×

মতামত

নারীকে নিজের স্বার্থেই বেরিয়ে আসতে হবে

Icon

কবি মানিক পাল

প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ০৬:১২ পিএম

নারীকে নিজের স্বার্থেই বেরিয়ে আসতে হবে

নারী দিবস নিয়ে মতামত লিখেছেন কবি মানিক পাল

এক কাঠুরে কাঠ কাটতে জঙ্গলে ঢুকে দেখেন একটা হাতি মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। পাশেই তার সদ্যজাত বাচ্চাটি হাত-পা নাড়ছে। দেখতে  দেখতেই হাতিটি মারা গেলো। এ দৃশ্য দেখে কাঠুরের মনে খুব কষ্ট হলো। তিনি বাচ্চাটিকে তার বাড়ি নিয়ে গেলেন এবং তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গাভীর দুধ খাওয়ালেন। দু-চার দিনেই বাচ্চাটি তাজা হয়ে উঠলো। 

এভাবে পরম যত্ন আর ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা হাতির বাচ্চাটিকে এক সময় মাঠে গাভীগুলোর সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হলো। হাতির বাচ্চার জন্য উঠোনের এক কোনে একটা খড়ের ছাওনি দিয়ে ঘর বানানো হলো। সেই ঘরে প্রায় পাঁচ হাত লম্বা একটা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে পাটের চিকন রশি দিয়ে বাচ্চাটিকে বেঁধে রাখা হতো। বাচ্চাটি রোজ মাঠ থেকে এসে এই খুঁটির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। এরপর কাঠুরি তাকে ওই চিকন রশি দিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। 

এভাবেই দিনে দিনে বাচ্চা হাতিটি বড় হতে লাগলো। কিন্তু সে রোজ মাঠ থেকে নিয়ম করে ওই খুঁটির পাশে এসেই দাঁড়াতো এবং সেখানেই তাকে বেঁধে রাখা হতো। যখন সে তার মায়ের মতো বিশাল হাতিতে পরিণত হলো, তখনো সে ওই একই খুঁটিতে এসে দাঁড়াতো এবং সেখানেই তাকে বেঁধে রাখা হতো। 

ছোট বেলায় এই গল্পটি আমার বাবার মুখে শোনা। যার মর্ম কথা হচ্ছে- হাতিটি সেই ছোটবেলা থেকেই বুঝে এসেছে যে, এই খুঁটিতেই তাকে থাকতে হবে। কখনো তার মনে ইচ্ছে জাগেনি সে তার সহজাত হাতিদের মতো করে বনে থাকবে। সে চাইলেই তার শুঁড় দিয়ে খুঁটিটি উপড়ে (ভেঙে) ফেলে পালিয়ে যেতে পারতো, কিন্তু সে তা করেনি। তার মনে কখনো তেমন ভাবনাও আসেনি, কারণ ওই অবস্থাটাই তার নির্ধারিত মনে হয়েছে। তাই এই গণ্ডির বাইরে যাওয়ার চিন্তাও তার মাথায় আসেনি। 

মূলত আপনার মগজে যে ধারণা একবার গেঁথে যায়, তা থেকে বের হওয়া বড় কঠিন। তখন বেরিয়ে আসার চিন্তা আর আসে না, চেষ্টাও আসে না। আমাদের সমাজে কিছু নারী আছেন, যারা ছোটবেলা থেকে দেখেছেন তার মা কিংবা ঠাকুরমা সব সময় সংসারের কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত, এ কর্মই তাদের সব কিছু। সবার মন জুগিয়ে চলা, রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কাজ যেন শুধু  তাদেরই করতে হবে। পরিবারের লক্ষ্মী বৌ হয়ে থাকা, সেবা করাই একজন নারীর কাজ। এর বাইরে স্বনির্ভর হওয়ার ইচ্ছে যেন তাদের থাকতে নেই।

এখানে বলার প্রয়োজন বোধ করছি- বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি সবখানে একজন নারীকে এভাবেই চলার নির্দেশ মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যা মূলত নারীদের পায়ে শেকল (অদৃশ্য) পরিয়ে দেয়ার সমান। অথচ একটি ছেলে সন্তানের জন্য তা দরকার হয় না। তবে প্রতিটি ছেলে সন্তান যদি পারিবারিকভাবে সত্যিকার অর্থে ভদ্র, নৈতিক শিক্ষা পেত, তাহলে নারীর স্বাধীনতায় এতো বাঁধা আসতো না। নারীকে এভাবে শিকলে বাঁধা অবস্থায় থাকতে হতো না।

সমাজের একটি ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে, নারীই সকল নষ্টের মূল কারণ। তাই নারীকে সব ধরনের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত রাখতে হবে। কারণ বেশিরভাগ পরিবারই ছোটবেলা থেকে একজন নারীকে নিয়মের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলে। সেই নিয়মের বলয়ে বেশিরভাগ নারীই নিজেকে আবদ্ধ রাখে। সেখান থেকে অনেকেই বের হতে পারে না বা বের হতে চায় না। যদিও আশার কথা হচ্ছে, এই প্রযুক্তির যুগে নারী সমাজ এখন অনেকটা এগিয়ে, তারা সাহসী হচ্ছে, আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে।

আমার বক্তব্য হলো- প্রতিটি পরিবার তার ছেলে সন্তানের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যতটুকু স্বাধীনতা দেয়, তার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সর্বস্ব খুইয়ে যেভাবে পাশে দাঁড়ায়, একইভাবে তারা যেন কন্যা সন্তানের পাশে দাঁড়ায়। ছেলে কিংবা মেয়ে বিচারে নয়, তাদের যেন সন্তান হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়। সমানভাবে একই নৈতিক শিক্ষা দিয়ে তাদের বড় করা হয়। 

পাশাপাশি অবশ্যই নারীদেরও মেনে নেয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। নিজেকে এগিয়ে নেয়ার আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে যে, আমিও পারি। আর সেটা শুরু হবে পরিবার থেকে, পাঠশালা থেকে, সামাজিকভাবে। তবেই নারীরা সামনের সারিতে এগিয়ে আসতে পারবে। এতে সমাজ, জাতি, একটা দেশের উন্নয়ন হবে। কারণ "বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।"

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App