×

জাতীয়

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২১, ১২:০১ এএম

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

ফাইল ছবি

‘এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার যুবক শ্রেণি কাজ না পায়।’ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তুপের পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের বিজয়ী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেই তার দ্বিতীয় স্বপ্ন সোনার বাংলা গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে। দারিদ্র্যের তলাবিহীন ঝুড়ি, বারবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন পিতৃহন্তারক জাতি হারতে হারতেও জেগে ওঠেছে ফিনিক্স পাখির মতো। জাতির পিতার স্বপ্ন, আদর্শ পূঁজি করেই তার উত্তরসূরির নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লড়াই। ইতোমধ্যেই প্রত্যাশিত লক্ষে পৌঁছতে পথ-নকশা তৈরি করেছে পঞ্চাশে পা রাখা উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘রোলমডেল’ বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক দেশ গড়াই আজকের চ্যালেঞ্জ।

এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, দেখতে দেখতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বয়স পঞ্চাশে ঠেকেছে। তবে বঙ্গবন্ধু যে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য আজীবন লড়াই করেছেন, গত ৫০ বছরে দেশে এই বৈষম্য আরো বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর উল্টোপথে যাত্রা করে বাংলাদেশ।

সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ: মহান একাত্তরে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফসল লাল-সবুজের বাংলাদেশ। বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে অস্ত্র হাতে নয়মাস যুদ্ধ করে করে তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এসেছে কাঙ্খিত বিজয়। পঞ্চাশ বছরে দরিদ্রতার তকমা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর ঘটেছে। রূপকল্প ২০৪১ সালে উন্নত দেশের স্বপ্নে বিভোর জাতি। এক দশকে দারিদ্র্য কমেছে ১৫ শতাংশের বেশি। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ আর জিডিপি বেড়েছে ৩০ গুণ। ১৯৭০ সালে এই অঞ্চলের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০২০ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে। ১৯৭২-১৯৭৩ সালের তুলনায় বাজেটের আকার বেড়েছে প্রায় ৭২২ গুণ। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ঘরে ঘরে বিজলি বাতির চমক, শিল্পায়ন, গৃহায়ণ, নগরায়ণ, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ প্রশমনে বদলে গেছে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার লড়াই সংগ্রামের সুবিশাল ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমূখী শিল্পায়ন, পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প, রপ্তানি আয় বাড়াসহ অর্থনৈতিক সূচকে অগ্রগতি, পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রো রেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পে অগ্রগতিতে বদলে গেছে বাংলাদেশের চেহারা।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বের সাফল্যজনক দেশের নাম বাংলাদেশ।

মৌলবাদের আস্ফালন: বাহাত্তরের সংবিধানে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ উন্মুক্ত করে দেন জিয়াউর রহমান। পরে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা হলেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়নি। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় ফুলে-ফেঁপে আরো বড় হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে আঘাত করে তারা প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের ওপরই আঘাত করেছে।

এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি, গবেষক, লেখক শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরের পর ইতিহাস পাল্টে ফেলার চক্রান্তে বন্দি হয় রাষ্ট্র-সমাজ। জিয়া-এরশাদের আমলের ইতিহাসবিকৃতির মহোৎসবের অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব হয়নি। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে। ৫০ বছরেও আমরা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরতে পারিনি। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার শুরু এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হওয়া। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনাই জাতির শপথ হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

যেতে হবে বহুদূর:

বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও কমেনি ধনী-দরিদ্র বৈষম্য। অধরাই থেকে যাচ্ছে গণতন্ত্রের স্বপ্ন। গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু কাঠামোয় প্রাণের স্পন্দন এখনো শুরু হয়নি।

এ ব্যাপারে ঐক্য-ন্যাপের সভাপতি, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, বঙ্গবন্ধু আজীবন মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করেছেন। আজ কৌশলে তাদের সঙ্গে আপোষ চলছে। আমাদের অর্জন অনেক, তবে মূল সুর হারিয়ে গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, রাজনীতি থেকে আদর্শের চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতার ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরে না দিয়ে এখনো পাকিস্তানি ধারায় রয়ে গেছি আমরা। এখনো সাম্প্রদায়িক চিন্তা করছি। গণতন্ত্র এখনো শক্তিশালী হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার ভোরের কাগজকে বলেন, পঁচাত্তরের পরে অসাংবিধানিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই সুশাসন লংঘন করেছে। ন্যায়বিচারকে রক্তাক্ত করেছে। বঙ্গবন্ধু যে রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছেন, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা সেই কাঠামো অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতি জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস ভোরের কাগজকে বলেন, সংস্কৃতি নানা উপাদান চর্চার মাধ্যমে বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। চারুকলা, নাটক, লোকসঙ্গীত, কিছু চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতি অর্জন করেছে। তবে যাত্রা শিল্পে আমরা পিছিয়ে গেছি। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার ব্যর্থতার কারণে পিছিয়ে যাচ্ছে। মৌলবাদের থাবায় আমাদের বিব্রত হতে হয়। পঁচাত্তরের পর উত্থানশীল মৌলবাদীকে শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শক্তির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের অভাবে তারা এখনো শক্তিশালী। এক্ষেত্রে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App