×

জাতীয়

যে জীবনে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর শত্রু ক্ষুধা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২১, ০৯:৩৪ এএম

যে জীবনে করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর শত্রু ক্ষুধা

লকডাউনের কারণে কাজ নেই, ঘরে খাবারও নেই, ফুটপাতের খুপরিতে বসে সাহায্যের অপেক্ষা এই ভাসমান পরিবারটির -নূরুজ্জামান শাহাদাত

বাচ্চা কটা জিজ্ঞাসা করতেই চমকে ওঠেন রেণু। কোলের বাচ্চাকে দেখিয়ে বলে, এই তো! পাশে আরো তিনটে বাচ্চা কাড়াকাড়ি করছে একটি বাটি নিয়ে। কী খাচ্ছ? বাসন উঁচিয়ে উত্তর দেয়, মুড়ি। এরা কারা? জিজ্ঞাসা করতেই কেঁদে ফেলেন রেণু। বলেন, ‘সব কটাই আমার ছাও (বাচ্চা)। ঘরে খাওনের কিচ্ছু নাই। পোলাপাইনগুলা কান্দে। যেই বাসায় কাম করতাম হেরাও ঘরে ঢুকবার দেয় না। এই পোলাপানগুলার ল্যাইগা খাওন ক্যামনে জোগাড় করুম চিন্তায় আমার পরানে পানি না নাই’। স্বামী কই জানতে চাইলে রেণু জানায়, কিডনির ব্যারাম আছিল ৬ মাস আগে মইরা গেছে। রাস্তার পাশে পলিথিনের ঘরে স্বামীহারা রেণু বেগমের দেখা মিলল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকা রেণুর মুখে কথা নেই। ফ্যালফ্যাল করে সন্তানদের দিকে তাকিয়ে আছেন। কোথা থেকেকোনো সাহায্য পাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই হুঁশ ফিরল রেণুর। চোখে তখনো জল শুকায়নি। কণ্ঠে রাজ্যের আক্ষেপ নিয়ে বললেন- সাহায্য কে দিব! কাউন্সিলরের কাছে গিয়া কতবার ঘুইরা আইছি, কিছুই দেন নাই। এই অভাবের দিনে সরকার আমাগো কি কিছু দিতে পারে না? রাজধানীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রেণুর মতো এমন হাজারো নিরন্ন মানুষের হাহাকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, এদের সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি। করোনার বিস্তার রোধে ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যবিধি সামাজিক দূরত্ব মানা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, মাস্ক পরার মতো নির্দেশনাগুলো এদের কাছে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। লকডাউন এদের কাছে ‘সুরক্ষা’ নয়, ‘যন্ত্রণা’। রেণুর মতো পেটে ক্ষুধা বয়ে বেড়ানো ভাগ্যাহত মানুষগুলোর কাছে লকডাউন মানেই বিষফোঁড়া। খাবারের খোঁজে দিনরাত আক্ষেপ করতে থাকা মানুষ যেন সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতি আর বৈষম্যকেই দেখিয়ে দিচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে। নগরের হাইকোর্ট এলাকা, রমনা, কমলাপুর, কাওরানবাজার রেলস্টেশন, এজিবি কলোনিসহ রাজধানীজুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বস্তা, পলিথিন দিয়ে ঘর তুলে বাস করা ছিন্নমূল মানুষরা। যেখানে রান্না, খাওয়া সেখানেই দিনের শুরু আর রাত শেষ হয় এদের। স্বাস্থ্যবিধি তো দূরের কথা কারো মুখে মাস্কও নেই। এখন কাজ নেই। তাই খাওয়াও জোটে না। ঘরে খাদ্যের জন্য সন্তানের করুণ চাহনি আর বাইরে পুলিশের লাঠিপেটা। মানুষের কাছে পেটের ক্ষুধাই সবচেয়ে বড় মহামারি। গত বছর করোনা সংকটে সরকার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন, সংস্থা থেকে ত্রাণ দেয়া হলেও এবার আর কেউ খোঁজ নিচ্ছে না এই অন্নহীন মানুষগুলোর। যৌবনকালে সন্তানকে পায়ের উপরে বালিশ পেতে অনাহারি রাক্ষুসে রাজত্বের গল্প শোনাতেন যে মা, সেই ফাতেমা বেগম আজ ভুলতে বসেছেন নিজের সন্তানের নাম। সত্তরোর্ধ্ব ফাতেমা বেগম ভিক্ষা করেন রাজধানীর এজিবি কলোনিতে। কলোনির রাস্তা ঘেঁষে পলিথিন দিয়ে ঘর বানিয়ে সেখানেই বাসা বেঁধেছেন কয়েকজন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ। তিনিও তাদের একজন। মানুষ বের হয় না। তাই ভিক্ষা মেলে না। তবুও রাস্তার ধারে দুচোখে অপেক্ষা নিয়ে বসে থাকেন বৃদ্ধ ফাতেমা। কেউ যদি মায়া করে কিছু দিয়ে যায়। লকডাউনের দিনে কেমন আছেন? জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নিচু তার, কিছুক্ষণ পরে মাথা তুলে ছলছলে চোখে জানালেন, ভিক্ষা নাই, পয়সা নাই, খাওনও নাই। তয় বাতাসের এই অসুখটা চইলা গেলে আবারো প্যাট ভইরা খামু’। কমলাপুর ফুটপাতে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন রিকশাচালক নাসির। স্ত্রী ভাঙ্গাড়ির জিনিসপত্র টোকান। লকডাউনের আগে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় হতো। এখন কাজ বন্ধ। তিন দিন রিকশা নিয়ে বের হয়ে পুলিশের পিটানি খেয়েছেন। লকডাউন আরো বেশ কিছুদিন রয়েছে কি করবেন ভাবছেন জানতে চাইলে, নাসির বলেন, ‘রিকশা লইয়া বাইর হইলে পুলিশ রিকশা উল্টাইয়া ফালাইয়া রাখে। ঘরে খাওন নাই। রোজা রাহি না খাইয়া। ইফতারে চাইয়া-চুইয়া খাই। ভাবতাছি এমনে না খাইয়া আর কয়দিন? পোলাপাইন লইয়া দ্যাশে যামুগা’। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ বস্তি শুমারি ও ভাসমান লোকগণনা তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। ভাসমান খানা রয়েছে পাঁচ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১টি। এরমধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি। পৌরসভা এলাকায় আছে ১ লাখ ৩০ হাজার ১৪৫টি। ৩২ হাজার ৯৬০টি রয়েছে অন্যান্য শহর এলাকায়। পরিসংখ্যানটিতে বলা হয়েছে, ভাসমান খানাগুলোর গড় সদস্য সংখ্যা ৩ দশমিক ৭৫ জন করে। এসব বস্তির বাসিন্দা ও ভাসমান মানুষের অনেকেরই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তবে এ নিয়ে তাদের মাঝে আতংক থাকলেও তার পরিমাণ কম। কোনো পরিস্থিতিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে তারা সেটাও জানেন না। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের এখন পর্যন্ত মোট ১০ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা ৭ লাখ পেরিয়েছে। এরমধ্যে কতজন সচ্ছল বা অসচ্ছল তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। অথচ ঢাকার পথে পথে অসংখ্য ঘরহীন মানুষের বাস যারা রাস্তায় ঘুপচি ঘরে গাদাগাদি করে বাস করেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার উপায় নেই। মাস্ক পরে না। ভাসমান মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে করোনা ভাইরাস আরো ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানীরা। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধিই ভাসমান, ছিন্নমূল মানুষের পক্ষে মানা সম্ভব নয়। করোনা থেকে বাঁচতে যেসব সতর্কতা নেয়া প্রয়োজন, সেগুলো আরো সম্ভব নয়। তবে ভাসমান মানুষের মধ্যে করোনার বিস্তার রুখতে সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। ছিন্নমূল মানুষকে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখতে হবে। জীবাণুনাশক ছিটিয়ে দিয়ে নিরাপদ ঘরে রেখে তাদের খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শ্রমশক্তি ছয় কোটি আট লাখ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (শ্রম আইনের সুবিধা পান এমন) কর্মরত জনশক্তি মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সবচেয়ে বড় অংশ ৮৫ দশমিক এক শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তাদের মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ কোটি দিনমজুর। যাদের শ্রম আইন-২০০৬ প্রদত্ত নিয়োগপত্র, কর্ম ঘণ্টা, ঝুঁকি ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বাড়িভাড়াসহ বেশির ভাগ অধিকারই নিশ্চিত নয়। কাজের ওপর নির্ভর করে তাদের জীবিকার নিশ্চয়তা। করোনা ভাইরাস এসব মানুষের জীবিকায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। ‘লকডাউন’ দীর্ঘায়িত হলে তারা চরম খাদ্য সংকটে পড়বেন বলে সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও শ্রমবিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App