×

জাতীয়

জোট-মহাজোটের পরিধি বাড়ানোর চিন্তা আ.লীগে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮:৩৫ এএম

** ১৪ দলের সঙ্গে দূরত্ব কমবে ** আমন্ত্রণ জানানো হবে সমমনাদের ** মহাজোটের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বিএনপির পদক্ষেপ দেখে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি প্রায় দুই বছর। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে তৃণমূলে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক মাঠ নিজেদের অনুকূলে রাখতে ১৪ দলীয় জোটকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি জোটের পরিধি বাড়ানোর বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে। এ নিয়ে হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে দলটি। শীর্ষ নেতারা বলছেন, নির্বাচনে বিএনপি জোটের অবস্থান কী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে জোট-মহাজোট গঠনের প্রক্রিয়া।

জোট-মহাজোটে এখন কারা : আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল আদর্শিক জোট। ২৩ দফার ভিত্তিতে এই জোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), গণফোরাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ও ১১ দলীয় জোট মিলে এই জোট গঠিত হয়। জোট গঠনের পরপরই ১৪ দল থেকে বেরিয়ে যায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ও গণফোরামসহ কয়েকটি ছোট দল। কিন্তু জোটটি ১৪ দল নামেই এখনো সক্রিয় আছে। বর্তমানে জোটে আছে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ (ইনু), জাসদ (আম্বিয়া), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল, গণতান্ত্রিক পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, বাসদ, জাতীয় পার্টি-জেপি (মঞ্জু) ও গণআজাদী লীগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট হলো মহাজোট। ১৪ দলের শরিকদের পাশাপাশি এ জোটে আছে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও বি. চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। জাতীয় পার্টি পরপর ৩টি জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটে থেকে নির্বাচিত হয়ে আসছে। গত দুটি সংসদে প্রধান

বিরোধী দলের আসনে বসে দলটি। আগামী নির্বাচনে বিএনপি জোট অংশ নিলে জাতীয় পার্টিকে ফের মহাজোট থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে হতে পারে। এবার নির্বাচনে এই জোটের পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে পারে আওয়ামী লীগ। এর বাইরে আরো কয়েকটি দলকে মহাজোটে আনা হতে পারে।

চারটি পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার : আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট দুটি ইস্যু নিয়ে মাঠ গরমের পাঁয়তারা করবে বিএনপি। ফেব্রুয়ারিতে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন- যা এরই মধ্যে নতুন করে বলা শুরু করেছেন দলটির নেতারা। আওয়ামী লীগ বিএনপিকে সেই সুযোগ দিতে চায় না। তাই ১৪ দলীয় জোট ঐক্যবদ্ধভাবে বিএনপি-জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে ৪টি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত তিনশ আসনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে মাঠপর্যায়ে নিবিড় জরিপ।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার মাধ্যমে এই জরিপ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। দ্বিতীয়ত নির্বাচনী জোটের পরিধি বাড়ানো ও পরিকল্পনা। বর্তমানে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা থাকলেও নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আরো কাছে টানার ভাবনা রয়েছে। তৃতীয়ত ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গেও সম্পর্কের আরো উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ। নির্বাচনের আগে শরিকদের সঙ্গে থাকা বিদ্যমান মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আরো শক্তিশালী করা। এজন্য জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুকে দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। চতুর্থত বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলসহ ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনা। ভোটের হিসাব-নিকাশ মেলাতে কয়েকটি ইসলামি দলের সঙ্গেও সখ্য বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই এ উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেলে নির্বাচনী জোটের পরিধি বাড়ানো সম্ভব হবে। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি জানান, আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনী জোট-মহাজোটের পরিধি আরো বাড়ানোর উদ্যোগ থাকবে।

ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানো : নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ১০টি ইসলামিক রাজনৈতিক সংগঠন আছে। সেগুলো হলো জাকের পার্টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামি ঐক্যজোট, বাংলাদশ খেলাফত মজলিস, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট এবং খেলাফত মজলিস। এর বাইরে স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলাম আর নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবিদার হেফাজতে ইসলামের একটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে। আর হেফাজত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন। হেফাজতের সঙ্গে নিবন্ধিত বেশ-কয়েকটি ইসলামিক সংগঠনের সংখ্যতা আছে। জামায়াতের বিষয়ে সরকার হার্ডলাইনে। কোনোভাবেই এই দলটিকে নির্বাচনে দেখতে চায় না সরকার। তবে জামায়াত বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে আছে।

গত নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশ নিয়েছেন দলটির নেতারা। আর ২০ দলে থাকা ইসলামি দলগুলো হেফাজতে মিশে সরকারবিরোধী একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহারের প্রচেষ্টা বরাবরেই চালিয়ে আসছে। তবে হেফাজতকে ২০ দলে থাকা ইসলামিক সংগঠনগুলোর কবল থেকে দূরে রাখার কৌশল সবসময় অবলম্বন করে আসছে সরকার। আগামী নির্বাচনে ওইসব দল হেফাজতে মিশে যেন কোনোভাবেই সরকারবিরোধী তৎপরতা চালাতে না পারে, সেদিকে মনিটরিং বাড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ১৪ দলে শুধু তরিকত ফোডারেশন আছে। এর বাইরে থাকা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমানোর বিষয়টি গুরুত্বসহ ভাবছে ক্ষমতাসীন দলটি। দলের গুরুত্বপূর্ণ দুয়েকজন নেতা ছাড়াও সরকারের দুজন মন্ত্রী বিষয়টি দেখভাল করছেন। ইতোমধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা নানা ইস্যু নিয়ে কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে সরকার ও দলের নেতাদের। যদিও এসব ইসলামি দলকে মহাজোটে না নেয়ার পক্ষেই আওয়ামী লীগ।

অন্যদিকে জাকের পার্টি সরাসরি মহাজোটে না থাকলেও, সরকারের সঙ্গে দলটির কোনো মনোমালিন্য নেই। দলটি প্রতি নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকে। আরেকটি ইসলামি সংগঠন চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। তবে এই দুটি সংগঠনের কোনোটিই উগ্রবাদী নয় বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। ফলে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকতে কোনো অসুবিধা দেখছে না দলটি। গত কয়েক বছরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল থেকে বের হয়ে এসেছে ৩টি ইসলামিক দল। সেগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামি ঐক্যজোট আর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস। বর্তমানে খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে বলে জানা গেছে। সরকার এসব ইসলামি দলকে নিজেদের জোটে না টানলেও তারা যেন ক্ষমতাসীন দল ও সরকার বা রাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে এসব দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় আওয়ামী লীগ।

এদিকে ইসলামিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সখ্য বাড়ছে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সনদের স্বীকৃতি দিয়েছে, আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। সারাদেশে পাঁচশোর বেশি মডেল মসজিদ নির্মাণ করেছে। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকেও নিজেদের পক্ষে নিতে চায় ক্ষমতাসীন দলটি।

জোট-মহাজোটে যেসব দল আনা হতে পারে : আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে জোট-মহাজোটের নানা হিসাব-নিকাশ কষছেন নীতি-নির্ধারকরা। বিএনপি জোট নির্বাচনে এলে ১৪ দলের নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নিয়ে অংশ নেবে আওয়ামী লীগ। বিদ্যামান দলগুলোর বাইরে সিপিবি, বাসদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাকের পার্টিকেও এই জোটে আনার চেষ্টা হতে পারে। আর বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে বিকল্প চিন্তা করবে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া প্রসঙ্গে এখন মুখে যত কথাই বলুক না কেন, সময় ঘনিয়ে এলে তারা ঠিকই নির্বাচনে অংশ নেবে। এছাড়া গতবারের মতো এবারো বিজয় নয়, মনোনয়ন বাণিজ্যের জন্য হলেও নির্বাচনের মাঠ ছাড়বে না তারা। তাই বিএনপি জোটকে মোকাবিলায় প্রস্তুতির কথাও ভাবছে দলটি।

নেতারা যা বলছেন : আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এখনো তেমন কিছু ভাবিনি। আরো কয়েক মাস গেলে সবকিছু স্পষ্ট হবে। যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমাদের দুটি জোট বলবৎ আছে। ১৪ দল আদর্শিক জোট আর মহাজোট নির্বাচনী জোট। জোটের পরিধি বাড়বে কিনা, তা নির্ভর করবে দেশের সমসামায়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি আমাদের আছে। নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতার পালাবদলে বিশ্বাসী। আগামী নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ১৪ দলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রয়োজনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মহাজোটকে আরো বিস্তৃত করা হবে।

সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক দল মহাজোটে আসতে চাইলে তাদের সঙ্গে আমাদের নির্বাচনী ঐক্য হতেই পারে। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক বলেন, বাস্তবতার আলোকে জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সময়ের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরিস্থিতি বুঝে আওয়ামী লীগ সঠিক সিদ্ধান্তটিই নেবে। সেক্ষেত্রে জোটের পরিধি বাড়তেও পারে আবার বিদ্যমান জোট নিয়েই নির্বাচন হতে পারে। সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল উদার মনে দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এগিয়ে আসবেন, আওয়ামী লীগ তাদেরই স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, তবে ইতিবাচক মানসিকতা পর্যবেক্ষণ করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের জোটে তেমন কোনো সমস্যা নেই। ছোটোখাট বিষয়ে কিছুটা মতবিভেদ আছে, মতবিরোধ নেই। কারণ লক্ষ্য ও নেতৃত্ব এক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App