×

জাতীয়

উপেক্ষিত করুণা বেগম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৩৮ এএম

উপেক্ষিত করুণা বেগম
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার অনেক নারীই হয়ে উঠেছিলেন রণংদেহী অসামান্যা। দেশমাতৃকাকে শত্রু মুক্ত করতে মাত্র ১৮ বছর বয়সে অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তেমনি এক দামাল কিশোরী বধূ। বদলা নিতে চেয়েছিলেন রাজাকারদের হাতে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর প্রাণ হারানোর। আর এ লক্ষ্যেই গড়ে তোলেন ৫০ জন প্রশিক্ষিত নারী মুক্তিযোদ্ধার এক স্কোয়াড। অস্ত্র চালানোর পাশাপাশি যারা গ্রেনেডসহ বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারে পারদর্শী ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর এই গ্রুপ লিডার একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন রণাঙ্গনের ৯ নম্বর সেক্টরে। কখনো কুলবধূ, কখনো ভিক্ষুক রূপে গেরিলা আক্রমণের দায়িত্ব ছিল ওই স্কোয়াডের। ছদ্মবেশে গ্রেনেড ও অন্যান্য বিস্ফোরক নিক্ষেপ করে শত্রু ছাউনিকে বিধ্বস্ত করাই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য। দক্ষিণাঞ্চল বরিশালের সদর, কসবা, কাশিমাবাদ, বাটাজোর, নন্দীবাজার, টরকীতে সম্মুখযুদ্ধে (খণ্ডযুদ্ধে) তার বীরত্বগাথা অপরিসীম। নভেম্বরের শেষের দিকে গৌরনদী থানার মাহিলারা নামক স্থানে সেতুসংলগ্ন পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর সময় সম্মুখযুদ্ধে ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন অসম সাহসী এই নারীযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সিএমএইচে দেখতে যান। পরে বঙ্গবন্ধু তাকে চিঠিও লিখেছিলেন। একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবিলা করা সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা করুণা বেগমকেও ভুলে গেছে ইতিহাস। অন্যান্য নারী মুক্তিযোদ্ধার মতোই বিজয়ের পঞ্চাশ বছরেও উপেক্ষিত তিনি। নেই বীরত্বের কোনো স্বীকৃতি। শুধু মুখে মুখে ফেরা মানুষের গল্পগাথায় উচ্চারিত হয় তার গ্রেনেড ছোড়ার কাহিনী। ছদ্মবেশে যুদ্ধ জয়ের দুঃসাহসিকতা। ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের দোয়ারিকা-শিকারপুর ফেরিঘাটের পার্শ্ববর্তী রাকুদিয়া গ্রামের করুণা বেগমের বীরত্বগাথা প্রথম গণমাধ্যমে তুলে আনেন কথাসাহিত্যিক ও গবেষক সেলিনা হোসেন। তার ভাষায়, বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাননি করুণা বেগম। করুণা বেগমের যুদ্ধগাথা : করুণা বেগমের স্বামী শহীদুল হাসানও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করে হায়েনারা। স্বামী হত্যার পর থেমে যাননি করুণা বেগম। বরং প্রতিশোধের স্পৃহায় জ¦লে ওঠেন। শহীদুল শহীদ হওয়ার একমাস পর তিন বছরের শিশুকে মায়ের কাছে রেখে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন করুণা। বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে যোগ দিয়ে স্টেনগান, রাইফেল চালানো এবং যে কোনো ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন তিনি। এরপর কুতুববাহিনীর ৫০ জন নারীযোদ্ধার কমান্ডার নিযুক্ত হন। পাগলি, ভিখারি সেজে ছদ্মবেশে শত্রæশিবিরে অপারেশন চালাতেন তিনি। অসম সাহসিকতার জন্য পাকিস্তানিবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি মাহিলারায় গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। করুণা বেগমের নেতৃত্বে ৫ জন নারী এবং ১০ জন পুরুষের একটি দল ওই ঘাঁটি আক্রমণ করে। পরপর পাঁচটি গ্রেনেড ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করেন দলনেতা করুণা। টানা চার ঘণ্টার যুদ্ধে ১০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। আর পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি এসে করুণা বেগমের ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। ওই সময় প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়ার পর স্বাধীন দেশে সিএমএইচে চিকিৎসা করা হয় তার। পরে ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করতেন। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি মারা যান স্বীকৃতিবিহীন এই যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে করুণা বেগমের অবদান প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে করুণা বেগমদের সাহসিকতা উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। আমরা এ নিয়ে অনেক আন্দোলন করেছি। বর্তমানে সরকার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি দেয়া শুরু করেছে। তবে করুণা বেগমের মতো একজন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এতদিনেও স্বীকৃতি না দেয়ার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অপূর্ব শর্মা ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নারী-পুরুষের সম্মিলিত জনযুদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেও নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার। যুদ্ধ করা, অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড ছোড়াসহ সম্মুখযুদ্ধে নারীদের অবদানকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি কোথাও। নারীরাই তার স্বামী-সন্তানকে যুদ্ধে পাঠিয়ে সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, মুলাদীর করুণা বেগমকে স্বীকৃতি না দেয়া আমাদের মানসিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ। স্বীকৃতি না পেয়েই চলে গেলেন তিনি। বর্তমান সরকারের সময় স্বীকৃতি দেয়া শুরু হয়েছে উল্লেখ করে করুণা বেগমের বীরত্বগাথার স্বীকৃতি দাবি করেন এই গবেষক।      

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App