×

মতামত

ভিউ বাণিজ্যের শেষ কোথায়?

Icon

মোহাই মেনুল নিয়ন

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৪, ০৫:৫৭ পিএম

ভিউ বাণিজ্যের শেষ কোথায়?

ভিউ বাণিজ্য নিয়ে লিখেছেন মোহাই মেনুল নিয়ন

‘নাটক’ শব্দটির সাথে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি কিংবা মিডিয়া পাড়ায় যতটা সখ্যতা ততটা হয়তো বাইরের দেশে নেই। কেননা, আমরা যাকে নাটক বলে সম্বোধন করে থাকি সেটা হয়তো তারা বিবেচনা করে শর্ট ফিল্ম হিসেবে। তবে সাহিত্যের বিস্তর শাখায় নাটকের ব্যাপকতা অনেকটা জুড়েই রয়েছে। এই মুহূর্তে বাংলা সাহিত্যের কিছু কালজয়ী নাটকের নাম মাথায় আসছে।

যেমন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত রক্তকরবী কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। মানুষের অসীম লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্য ও স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক যন্ত্র ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণে পরিণত করেছে এবং এর ফলে তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কীরূপ ধারণ করেছে এরই প্রতিফলন ঘটেছে ‘রক্তকরবী’ নাটকটিতে।

অপরদিকে সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকতে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের গর্বের মুক্তিযুদ্ধকে। যেখানে পায়ের আওয়াজ বলতে মূলত মুক্তিবাহিনীর গ্রামে প্রবেশের যে শব্দ সেটিকেই বুঝানো হয়েছে। নাটকের দারুণ একটি অংশ তুলে না ধরলেই নয়! ‘গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসার খবরে সবাই খুশি হলেও, কেবল একজন খুব অখুশি হয়। তিনি আর কেউ নন, তিনি এই গ্রামের মাতুব্বর ও রাজাকার। মুক্তি বাহিনী আসার এই খবরের গ্রামের মাতব্বর ভয় পায় কারণ সে ছিল পাক হানাদার বাহিনীর দালাল এবং তার চেষ্টা ছিল পাক বাহিনীকে সাহায্য ও খুশি করা। এমনকি সে পাক বাহিনীকে খুশি করতে সে তার নিজের কন্যাকেও পাক দেনাদের কাছে তুলে দেয়। পরে মাতবরের কন্যা পিতার সামনেই আত্মহত্যা করেন । নাটকে অবশ্যই স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি, কিন্তু স্বাধীনতার ইংগিত দেয়া হয়। যেই স্বাধীনতার জন্য বাঙালি বছরের পর বছর অপেক্ষায় থেকেছে।

বলা হতে পারে টেলিভিশন নাটকের প্যাটার্ন আলাদা! কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীনের মতো নাট্যকাররাই তো টেলিভিশনের জন্যই নাটক লিখেছেন, নির্মাণ করেছেন। তখন ‘ভিউ’ বাণিজ্য না থাকলেও দর্শক টিভিতে একটি নাটক দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। গল্পের প্রয়োজনেই টিভির পর্দায় চোখ রেখেছে। অথচ অত্যাধুনিক এই যুগে আমরা যেন আধুনিকতার নামে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিরই ধ্বংস করছি।

সাহিত্যের বিচারে নাটককে বলা হয় জীবনের দর্পণ । মানব জীবনের প্রতিদিনের ঘটনার শৈল্পিক অভিব্যক্তিই প্রকাশ পায় নাটকে। অথচ বিগত কয়েক বছরে নাটকের সেই শৈল্পিক অভিব্যক্তিই যেন অনুপস্থিত! ঈদ উৎসবসহ বিভিন্ন সময়ে টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা নাটক। যদিও উপরোক্ত আলোচনা ও উদাহরণে এগুলোকে বাংলা নাটক বলা ঠিক হচ্ছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ থাকছে আমার।

টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি এবং বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ইউটিউব। তাই নির্মাতারা বাহারি সব নামে চটকদার সব নাটক প্রকাশ করছে। যেসব নাটকের অধিকাংশেরই নেই কোন কাহিনী কিংবা মনে রাখার মতো কোন সংলাপ। অথচ এসব বিষয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনবোধও করেন না এসব নির্মাতারা। সাধারণত একটি লিখিত পাণ্ডুলিপি অনুসরণে অভিনয় করে নাটক পরিবেশিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ইউটিউব চ্যানেলে মুক্তি পাওয়া এসব অধিকাংশ নাটকের নেই কোন পাণ্ডুলিপি।

নাটকের কাহিনী ও সংলাপের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে অভিনয় শিল্পীদের। কেননা, নাটক লেখা হয় অভিনয় করার জন্য। তাই নাটক লেখার আগেই তার অভিনয় করার যোগ্য হতে হয়। কিন্তু কিছু অভিনয়শিল্পীদের অভিনয়ে যেন সেই প্রাণটাই নেই। যেন যন্ত্রের মতো কেবল সংলাপ আওড়ানোর জন্যই তাকে নেয়া হয়েছে! 

টিভি চ্যানেলে নাটক প্রচার হওয়ার ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি অনুসরণ করা হতো পূর্ববর্তী সময়গুলোতে, ইউটিউবে রমরমা ভিউ বাণিজ্যের কারণে এখন সেসবও যেন অনুপস্থিত। নির্মাতা কিংবা  নাট্যকাররাও এখন আর চ্যানেলের তোয়াক্কা করেন না। বরং ইউটিউবে কার নাটকে কতো ভিউ এসবই বেশি বিবেচ্য হয়ে উঠেছে।  

ইউটিউবের ভিউ’র জন্য নির্মিত এসব নাটকের গল্প যেমন উদ্ভট, তেমনি নামগুলোও কুরুচিপূর্ণ। অথচ অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশ্রাব্য গালি প্রয়োগের মাধ্যমে এসব নাটকই নিম্নরুচির একশ্রেণীর দর্শকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অশ্লীলতা কিংবা কুরুচিপূর্ণ সংলাপ নিয়েও এসব ভিউ সর্বস্ব নির্মাতাদের কাছে প্রশ্ন করাটাও যেন প্রশ্নকর্তারই বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কেননা নির্মাতাদের যুক্তি চরিত্রের প্রয়োজনেই নাকি অভিনয়শিল্পীরা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা সংলাপ ব্যবহার করছে। নাটকের নাম নিলে হয়তো এসব মানহীন নাটকের নাম হিসেব করেও শেষ করা যাবে না। ভালো-মন্দের বিচার ভুলে গিয়ে যেখানে আমরা সবাই যেন ট্রেন্ডিং বাণিজ্যকেই প্রাধান্য দিয়ে চলছি বারবার। নেই কারো প্রতি কারো দায়বদ্ধতাও।

স্বাধীনতা মানেই কেবল নিজের মনগড়া যাচ্ছেতাই নয়, স্বাধীনতা মানে সমাজ, সমাজব্যবস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা। নাটকের নামে এসব ভিউ বাণিজ্যের শেষ কোথায় আমরা জানি না। তবে বাংলা ভাষার নাটক দিনের পর দিন ভিউ সর্বস্ব গল্পহীন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি বা কুরুচিপূর্ণ সংলাপ যেন পর্দায় দেখতে না হয় সেটাই কাম্য। বরং অখাদ্য এসব ভিউ বাণিজ্যকে পিছনে ঠেলে সুস্থ ধারার বিনোদন ফিরে আসুক বাংলা নাটকে।

মোহাই মেনুল নিয়ন: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App