×

জাতীয়

রেলের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:১১ এএম

রেলের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ
রেলের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ
রেলের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

রবিবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা। ছবি: ভোরের কাগজ

রেলের লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ

* ৬২ শতাংশ অনুমোদনহীন * ৬৯ শতাংশই রক্ষীবিহীন * ২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত ৬৩৬ জনের মৃত্যু

রেলের লেভেল ক্রসিং এখন যেন মৃত্যুফাঁদে পরিনত হয়েছে। ঝরছে প্রাণ, পঙ্গু হচ্ছে শত শত মানুষ। অবৈধ লেভেল ক্রসিং এর অন্যতম কারণ। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেল দুর্ঘটনায় হাজার জন মারা গেলেও তার মধ্যে শুধু লেভেল ক্রসিং এ মৃত্যু হয়েছে ৬৩৬ জনের। তবুও টনক নড়ছে না রেল কতৃপক্ষের, নিয়োগ হয় না গেটম্যানের।

রেলসূত্র জানিয়েছে, সারাদেশে রেল নেটওয়ার্কে সর্বমোট ২ হাজার ৮৫৬ টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। এর মধ্যে মাত্র ২৪২টিতে রেলের স্থায়ী রক্ষী রয়েছে, আর ৮২০টিতে রয়েছে চুক্তিভিত্তিক রেলরক্ষী- যা মাত্র ৩১ শতাংশ। রক্ষীবিহীন ক্রসিং আছে ১ হাজার ৭৯৪ টি অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ ক্রসিংয়ে রক্ষী নেই, আর অনুমোদনহীন ক্রসিং ৬২ শতাংশ। ফলে লেভেল ক্রসিংয়ে প্রায়ই ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। এটা এখন মৃত্যুফাঁদে পরিনত হয়েছে।

রবিবার (৫ সেপ্টেম্বর) মৌলবীবাজার এলাকায় মাইক্রোবাসের সঙ্গে ট্রেনের সংঘর্ষে ৩ জন নিহত ও ৩জন আহত হন, এর কিছুদিন আগে জয়পুরহাট সদরের পুরানাপৈল রেল গেইট এলাকায় বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ৫ জন। গত বছর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার বেতকান্দি এলাকায় অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বর-কনেসহ মাইক্রোবাসের ১১ জন নিহত হন। যশোরের অভয়নগর এলাকায় একটি অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ৫ জনের মৃত্যু হয়। আরো বেশ কয়েকজন আহত হন ।

২০০৫ থেকে ২০২১-এই সাড়ে ১৬ বছরে লেভেল ক্রসিংগুলোয় ৬৩৬ জনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ২১ টি দুর্ঘটনায় ৩৮ জনের অধিক মারা গেছেন এবং শতাধিক মানুষ আহত হন। কিন্তু ক্রসিংগুলোয় দুর্ঘটনা বন্ধে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এতে একদিকে ট্রেন ও অন্যান্য যানবাহনের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে কাঙ্খিত গতিতে চলতে পারছে না ট্রেন। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায় বিগত এক যুগে রেলওয়েতে ১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও লেভেল ক্রসিংগুলো নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ক্রসিং উন্নয়নে গত ৬ বছরে মাত্র ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে রেল নেটওয়ার্কে ২ হাজার ৮৫৬ টি লেভেল ক্রসিং আছে যার মধ্যে ১ হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার গত কয়েক বছরে রেলকে না জানিয়ে বা অনুমোদন না নিয়ে এলজিইডি, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও রেললাইনের ওপর লেভেল ক্রসিং নির্মাণ করে যাচ্ছে। রাজধানীতে রেলপথের প্রতি ১০০ থেকে ২০০ গজ পর পর লেভেল ক্রসিং বানাচ্ছে সিটি করপোরেশন। কিন্তু এসবের জন্য রেলের কাছ থেকে তারা কোনো অনুমোদন নেয়নি। রাজধানী ও এর আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিরই কোনো অনুমোদন নেই, যা রেলওয়ের আইনে নিষিদ্ধ। এ নিয়ে মামলাও করা হয়েছে। কিন্তু অবৈধ ক্রসিং বানানো থামছে না।

রেল সূত্র জানা গেছে- ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত রেলের প্রায় ১ হাজার ১২৭ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। এসব দুর্ঘটনায় হাজার জনেরও অধিক মানুষ মারা গেছে। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলের সবগুলো লেভেল ক্রসিং বৈধ বা অনুমোদিত নয়, সেকারণে সবগুলোতে গেট ম্যান নেই। তিনি বলেন, রেলের বেশ কিছু লেভেল ক্রসিং রেলকে না জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ অর্থাৎ সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভাসহ স্থায়ী মানুষজন নিজেদের প্রয়োজনে বানিয়েছে। তাছাড়া আমাদের কর্মী স্বল্পতা রয়েছে, আবার কিছু গেটে খণ্ডকালীন রক্ষী নিয়োগ করা হয়েছে। দীর্ঘদিন মামলাসহ নানা জটিলতায় কর্মী নিয়োগ বন্ধ থাকার সব গেটে গেইট কিপার নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। আগামীতে ১৩শ’র মতো গেটকিপার নিয়োগ দেয়া প্রক্রিয়াধীন। এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে গেটের সমস্যা মিটে যাবে। তবে অবৈধ ক্রসিং যারা বানিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, রেল লাইনের ওপর ১৪৪ ধারা জারি থাকে। কোন দিক না দেখে হঠাৎ যানবাহন লাইনের ওপর উঠে ট্রেনকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেনের ক্ষতি হয়, যাত্রীরাও দূর্ঘটনায় পড়ে, যা এক ধরনের ক্রাইম বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রেলসূত্র জানায়, অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ শতাধিক মামলা করেছে, যেগুলো এখন বিচারাধীন আছে। পক্ষান্তরে লেভেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে ঠিকই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ ‘সতর্কীকরণ’ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বর্তমানে রেল উন্নয়ন প্রকল্পে বেশী নজর দিচ্ছে। সেকারণে মেনটেননেন্স এবং অপারেশনে আগে যে ধরনের নজরদারী ছিল তা একটু ঢিলে-ঢালা হয়ে যাচ্ছে। সবাই শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের দিকে নজর দিচ্ছে। এখানে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করা প্রয়োজন। তার সাথে অপারেশন সিস্টেম এবং জবাবদিহিতারও অভাব রয়েছে রেলকর্তাদের।

বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, আসলে মানুষ নির্ভরতা কমিয়ে রেলকে প্রযুক্তি নির্ভর হতে হবে। ট্রেন আসার সময় রেলগেটে যদি সাইরেন বা সতর্কীকরণ কোন হুইসেল বাঁজতো, তাহলে গেইট ম্যান যেমন জেগে উঠতো তেমনি বাসটিও থেমে যেত। এটি পৃথিবীর বহু উন্নত দেশে কার্যকর রয়েছে। তবে দ্রুত গেটম্যান নিয়োগের সুপারিশ করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App