যেভাবে জল্লাদ শাহজাহানের উত্থান
কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪, ০৭:২১ পিএম
১৯৮৯ সালে সহযোগী হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন শাহজাহান। ছবি: সংগৃহীত
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিসহ ৪০ জনের ফাঁসির দড়ি টানা আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান মারা গেছেন। সোমবার (২৪ জুন) রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
জল্লাদ শাহজাহানের বোন ফিরোজা বেগম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার অদূরে হেমায়েতপুরে থাকতেন আমার ভাই। রোববার (২৩ জুন) রাতে তার বুকে ব্যাথা উঠে। পরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।
ফিরোজা বেগম বলেন, এদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আমার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। হাসপাতালে তার মরদেহ গ্রহণ করেছি আমি। আইনি প্রক্রিয়া শেষে শাহজাহানের মরদেহ নরসিংদির পলাশ উপজেলার ইছাখালী গ্রামে দাফন করা হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন (৪৪ বছর) কারাভোগ শেষে ২০২৩ সালের ১৮ জুন মুক্তি পান প্রধান জল্লাদ মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জন্মগ্রহণ করলেও জীবনের বেশিরভাগ সময় পরাধীন জীবনযাপন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ ঘাতক, ৬ জন যুদ্ধাপরাধী, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানী, শারমীন রীমা হত্যার আসামি খুকু মনির, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ বাংলাদেশের আলোচিত প্রায় ৪০ জনের ফাঁসি দিয়েছেন শাহজাহান।
১৯৭৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৩৬টি মামলায় তার ১৪৩ বছরের সাঁজা হয়। পরে ৮৭ বছর মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য জেল দেয়া হয়। ফাঁসি কার্যকর ও সশ্রম কারাদণ্ডের সুবিধার কারণে সেই সাজা ৪৩ বছরে নেমে আসে। দুটি মামলায় ৫০০০ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে ৬ মাস করে অতিরিক্ত এক বছর জেল খেটে ৪৪ বছর পর মুক্ত আকাশে শ্বাস ফেলার সুযোগ পান তিনি।
১৯৮৯ সালে সহযোগী হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন শাহজাহান। এরপর কারাগারে মৃত্যুদণ্ড বাস্তবায়নের সময় আসলেই তার ডাক পড়ে। টানা আট বছর এই কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন।
২০২১ সালের ১৭ জুন রাত ১১টায় সিলেটের নতুন কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথমবারের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সিরাজুল ইসলাম সিরাজ (৫৫) নামের একজনের ফাঁসি কার্যকর করেন শাহজাহান। আর মুক্তি পাওয়ার আগে সর্বশেষ ফাঁসি কার্যকর করেন ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি। ওই দিন রাত ১০টায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাই-সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-৪ এ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি বগুড়ার মালতিনগর নামাপাড়া এলাকার মোজাম ফকিরের ছেলে সাইফুল ইসলাম রফিকের (৫০) ফাঁসি কার্যকর করেন তিনি।
জল্লাদ শাহজাহানের পরিচয়
পুরো নাম মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। তিন বোন এক ভাই। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মাতা সব মেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম খাস হাওলা ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছেন পারলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। সর্বশেষ উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করেন নরসিংদী সরকারি কলেজে। ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন জল্লাদ শাহজাহান। ১৯৭৪ সালে এইচএসসি পাস করেন তিনি। তার জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার হচ্ছে- ২৬৯১৬৪৯১০৬১২৯।
সেনাবাহিনীতে ছিলেন তিন বছর
ছোট থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড শাহজাহানকে খুব আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো। তাই মনেপ্রাণে সবসময় স্বপ্ন দেখতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার মাধ্যমে তিনি একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে টিকে যান। যথাসাধ্য তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বড় অফিসারদের ধমকের কারণে জিদ করে বাড়ি চলে আসেন।
শাহজাহান বলেন, অফিসারদের কমান্ড আমার ভালো লাগতো না। কারণ আমি তাদের থেকে পড়াশোনা এবং পারিবারিক দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিলাম। চাকরি করবেন না বলে ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তার সেনাবাহিনীতে চাকরি করার স্বপ্নের কবর এখানেই রচিত হয়।
নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ
স্বাধীনতার যুদ্ধ জয়ের চার বছর পর তখন তরতাজা তরুণ শাহজাহান। এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেন দুই বছর আগে। মনের অজান্তে ভালো লেগে যায় কমিউনিস্ট পার্টি। সেখানে নাম লেখিয়ে ফেলেন। তার পারফরমেন্স দেখে কেন্দ্রে থেকে ডেকে পাঠানো হয়। তাকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে রাজি হন। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
অপরাধ জগতে প্রবেশের ইতিবৃত্ত
ছেলে হিসেবে শাহজাহান খুবই ভালো ছেলে ছিলেন। পারতপক্ষে কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। প্রচণ্ড বন্ধু পাগল মানুষ ছিলেন। একবার গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসানো হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণিত করে সাজা দেয়া হয়।
এরপর থেকেই শাহজাহানের ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। তারপর অনেক লম্বা ইতিহাস।
যেভাবে আটক হন
নারীঘটিত ওই ঘটনার পরে বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান শাহজাহান। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিনকে দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেন ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায়। এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন।
সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন শাহজাহান। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে তার দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেক পোস্ট বসালে ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গুলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি।
এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন পথিমধ্যে পুলিশ শাহজাহানকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি। এরপর থেকে বন্দী জীবন শুরু।
৩৬টি মামলা ১৪৩ বছরের জেল
১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে শাহজাহানের নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ১টি অস্ত্র, ১টি ডাকাতি এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ৮৭ বছর মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য জেল দেয়া হয়।
শাহজাহানের কারাগার থেকে বের হওয়ার তারিখ জেল কার্ডের ওপর লেখা ছিল ‘ডেইট অব রিলিজ ২০৩৫’। তবে ফাঁসি কার্যকর, সশ্রম কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে রেয়াদ পেয়ে ৪৪ বছরের মাথায় তার ডেইট অব রিলিজ হয় ১৮ জুন ২৩২৩।
জল্লাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ
জীবনের সোনালী সময়গুলো কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে চিন্তা করলেন জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে সাজা কিছু দিনের জন্য হলেও কম হবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন শাহজাহান। প্রথম ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেয়া।
শাহজাহানের যোগ্যতা দেখে ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করেন। পরে আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। তিনি জানান, একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ৬ জন সহযোগী লাগে। ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ হয়। এছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন তিনি।
শাহজাহানের দেয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ফাঁসি
২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত আলোচিত প্রায় ৪০টি ফাঁসি কার্যকর করেন শাহজাহান। বাংলাদেশের ইতিহাসে যা সবচেয়ে বেশি ফাঁসি দেয়ার রেকর্ড। তার দেয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ফাঁসিগুলো হচ্ছে- ১৯৯৩ সালের জুলাইয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি খুকু মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর এবং ৯ ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী, ২০২০ সালের ৫ মে (কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম ও একমাত্র ফাঁসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদসহ প্রায় ৪০ জন।
শাহজাহান যখন কাউকে ফাঁসি দেন তখন পত্র-পত্রিকায় তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। তিনি যথাসম্ভব কারাগারে বসেই ওই সব পত্রিকাগুলোর কপি সংগ্রহ করেন। নিয়মিতভাবে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা পড়েন বলে তার সংগ্রহে যুগান্তরের কাটিং সবচেয়ে বেশি।
পরিবারের সঙ্গে শাহজাহানের সম্পর্ক
শাহজাহান বাম রাজনীতি করতেন বলে তার বাবা তাকে খারাপ চোখে দেখতেন। জীবনের সোনালী মুহূর্তে যখন তিনি কারাগারে প্রবেশ করেন, তারপর থেকে বাবার সঙ্গে আর কোনো দিন যোগাযোগ হয়নি। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় নিয়মিত দেখতে আসলেও বাবা কোনো দিন জেল গেটে আসেনি। এমনকি বাবার মৃত্যুর ২ মাস পর খবর পান আর বেঁচে নেই। জীবিত আছেন তিন বোন। তারা থাকেন বাবার রেখে যাওয়া ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের ১১২ নাম্বার বাড়িতে।
এখানে শাহজাহানদের ৬ কাঠা জমি আছে। তিনি অভিযোগ করেন, সব জমি বোনেরা নিয়ে নিয়েছে। এই বোনেরাও তাকে ২০/২৫ বছর আগে একবার দেখতে এসেছিলেন। তারপর আর কোনো খবর নেই। তিনি জানান, সর্বশেষ ২০১০ সালে একদিন তার বোনের ছেলে দেখতে এসেছিলেন। পরে তারাও আর খবর নেয়নি।
বাংলাদেশের জল্লাদ ও ফাঁসির পরিসংখ্যান
অভিযুক্ত কয়েদীদের মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে যেসব দেশে কার্যকর করা হয়, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালে এদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর থেকে ৪ শতাধিক মানুষকে এদেশে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীর সংখ্যা ২ হাজার ১৬২ জন। যার মধ্যে পুরুষ রয়েছেন ২ হাজার ৯৯ জন। এছাড়া নারী রয়েছেন ৬৩ জন।
কেন্দ্রীয় কারাগার ছাড়া দেশের আরও ১৪টি কারাগারে ফাঁসির মঞ্চ আছে। ফাঁসি দেয়ার জন্য জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে ম্যানিলা থেকে ১০ হাজার রশি আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। এরপর আর আনা হয়নি। ওই রশি দিয়েই মূলত সবাইকে ফাঁসি দেয়া হয়।
কারা অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে কারাগারের সংখ্যা ৬৮। এর মধ্যে ৫৫টি জেলা কারাগার এবং ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার। গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এসব কারাগারে বন্দির সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৬০। এর মধ্যে হাজতি বা বিচারাধীন বন্দি ৬৫ হাজার ৩৯২ জন, যা মোট বন্দির ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া বিচারের পর সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৪৬৮। বিচারাধীন বন্দির সংখ্যায় এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে আর বিশ্বে পঞ্চম অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। ফাঁসি দেয়ার জন্য বাংলাদেশে কয়েক ডজন জল্লাদ আছেন।
এর মধ্যে প্রসিদ্ধ (যারা ন্যূনতম পাঁচজন আসামিকে ফাঁসি দিয়েছেন) জল্লাদরা হচ্ছেন- নরসিংদীর শাহজাহান ভূঁইয়া, ঢাকার কামরাঙ্গীর চরের ছেলে তানভীর হাসান রাজু (২০২১ সালে মুক্তি পেয়েছেন), গাজীপুরের হাফিজ উদ্দিন, কক্সবাজারের বাবুল মিয়া (২০১১ সালে মুক্তি পেয়েছেন), সাভারের কালু মিয়া, গোপালগঞ্জের শেখ মো. কামরুজ্জামান ফারুক ও শেখ সানোয়ার, ফরিদপুরের আবুল, জয়নাল বেপারী এবং মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকার মোহাম্মদ মাসুম, মনির হোসেন ও নেত্রকোনার মোহাম্মদ বাবুল।
জল্লাদ শাহজাহানের কিছু অভিযোগ ও অনুরোধ
২০১২ সালে শাহজাহান বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিলেন, আমি তাদেরকে ফাঁসি দিয়েছি। আমি আশা করেছিলাম শেখের মেয়ে এখন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আমার দিকে একটু সুনজর দেবেন। কিন্তু আমার কথা কেউ বিবেচনা করলো না। এখন আমার অপরাধ করার ইচ্ছা বা ক্ষমতা কোনটায় নেই। আমাকে তিন দশকের অধিক সময় ধরে কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, যা সুস্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। মানবিক দিক বিবেচনা করলে একটি মানুষ জীবনের শেষ বয়সে এসে আশার আলো দেখতে পারেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো যেন সামান্যতম সহানুভূতি দেখান সে ব্যাপারে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন।
২০২১ সালে শাহজাহান বলেন, আমি কারাগার থেকে মুক্ত হলে কোথায় যাবো? আমার বাড়ি-ঘর নেই। আমাকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে কে? কারাগার থেকে বের হয়ে প্রথমে প্রেস কনফারেন্স করতে চাই। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখ করতে চাই। সুযোগ থাকলে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নে বসবাস করতে চাই। সেখানে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখি।