মেয়র-চেয়ারম্যানরা অপসারিত
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনগুলো সংশোধনের পর সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় নির্বাচিত সব চেয়ারম্যান ও মেয়রদের অপসারণ করেছে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গতকাল সোমবার স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে আলাদা আলাদা প্রজ্ঞাপনে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেয়রদের অপসারণ করা হয়। পাশাপাশি আলাদাভাবে প্রশাসক নিয়োগের প্রজ্ঞাপনও হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর এই পদগুলোর প্রায় সবকটিতে আওয়ামী লীগ নেতারা ছিলেন। তারা ভোটে নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগ আমলে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে প্রশাসনে চলছে ব্যাপক রদবদল। এর আগে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সুনির্দিষ্ট আইনের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় প্রশাসক নিয়োগের বিধান রেখে গত রবিবারই আইনগুলো সংশোধন করা হয়। সংসদ বিলুপ্ত হওয়ায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন হয়। আইন সংশোধনের একদিন পরই গতকাল নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের প্রজ্ঞাপন জারি হয় স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে। এর ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে শীর্ষ পদে দায়িত্বরতরা অপসারিত হওয়ায় সেখানে দলীয় কেউ আর রইল না। তবে সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভায় মেয়র ও চেয়ারম্যানরা অপসারিত হলেও সদস্য ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হয়নি। নতুন সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্থানীয় সরকারে নির্বাচিতদের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। এদের অধিকাংশ আওয়ামী লীগের এবং সরকার পতনের পর দলটির প্রায় সব নেতা আত্মগোপনে রয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের আইনে এই দফায় কোনো সংশোধন আনা হয়নি। ফলে ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন।
১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ, দায়িত্বে বিভাগীয় কমিশনার : ঢাকার দুই সিটিসহ দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গতকাল সোমবার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ শামছুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এতে বলা হয়, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা ১৩-র ক অনুযায়ী ওইসব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নিজ নিজ পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। একই সময় ওই ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রের শূন্য পদে ১২ জন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ও নারায়ণগঞ্জের প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালককে। এছাড়া চট্টগ্রাম,খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ সিটির মেয়র পদে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্ব স্ব বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারদের। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের আইনের ২৫ (ক) এর উপধারা (১) অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাদের প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অবিলম্বে কার্যকর হওয়া এই পদক্ষেপটি নতুন অধ্যাদেশের ১৩ (ক) ধারা প্রয়োগ করে, যা মেয়রদের তাদের পদ থেকে অপসারণের অনুমতি দেয়। দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সিটি করপোরেশনগুলোর জন্য নতুন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়েছে। নিয়োগ পাওয়া প্রশাসকরা হলেন- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ শের আলী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে স্থানীয় সরকার বিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন, খুলনা সিটি করপোরেশনে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, রাজশাহী সিটি করপোরেশনে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার মো. আবুল কালাম আজাদ, সিলেট সিটি করপোরেশনে সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ডা. আনোয়ার হোসেন, বরিশাল সিটি করপোরেশনে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ডা. মো. গোলাম মোস্তফা, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ এইস এম কামরুজ্জামান, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক (বিআরডিএ) (অতিরিক্ত সচিব) মো. জসিম উদ্দিন, রংপুর সিটি করপোরেশনে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. মাহমুদুল হাসান, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে গাজীপুরের বিভাগীয় কমিশনার মো. হাসানুজ্জামান এবং ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক করা হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার ডা. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামকে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে শেখ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আতিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে রেজাউল করিম চৌধুরী, খুলনা সিটি করপোরেশনে তালুকদার আব্দুল খালেক, রাজশাহী সিটি করপোরেশনে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বরিশাল সিটি করপোরেশনে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ, রংপুর সিটি করপোরেশনে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, সিলেট সিটি করপোরেশনে মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে ইকরামুল হক টিটু, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে আরফানুল হক রিফাত, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে জায়েদা খাতুন এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যানকে অপসারণ, দায়িত্বে ইউএনওরা : সারাদেশে ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যানকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। চেয়ারম্যানদের স্থলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করবেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, এতদ্বারা উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর ধারা ১৩(ঘ) প্রয়োগ করে বাংলাদেশের ৪৯৩ উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্ব স্ব পদ হতে অপসারণ করা হলো। এছাড়া প্রজ্ঞাপনে মৃত্যুজনিত কারণে কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়। অপসারণকৃত চেয়ারম্যানদের স্থলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করবেন।
৬১ জেলা পরিষদে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পেলেন যারা : দেশের ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এছাড়া মৃত্যুজনিত কারণে নাটোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। খালি হওয়া ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকার এতদ্বারা ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা-৮২ক প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সব (পার্বত্য ৩টি জেলা ব্যতীত) জেলা পরিষদগুলোতে নি¤œবর্ণিত কর্মকর্তাদের তাদের নামের পাশে বর্ণিত জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগ করলো। আটটি বিভাগীয় জেলায় অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারদের (সার্বিক) জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাকি ৫৩ জেলায় সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরবর্তী সময়ে নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসকরা এ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রচলিত বিধি অনুযায়ী শুধু দায়িত্ব ভাতা প্রাপ্য হবেন। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি প্রাপ্য হবেন না। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
৩৩০ পৌরসভায় প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পেলেন যারা : দেশের ৩৩০ পৌরসভায় প্রশাসক বসিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদের কর্মকর্তাদের এই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। পৃথক প্রজ্ঞাপনে ৩২৩ জন পৌর মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে। পৌরসভায় প্রশাসক নিয়োগের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এতদ্বারা স্থানীয় সরকার ‘(পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা-৪২ক এর উপধারা মোতাবেক পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত নি¤œবর্ণিত কর্মকর্তাদের তাদের নামের পাশে বর্ণিত পৌরসভার প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হলো। নিয়োগকৃত প্রশাসকরা স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর ধারা ৪২(ক) এর উপধারা ৩ মোতাবেক পৌরসভার মেয়রের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবেন। প্রশাসকরা নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করবেন। দায়িত্ব পালনকালীন বিধি মোতাবেক দায়িত্ব ভাতা প্রাপ্য হবেন। এছাড়া অন্য কোনো আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা প্রাপ্য হবেন না। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।
এর আগে গত ১৬ আগস্ট সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে, বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান অধিক্ষেত্রে জনগণকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদান নিশ্চিতকরণ, প্রশাসনিক কার্যক্রম চলমান রাখা ও জরুরি কারণে, সময়ের প্রয়োজনে, জনস্বার্থে ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’, ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ ও ‘উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারির লক্ষ্যে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশগুলোর খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে। তথ্য বিবরণীতে আরো জানানো হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে সরকার জনস্বার্থে কোনো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং কাউন্সিলরকে অপসারণ করতে পারবে। একইভাবে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করতে পারবে। একই সঙ্গে এগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে সরকার। অধ্যাদেশ অনুযায়ী এসব জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।