে যায়, আপনি খুব সহজেই একটি ঘোরের মধ্যে চলে যাবেন। নিজেকে হিমু ভাবতে অবশ্যই ভালো লাগবে আপনার। লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় তাই এমন অনেককেই তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন।

হিমু চরিত্রের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব এই বইগুলো একেক বয়সের মানুষের কাছে একেকভাবে ধরা দেয়। আগেই বলেছি হিমু সিরিজের বইগুলো আমার একাধিকবার পড়া হয়েছে এবং যতবারই পড়েছি আমি নতুনভাবেই আবিস্কার করেছি হিমু এবং তার পারিপার্শ্বিক সব চরিত্র এবং ঘটনাবলিকে। হিমু বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট চরিত্র না হলেও একজন নব পাঠকের মনের খুব কাছাকাছি চলে যেতে এই চরিত্রটি অনন্য।

প্রথমেই বলেছি আমি এই লেখায় বইয়ের রিভিউ করবো না, কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে দুই একটি বইয়ের কথা না বললে যে আমি হিমুকে বুঝাতে পারবো না। ২০১১ সালে প্রকাশিত ‘হিমুর আছে জল’ বইটির সবচেয়ে রহস্যের জায়গা হয়তো উপন্যাসের শেষটা। কেননা, লেখক যে জায়গায় উপন্যাসটি শেষ করেছেন, সেখানে উপন্যাস শেষ হয় না।

‘লঞ্চ কি আসলেই ডুবেছে? যদি ডুবে গিয়ে থাকে তাহলে হিমুর কী হয়েছে? তৃষ্ণার পরিণতি কী?’ এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বইটির ভূমিকায় একটি লেখা পাওয়া যায়-

‘এই বিষয়গুলো নিয়ে আমরা (প্রকাশক) লেখকের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, হিমু এখন আমার গ্রিপে নেই। সে অনেকটাই পাঠকের সম্পত্তি। উপন্যাসের শেষটা আমি পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে লঞ্চ ডুবিয়ে সবাইকে মেরে ফেলতে পারেন। আবার কেউ ইচ্ছা করলে উদ্ধারকারী জাহাজ আনতে পারেন।’

হিমুর এই উপন্যাসটি পড়ার পর বিশ্বাস করুন আমার অন্য লেখক কিংবা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের শেষটা নিয়ে কখনোই খচখচানি তৈরি হয়নি। বরং মনে হয়েছে একজন পাঠকের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণই তো বলবে গল্পের পরিণতি সে কোনদিকে যাবে! হিমু আমাকে বাধ্য করে গল্পের মোর কিংবা পরিণতি নিয়ে ভিন্ন কিছু ভাবতে!

হিমু সিরিজের আরেকটি চমৎকার বই ‘সে আসে ধীরে’। গল্পে হিমুর মাজেদা খালার বান্ধুবী আসমা তার স্বামীর সাথে থাকেন অস্ট্রেলিয়াতে। সমস্যা হচ্ছে এই দম্পতির কোনো সন্তান হয় না। অনেক রকমের চিকিৎসা করিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এজন্য তারা চান বাংলাদেশ থেকে বাচ্চা দত্তক নিতে। এই দায়িত্ব এসে পড়ে হিমুর উপর। হিমু সঙ্গে সঙ্গেই ইমরুল নামের এক বাচ্চার কথা জানিয়ে দিয়েছে। ইমরুলের মা ফরিদা অনেক অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি। তার চিকিৎসার জন্যে অনেক টাকা লাগবে। হিমুর ইচ্ছে ইমরুলকে আসমার কাছে দত্তক দিবেন। বিনিময়ে টাকা নিয়ে ইমরুলের মায়ের চিকিৎসা করাবে।

গল্পটি প্রচুর হাস্যরসাত্মক বর্ণনায় সম্পন্ন হলেও এই গল্পটি নিয়ে বলার উদ্দেশ্য হলো হিমুর এসব কাণ্ডকারখানা অনেকের কাছে ভাড় মনে হলেও পরিণতিতে হিমুর প্রেমে পড়বে না এমন পাঠক খুব কমই পাওয়া যাবে।

হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে হয়তো হিমুকে আমরা আরও কয়েকটি বইয়ে পেতাম। ব্যাপারটাও বেশ মজাদার হতো। কারণ বাংলাদেশ এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। স্মার্টফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাথে হিমুর সম্পর্কের পরিধি জানার আগ্রহটা তাই অধরাই থেকে গেলো! যার তৃষ্ণা কখনো ফুরাবে না।

তবে হিমু পাঠক সৃষ্টি করেছে, সৃষ্টি করেছে সাহিত্যের আলাদা জগৎ। হিমু ভালো লাগেনি এমন বলা অসংখ্য পাঠক রাতের আঁধারে হিমু সিরিজের বই খুঁজে পড়েছে। রিডিং ব্লক কাটাতেও আমি তুলে নিয়েছি এই হিমু অদ্ভুত, উদ্ভট ও ইন্টারেস্টিং চরিত্রটিকেই!

মোহাই মেনুল নিয়ন: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App