প্রশ্নফাঁস
পুরোনো পরীক্ষা-নিয়োগ কী বাতিল হবে, আইনে যা আছে
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ১১:১৯ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নতুন নয়। তবে আইন অনুযায়ী, কোনো পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হলে সেটি বাতিল করার নিয়ম নেই। এর আগে বেশ কয়েকবার বাতিল করে পুনরায় তা আয়োজন করা হয়েছে। তবে সেটি করা হয় ‘নীতিগত জায়গা’ থেকে।
সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হওয়ার খবর একটি গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, গত এক যুগে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসসহ (বিসিএস) সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আরো কয়েকটি নিয়োগের প্রশ্নফাঁস হওয়ার দাবি করা হয়েছে। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই বলছেন, যেসব নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে, সেগুলোকে বাতিল করা হোক।
পিএসসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রেলওয়ের সর্বশেষ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি প্রমাণিত হলে সেটি বাতিল করা হবে। তবে আগের পরীক্ষাগুলো নিয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু সদ্য হওয়া পরীক্ষা বাতিল করা গেলেও পুরানো তথা পুরো নিয়োগ কি বাতিল করা সম্ভব? এসব ক্ষেত্রে কোনো ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে? প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের জন্যই বা আইনে কী ধরনের শাস্তির বিধান আছে?
গত ৫ জুলাই বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘উপ-সহকারী প্রকৌশলী’ পদে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। দু’দিন পরে পিএসসি পরিচালিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বিষয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে গণমাধ্যমটি। সেখানে বলা হয়, পিএসসির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সিন্ডিকেট রেলওয়ে’র ওই পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগের প্রশ্নফাঁস করেছে। পরদিন প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসি’র সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে কয়েকটি বিসিএসের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে ২৪তম ও ২৭তম বিসিএস। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ৩৩তম লিখিত পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। বিসিএস ছাড়া অনেক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের খবর বিভিন্ন সময়ে আসতে দেখা যায়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও এসব অভিযোগ থেকে বাদ যায়নি।
গত ৮ জুলাই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করে পিএসসি। এতে বলা হয়, গত ১২ বছরে বিপিএসসিতে অনুষ্ঠিত বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পরীক্ষা সম্পর্কে কোনো মহল থেকে কখনই অভিযোগ বা অনুযোগ ছিল না। ফলে প্রমাণিত হয়, সেসব পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, প্রশ্নফাঁস রোধে প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষায় ন্যূনতম ছয় সেট প্রশ্নপত্র এবং নন-ক্যাডার পরীক্ষায় ন্যূনতম চার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়। কোন সেটে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পূর্বে লটারি করা হয়।
এ প্রসঙ্গে গত ৯ জুলাই আগারগাঁও কর্মকমিশন ভবনে পিএসসি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, প্রশ্নপফাঁস করা ভীষণ কঠিন। কারণ, যে প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন নির্ধারণ ও সাপ্লাই করা হয়, সেখানে প্রশ্নফাঁসের কোনো সুযোগ নেই। তবে এ কার্যক্রমের সঙ্গে যেহেতু অনেকেই জড়িত থাকেন, তাই শতভাগ নিশ্চিতভাবেও বলা যায় না।
তবে প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করলেও এসব অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে পিএসসি। ১৫ কার্যদিবসের প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। যে ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর ব্যাপারে পিএসসি’র বক্তব্য জানার জন্য পিএসসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পিএসসি, উভয় সংস্থাই এ বিষয়ে তদন্ত করছে। তাই তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নতুন কোনো মন্তব্য করবেন না তিনি।
তবে ৯ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, গত ১২ বছর ধরে যেসব পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর ব্যাপারে কতটা কী হবে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, যখন কোনো পরীক্ষা হয়, তখন সেখানে কোনো অনিয়ম হলে আপনাদের (সাংবাদিক) মাধ্যমে হোক বা পরীক্ষার্থীদের মাধ্যমে হোক, বা বিভিন্নভাবে (অভিযোগ) আসে। ১২ বছর আগের পরীক্ষা নিয়ে এতদিন পরে প্রমাণ কীভাবে হবে?
সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান বলেন, নিয়োগ পুরোপুরি বাতিল করলে আরেকটা জটিলতা হবে। ইতোপূর্বে যেসব নিয়োগ হয়েছে, সেগুলো বাতিল করার এখতিয়ার পিএসসি’র নাই। তবে দোষীকে আইনের আওতায় আনা যাবে। যদি পুরোনো সব পরীক্ষা বাতিলও করা হয় তবে তা হাইকোর্টে টিকবে না।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খানও প্রায় একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, যেগুলো অনেক আগে নিয়োগ হয়ে গেছে, সেগুলো বাতিল করার সুযোগ নাই। পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইন ১৯৮০’ থেকে দেখা যায় যে প্রশ্নফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করতে হবে কি না, এ বিষয়ে সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু বলা নেই।
আরো পড়ুন : প্রশ্নফাঁস: ৫০ লাখে বিসিএস পাসের প্যাকেজ
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সেরকম কিছু বলা না থাকলেও এটি জেনারেল কনসিকুয়েন্সেস। যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় ও তা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তো পরীক্ষা বাতিল হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খানও বলেন, আইনে সুর্নির্দিষ্টভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা না হলেও “প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করে দিতে পারবে পিএসসি। সেই ক্ষমতা পিএসসি’র আছে। তবে পিএসসিকে সেটি প্রমাণ করতে হবে।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাঁসের কারণে পরীক্ষা বাতিল করেছিল পিএসসি। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আইনে যা-ই থাক, কিন্তু যদি শোনা যায় যে প্রশ্নফাঁস হয়েছে, তাহলে প্রশাসনিক দিক থেকেই তো সেই পরীক্ষা বাতিল করা উচিৎ।
সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান মনে করেন, আইনে না থাকলেও যেকোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তা বাতিল করতে হবে।
আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, একযোগে পুরো নিয়োগ বাতিল করা সম্ভব না। আগে চিহ্নিত করতে হবে যে কে ফাঁস করলো ও ফাঁসের পরীক্ষায় কে পাশ করল। এটা তদন্ত ছাড়া সম্ভব না। তদন্ত হলেও আইনগত অনেক জটিলতা আছে। এটা কঠিন।
এদিকে এই প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় যার নাম সামনে আসছে, তিনি হলেন সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী। গণমাধ্যমে খবর এসছে যারা প্রশ্ন কিনেছেন, তিনি তার স্বীকারোক্তিতে সেই নামগুলো বলে দিচ্ছেন।
আবেদ আলী’র স্বীকারোক্তি ব্যাপারে খুরশীদ আলম খান বলেন, সেটি যাচাই করতে হবে যে তিনি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন কি না বা সঠিক বলছেন কি না। তার স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে মন্তব্য করা যাবে না।
এদিকে মো. শহীদ খান বলেন, ১০-১৫ বছর আগের পরীক্ষা বাতিলের কোনো সুযোগ এখন নাই। রিক্রুট্মেন্ট হয়ে গেছে। সেক্ষেত্রে পরিপূর্ণ তদন্ত করে বের করতে হবে যে বেনিফিশিয়ারি কারা। তিনি মনে করেন, যারা বেনিফিশিয়ারি, অর্থাৎ যারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ নিয়েছেন এবং প্রশ্ন কিনে উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়েছেন, তাদেরকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করতে হবে এবং তারা যাতে অন্য কোনো সরকারি চাকরির জন্যও বিবেচিত না হয়, সেটি নিশ্চিত করা উচিৎ।
আরো পড়ুন : প্রশ্নফাঁস: ৬ জনের রিমান্ড আবেদন
১৯৮০ সালের পাবলিক পরীক্ষা আইনে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে প্রশ্নপত্রের প্রকাশনা ও বিতরণ সম্বন্ধে উল্লেখ আছে যে কেউ যদি পরীক্ষার আগে কোনো উপায়ে প্রশ্নফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণ করেন, তাহলে তিনি চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। তবে এই আইনে সাজা কম হলেও দুদকের আইনে প্রশ্নফাঁসের সাজা সাত বছর।
এক্ষেত্রে সংবাদ সম্মেলনে পিএসসি চেয়ারম্যান বলেন, এর আগে যারা প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত ছিল, তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে বরখাস্ত করেছে পিএসসি। কিন্তু বরখাস্ত হওয়ার পর তারা আবার কোর্টের অর্ডারে ছাড়া পেয়ে গেছে।
এ বিষয়ে সাবেক শিক্ষাসচিব মো. শহীদ খান বলেন, এটি বাংলাদেশের কমন চিত্র। কোর্টে গেলে কেউ হুমকি দেয়, স্বাক্ষী পাওয়া যায় না। তখন কোর্টের অর্ডারে এরা ফিরে আসে। তাই এদেরকে কেউ ঘাঁটায় না।
আইনের এদিকটা আরো কঠোর হওয়া দরকার বলে মনে করেন আবু আলম মো. শহীদ খান। তিনি বলেন, এটি আমাদের রাষ্ট্রের একটি দুর্বলতা। লঘু দণ্ড দিলে শাস্তির মেয়াদ শেষে তার পদায়ন ও পদবি বিবেচনায় চলে আসে। লঘুদণ্ড দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।