বন্যা পরিস্থিতি
জনপদের পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি মানুষের
মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫২
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ল²ীপুরসহ বেশির ভাগ জেলায় বাড়িঘর ও সড়ক থেকে পানি নামছে। তবে পানি কমলেও বর্তমানে চরম দুর্ভোগের শিকার বানভাসিরা। বন্যায় অনেকের কাঁচা ঘর ভেঙে গেছে। পাকা ঘরেও আসবাবপত্রসহ যাবতীয় সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বাড়িঘর বসবাস উপযোগী করার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে তারা। বন্যায় গবাদি পশু, হাস-মুরগি ও মাছের খামার ভেসে যাওয়ায় অনেকের অর্থনৈতিক অবলম্বনও শেষ হয়ে গেছে। কারো কারো দোকানে পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। এ অবর্ণনীয় ক্ষতি কীভাবে পোষাবেন, কীভাবে বছরের পর বছর গড়া বাসস্থানের নানা উপকরণ আবার জোগাড় করবেন, সে দুশ্চিন্তায় পাগলপ্রায় অনেকে।
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ত্রান বিতরণ করা হলেও সমন্বয়হীনতার অভাবে অনেকের কাছেই তা পৌঁছাচ্ছে না। আশ্রয়কেন্দ্র বা প্রধান সড়কের আশপাশের বাসিন্দারা ত্রাণ পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক মানুষই এখনো প্রয়োজনীয় খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছেন না। ফলে খেয়ে-না খেয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন কাটছে তাদের। এছাড়া অনেক এলাকায় এখনো সড়ক যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
নোয়াখালীতে কমতে শুরু করেছে পানি, ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা : টানা বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানিতে ডুবে যাওয়া এলাকায় ধীর গতিতে হলেও পানি কমতে শুরু করেছে। তবে ভয়াবহ এই দুর্ভোগের মধ্যে অনেক এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে, দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে তা খুব ধীর গতিতে কমছে। দিনের শুরু থেকে সূর্যের দেখা পাওয়ায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। জানা যায়, জেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। ফলে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা। জেলায় বেড়েছে ডায়রিয়া ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা।
বেগমগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফুর রহমান বলেন, আমরা ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি করেছি। সবার সমন্বয়ে আমরা কাজ করছি। আমি নিজে কোমর সমান পানি পার হয়ে ঘরে ঘরে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী দিয়ে এসেছি। বন্যার্ত মানুষজনের জন্য সরকারিভাবে এ পর্যন্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে নগদ ৪৫ লাখ টাকা এবং ১২০৭ মেট্রিক টন চাল। সরকারি এ ত্রাণ পর্যাপ্ত নয় স্বীকার করে জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা জেলা প্রশাসন কাজ করছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্গম এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারিভাবে নগদ ৪৫ লাখ টাকা, ১২০৭ টন চাল, ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, ৫ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ৫ লাখ টাকার পশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারি ত্রাণ প্রতিদিনই বরাদ্দ দেয়া এবং বন্যার্তদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে। বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী আনা হলেও তারা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ না করে নিজেদের মতো করে ত্রাণ বিতরণ করে চলে যাচ্ছে। এতে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় ঠিকভাবে হচ্ছে না।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে ফেনী : ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে বন্যাকবলিত এলাকা ফেনী। তবে অনেক এলাকায় খাদ্য ও নিরাপদ পানির সংকট এবং বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় বানভাসি মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, প্লাবিত ফেনী সদরের ৮টি ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম এবং পরশুরাম, ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলার কোথাও কোথাও এখনো পানি রয়েছে। সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় ট্রলি ও ট্রাকে গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে মানুষ। দাগনভূঞা ও সোনাগাজীতে পানি কমলেও কিছু স্থানে মানুষ এখনো পানিবন্দি। এছাড়া সোনাগাজী ও ফেনী সদর উপজেলার কিছু এলাকায়ও পানি রয়েছে। তবে বন্যাকবলিত এলাকার বেশিরভাগ মানুষের ঘরবাড়ি, বসবাসের সব নষ্ট হয়ে গেছে। মাছের ঘের, হাস-মুরগির খামারসহ দোকানপাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, গত দুই সপ্তাহ যাবত ফেনীতে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে দেড় লাখ মানুষকে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বানভাসি মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। দুর্গম এলাকায় হেলিকপ্টারে খাবার দেয়া পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
ল²ীপুর, রায়পুর ও রামগতি : ল²ীপুর জেলায় প্রায় সাত দিন ধরে বন্যার পানিতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে ৭ লক্ষাধিক মানুষ। এতে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে পাওয়া ত্রাণের মাধ্যমে সংকট কিছুটা দূর হচ্ছে। তবে বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগছে বন্যাকবলিত মানুষ। বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের। গতকাল বন্যাকবলিত এ জেলার তিনটি উপজেলা ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ল²ীপুরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
পুরো এলাকায় তিন-চার ফুট পানিতে ডুবে আছে। প্রত্যেকটি টিউবওয়েল এখন পানির নিচে। টিউবওয়েলে চাপ দিলেই ময়লা পানি উঠছে। এতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অনেকেই বাজার থেকে পানি কিনে খাচ্ছেন। আবার ত্রাণের সঙ্গে দেয়া পানিও অপ্রতুল। বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়েও আশপাশের টিউবওয়েল থেকে পানি পান করতে ইচ্ছে করছে না।
ল²ীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলায় উল্লেখযোগ্যভাবে পানি কমেছে। নদীতে ভাটা পড়লেই দ্রুত পানি নিষ্কাশনের জন্য মজুচৌধুরীর হাট এলাকার দুটি স্লুইস গেটের কপাটগুলো খুলে দেয়া হয়। গেটগুলো আমরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছি।
কুমিল্লা, ব্রাহ্মণপাড়া ও নাঙ্গলকোট : গোমতীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ। দেখা দিয়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটেও মানুষ চরম বিপাকে পড়েছে। এ এলাকাগুলোতে নিজস্ব অর্থায়ন ও জনবল দিয়ে খাদ্যা ও চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে স্থানীয় সমাজসেবক ও রাজনীতিকরা। বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের দুর্গম আশ্রয়কেন্দ্র লড়িবাগ প্রাইমারি স্কুলে চিকিৎসাসেবা দেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক তানভীর আহাদ জয় ও ডা. সাবরিনা মনসুর। তারা জানান, বন্যার কারণে অনেকে শ্বাসকষ্ট, কাশি, গলাব্যথা, বুকে ব্যথা, হাঁচিসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, বন্যার পানি কমলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। আমরা দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছি।
এদিকে, বন্যাকবলিত এলাকায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫২ জনে দাঁড়িয়েছে। মৃতের এ সংখ্যা গত বুধবার ছিল ৩১ জন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যায় কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ১৭, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৮, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, ল²ীপুরে ১ ও কক্সবাজার ৩ জন মারা গেছেন। এছাড়া, মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন। বন্যায় ১০ লাখ ৭২ হাজার ৫৭৯ পরিবার পানিবন্দি হয়েছেন। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেয়ার জন্য মোট তিন হাজার ৪০৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট পাঁচ লাখ দুই হাজার ৫০১ জন মানুষ এবং ৩৬ হাজার ৪৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার জন্য মোট ৫৯৫টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে। এছাড়া, দেশের সব জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়।