×

পুরনো খবর

শিল্পমনা মানুষের সমাগমে মুখর জয়নুল উৎসব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৩:৫৪ পিএম

শিল্পমনা মানুষের সমাগমে মুখর জয়নুল উৎসব

মেলার স্টলগুলোতে প্রদর্শিত বিভিন্ন কারুকার্যখচিত শিল্পপণ্য দেখছেন আগত ক্রেতারা। ছবি: ভোরের কাগজ

শিল্পমনা মানুষের সমাগমে মুখর জয়নুল উৎসব
শিল্পমনা মানুষের সমাগমে মুখর জয়নুল উৎসব
শিল্পমনা মানুষের সমাগমে মুখর জয়নুল উৎসব

পৌষের শীতের সকালের কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্যের রশ্মি পড়েছে চারুকলা প্রাঙ্গনে। সকাল ১০ টা বাজতেই সংস্কৃতি ও কারুশিল্পমনা মানুষের পদচারণা শুরু হয়। শিক্ষার্থীসহ নগরের বিভিন্ন প্রান্ত এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগমন ঘটেছে জয়নুল প্রেমী এবং সংস্কৃতিমনা শত শত ব্যক্তির। শুরু হয়েছে জয়নুল মহোৎসব। উৎসব প্রাঙ্গণে দর্শনার্থীদের কানে ভেসে আসছে বাঁশি ও শঙখের সুমিষ্ট সুর শব্দ। সঙ্গে আছে একতারা, দোতারা এবং খমকের বাজনা। শঙখ এবং বংশীবাদকের সঙ্গে সুর মিলিয়ে যেন চারুকলার বৃক্ষে বৃক্ষে পাখির কলকাকলিতে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী এই জয়নুল উৎসব শুরু হয়। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পকলার পথিকৃৎ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রতিবছর তিনদিন ব্যাপী এই উৎসবের আয়োজন করে থাকে। কিন্ত গতবছর করোনা মহামারীর কারণে উৎসবের আয়োজন করা হয়নি। আগামীকাল শুক্রবার পর্যন্ত উৎসব সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

চারুকলা অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা উৎসবে অংশ নিয়ে নিজেদের তৈরি নানা শিল্পকর্ম ও কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন। শিক্ষকদের নির্দেশনায় জুনিয়র/সিনিয়র শিক্ষার্থী একত্রে কারুকার্যখচিত নানারকম শিল্পকর্ম প্রদশর্নের পাশাপাশি বিক্রি করছে। কাঠের চুরি, ছোট সরা, বড় সরা, মাস্ক, গয়নার বাক্স, গলার মালা/রকেট, ব্যাগ, কাপ, দুলসহ মাটি এবং সিরামিক্সের তৈরি কারুকার্যখচিত নানারকম শিল্পকর্ম শিক্ষার্থীরা নিজ হাতে তৈরি করে বিক্রি করছেন। এসবের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে শিক্ষার্থীদের শিল্পনৈপুণ্য।

শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের পেইন্টিংও প্রদশর্ন ও বিক্রি হচ্ছে এই উৎসবে। শিক্ষার্থীরা বলেন, যেখানে বাইরে থেকে শিক্ষকদের পেইন্টিং কিনতে ৬০/৭০ হাজার টাকা লাগে, সেখানে লাগবে মাত্র ১০/১২ হাজার টাকা।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারুশিল্পীরাও উৎসবে স্টল নিয়েছেন। ঝিনাইদহের শোলা শিল্পী গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, মৌলভীবাজারের শীতলপাটি শিল্পী অজিতকুমার দাস, রাজশাহী থেকে আসা শখের হাঁড়ি শিল্পী সুশান্ত কুমার পাল, কুমিল্লা থেকে মো. মানিক সরকার, কিশোরগঞ্জের মাটির পুতুল শিল্পী সুনীল পাল, যশোরের নকশি কাঁথা শিল্পী মিনা জামান, রাঙামাটির কোমর তাঁতশিল্পী জয়শ্রীধর, নওগাঁ থেকে শোলাশিল্পী তপন মালাকার, বাঁশি শিল্পী রুবেল রিয়াদ, মনিপুরী তাঁতশিল্পী রেহানা পারভীন, টাঙ্গাইলের মাটির পুতুল শিল্পী শোভা রানী পাল, সোনারগাঁওয়ের কাঠের পুতুল শিল্পী বীরেন্দ্র সূত্রধর, নারায়ণঞ্জের পাখা শিল্পী বাসন্তী সূত্রধর, রাজশাহীর মুখোশ সুবোধ কুমার পালসহ অনেক শিল্পী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে স্টলে তাদের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করছেন।

শিক্ষকরা বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে শিল্পীরা এসেছেন তারা আমাদের শিকড়। তাদেরকে ধরে রাখতে না পারলে আমাদের সংস্কৃতি টিকে থাকবে না। তাদের যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা সবকিছুর খেয়াল রাখা হয় যত্ন সহকারে। সংস্কৃতি এবং কারু শিল্পকে রক্ষা করতে এসব শিল্পীদের ধরে রাখা আমাদের কর্তব্য।

রাঙামাটির কোমর তাঁত শিল্পী জয়শ্রী ধর বলেন, আমি প্রায় ৭ বছর ধরে চারুকলার উৎসবে আসছি। এখানে আমার যত ভালোলাগে তত ভালো আর কোথাও লাগেনি। এখানকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিবেশ সব মিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতি। আমাদের থাকা, খাওয়া, স্টল সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেন এখান থেকেই।

ড্রয়িং এন্ড প্রিন্টিং ডিপার্টমেন্ট এর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাবরিনা জেবিন সেঁজুতি বলেন, আমরা ভেবেই নিয়েছিলাম করোনার কারণে এবারো জয়নুল স্যারের উৎসব পালন করতে পারবো না। কিন্তু উৎসব পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত। এখানে বিদেশি মানুষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সিনিয়র ভাই আসে, এটা অবশ্যই অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত। চারুকলায় অন্যান্য উৎসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান হল জয়নুল আবেদিন স্যারের স্মরণে তিনদিন ব্যাপী আয়োজিত এই উৎসব। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কারুশিল্প নিয়ে এখানে অনেক স্টলে আছে। ফলে তাদের নিজ এলাকার সংস্কৃতির ও শিল্পনৈপুণ্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছি। তাদের থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো আমরা চারুকলায় পড়ে হাতে কলমে শিখি। কিন্তু তারা বংশগত অনুশীলনের মাধ্যমে অসাধারণ কারুকার্য তৈরি করে থাকেন।

উৎসবে এসেছিলেন জয়নুল আবেদিনের ছোট ছেলে ময়নুল আবেদিনও। তিনি বলেন, নিজের বাবাকে স্মরণ করে এরকম উৎসব দেখতে পারা খুবই সুখের। আমি প্রায়ই এখানে আসি। আপনারাও আসুন দেখুন এবং উপলব্ধি করুন।

চারুকলা অনুষদের ২৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা মাত্র দুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তি হয়েই আমরা অনুষদে জয়নুল স্যারের এরকম একটা উৎসব পেয়েছি। আমরা নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছি। এবং কিছুদিন পর সরস্বতী পূজাও পাবো। সব মিলিয়ে খুবই আনন্দিত আমরা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হেদায়তুল হাবিব বলেন, তিনদিন ব্যাপী জয়নুল উৎসবে দ্বিতীয় দিনে আমি এসেছি, এই আবহাওয়া এই প্রকৃতিতে রঙ বেরঙের মানুষের আনাগোনায় চারুকলা প্রাঙ্গনে সাজসাজ রব নেমেছে। সাধারণ ঢাকা শহরের বুকে এরকম উৎসব খুবই সীমিত। শিল্পায়নের এ যুগে যেভাবে আমাদের সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে, তার সংরক্ষণের জন্য এই ধরনের উদ্যোগ আরো বেশি বেশি নেওয়া উচিত। যদিও জিনিসের দাম একটু বেশি কিন্তু এই কারুকাজকে দাম দিয়ে মাপা যায় না। ধন্যবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদকে প্রতিবছর জয়নুল উৎসব আয়োজনের জন্য।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App