×

জাতীয়

সেনা কর্মকর্তাকে ‘সালাম না দেয়ায়’ তুলকালাম

Icon

বিবিসি

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৫:০১ পিএম

সেনা কর্মকর্তাকে ‘সালাম না দেয়ায়’ তুলকালাম

রাঙামাটি শহর থেকে ট্রলারে করে জুরাছড়ি যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে।

দেশের পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জুরাছড়িতে একজন সেনা কর্মকর্তাকে সম্মান না দেয়াকে কেন্দ্র করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেছে। এই ঘটনার জের ধরে জুরাছড়ি থানার ওসি ও কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে বেধড়ক পেটানোর অভিযোগ উঠেছে সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে একজন সেনা সদস্যকে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।

সেনা সদস্যকে মারধর করার প্রতিবাদে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের সমন্বয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় এবং তারপর জুরাছরি থানায় হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র প্রতিষ্ঠান আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে রাঙামাটির জুরাছড়িতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

ঘটনার কারণ উদঘাটনের জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশের সমন্বয়ে একটি যৌথ তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আইএসপিআর-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে। তদন্ত শেষে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ঘটনাটি তদন্তাধীন থাকায় উস্কানিমূলক বক্তব্য ও গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সকলকে অনুরোধ করা হল, বলা হয়েছে আইএসপিআর-এর বিবৃতিতে। ঘটনাটি নিয়ে যাদের সাথে কথা বলেছে তাদের কেউ নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি। জুরাছড়ির পাহাড়ি বাসিন্দা বলছেন, তাদের নাম প্রকাশিত হলে সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের দিক থেকে তারা হয়রানির শিকার হতে পারেন। অন্যদিকে, স্থানীয় বাঙালিরাও একই কথা বলছেন। 

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার সূত্রপাত ২৭ অগাস্ট বিকেলের দিকে। সেনাবাহিনীর স্থানীয় জোন কমান্ডার জুরাছড়ি বাজারের পাশ দিয়ে যাবার সময় সেখানে তিনজন পুলিশ সদস্য রাস্তার পাশে চা পান করছিলেন। সে তিনজন পুলিশ সদস্য ছিলেন পাহাড়ি। জোন কমান্ডার এ এলাকা অতিক্রম করার পর তার সঙ্গে থাকা ফিল্ড স্টাফ পুলিশ সদস্যদের জিজ্ঞেস করেন, তারা জোন কমান্ডারকে সম্মান জানিয়ে সালাম দেয়নি কেন? তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, তারা কেন সালাম দেবেন? পুলিশ সদস্যরা তো সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করে না।

একপর্যায়ে সেনা সদস্যের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। সেখানে ঠিক কী হয়েছিল তা নিয়ে দুই রকমের ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সেনা সদস্য আগে একজন পুলিশ সদস্যকে চড় মারেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, সেনা সদস্য চড় মারেনি বরং কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা সেনা সদস্যকে মারধর করেন।

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যরা আবার এসে তিনজন পুলিশ সদস্যকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন বিষয়টি দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, পুলিশ সদস্যদের যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তাদের মারধর করছিল সেনা সদস্যরা। এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা জুরাছড়ি থানার ওসিকেও রাস্তায় আটকে ফেলে বেধড়ক মারপিট করে। আমি ওসি সাহেবকে দেখছি সেনাবাহিনীর চেকপোস্টের পাশে বসে কানতেছে। তার গায়ের জামা ছিঁড়ে গেছে, জামা নেই বললেই চলে। খুব মারধর করছে, কে বলছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

আরেকজন ব্যক্তি জানান, সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য জুরাছড়ি বাজারের আশপাশে বাড়ি ও দোকানে লুকিয়ে ছিল। আমাদের চাকমাদের বাড়িতে এবং গোডাউনে লুকিয়ে রাখা হইছিল কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে, বলছিলেন স্থানীয় একজন বাসিন্দা। রাঙামাটির বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কাছে অভিযোগ করলেন, এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে যাতে কোনো সংবাদ প্রকাশিত না হয় সেজন্য তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। এই চাপ সেনা কর্মকর্তাদের তরফ থেকে এসেছিল বলে তারা অভিযোগ করছেন।

গত ২৭ অগাস্ট রাঙামাটি থেকে পুলিশের একটি বেতার পাঠানো হয় ঢাকার রাজারবাগে পুলিশ লাইন্সে। সেখানে বলা হয়, ২৭ অগাস্ট বিকেল পাঁচটার দিকে জুরাছড়ি থানার তিনজন চাকমা পুলিশ কনস্টেবল থানার পাশে যক্ষ্মা বাজারে চা পান করতে যান। ওখানে আর্মির সিও স্যার উনার পরিবারসহ ছিল। কিন্তু উক্ত কনস্টেবলগণ সালাম না দেয়ায় মারধরের শিকার হয় এবং ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

থানার ওসি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি রাঙামাটির পুলিশ সুপারকে অবহিত করে এবং পুলিশ সুপারের নির্দেশে ওসি সেনা ক্যাম্পে যান। পুলিশের বেতার বার্তায় বলা হয়েছে, ওসি এবং তার সঙ্গে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা সেনা ক্যাম্পের ভেতরে যেতে চাইলে ক্যাম্পের সামনে তাদের আটকে দেয়া হয় এবং সবাইকে মারধর শুরু করে এবং ওখান থেকে তারা পালিয়ে যায়।

সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় জনগণ মিলে থানা এলাকা ঘেরাও করে এবং থানার সামনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পুলিশের বেতার বার্তায় এভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তরফ থেকে রাঙামাটির ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। রাঙামাটি সেনানিবাস থেকে জানানো হয়েছে, বিষয়টি নিয়ে একটি 'কোর্ট অব এনকোয়ারি' চলমান আছে। সেজন্য ব্রিগেড কামান্ডার জন্য বিষয়টিতে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে আইএসপিআরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জুরাছড়ির ঘটনা নিয়ে বুধবার সেনা সদর থেকে যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তার বাইরে আপাতত আর কিছু বলার নেই। রাঙামাটির একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে এমনিতেই পুলিশ তাদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চেষ্টা করছে। তাছাড়া বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ সদস্য এবং কর্মকর্তাদের আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এমন অবস্থায় জুরাইছড়ির ঘটনা আরেকটি পুলিশের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এই ঘটনার স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালীরা পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভে অংশ নেয়া একজন বাঙালি বলছেন, প্রায় পাঁচশর মতো মানুষ সেই বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছিল। তবে এই বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পরস্পর বিরোধী ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়িদের কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেবার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধ্য করেছিল। আমার পরিবারের সদস্যরা বিক্ষোভ মিছিলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। জোর করে মিছিলে নিয়ে গেছে। মাইর খাবার ভয়ে অনেকে মিছিলে গেছে,ব লছিলেন স্থানীয় একজন পাহাড়ি ব্যক্তি।

অন্যদিকে বাঙালিরা বলছেন, সেনাবাহিনী কাউকে বাধ্য করেনি। মানুষ স্বতস্ফূর্ত হয়ে বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভকারীরা থানার গেটের সামনে আধাঘণ্টা মিছিল করে। তখন থানার সামনে সেনা সদস্যদের কড়া পাহারা ছিল। স্থানীয়দের ভাষ্য হচ্ছে, সেনাসদস্যরা থানার সামনে এমনভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন যে ভেতরে কারো প্রবেশ করতে পারা রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল। দেয়াল যেভাবে তৈরি হয় ঠিক সেভাবে সেনাবাহিনী সদস্যরা থানার গেইটের সামনে ছিল, বলছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।

কিন্তু এক পর্যায়ে সেনা সদস্যরা থানার ভেতরে বিক্ষোভকারীদের ঢোকার সুযোগ তৈরি করে দেয় বলে উল্লেখ করছেন মিছিলে অংশ নেয়া একজন পাহাড়ি ব্যক্তি। অন্যদিকে স্থানীয় বাঙালিরা বলছেন, সেনাবাহিনী কাজটি ইচ্ছাকৃত করেনি। পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়েছিল যে তাদের কিছু করার ছিল না। এই ঘটনা ঘটে রাত সাড়ে আটটা থেকে নয়টার মধ্যে।

স্থানীয় একজন বাঙালি ব্যবসায়ী বলেন, পুলিশ সদস্যরা যখন সেনা সদস্যকে মারধর করে তখন সেটি অনেকেই দেখেছে। তিনি বলেন, বাঙালি-পাহাড়ি সবাই মিলে একসাথে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। পুলিশের ওপর অনেক আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল জনগণের। ৫ আগস্ট যখন সারা বাংলাদেশে থানা আক্রমণ হইছিল তখন এখানেও মানুষ চাইছিল থানা আক্রমণ করতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণে পারে নাই। আমরা এখানে যারা বাঙালি থাকি তারা সবাই ক্যাম্পের আন্ডারে থাকি। তারা আমাদের নিরাপত্তা দেয়, বলছিলেন বাঙালি একজন বাসিন্দা। মানুষজন যখন থানায় প্রবেশ করে তখন সেখানে কোনো পুলিশ ছিল না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মিছিলের আওয়াজ শুনে পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যায় বলে স্থানীয়রা বলছেন। পরে থানায় ঢুকে মানুষ ভাঙচুর চালায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

পেশাদার সাংবাদিকতা করেছি, আমি সরকারের সুবিধা নেইনি

রিমান্ড শুনানিতে শ্যামল দত্ত পেশাদার সাংবাদিকতা করেছি, আমি সরকারের সুবিধা নেইনি

১৭ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

১৭ সেপ্টেম্বর: সারাদিন যা যা ঘটলো

শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র কতটা গুরুত্ব বহন করে, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র কতটা গুরুত্ব বহন করে, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

কবির, নূরুল, তৌফিকসহ আরো যারা গ্রেপ্তার হলেন

কবির, নূরুল, তৌফিকসহ আরো যারা গ্রেপ্তার হলেন

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App