×

জাতীয়

জলবায়ু পরিবর্তনে ওলটপালট প্রকৃতি : হুমকিতে কৃষি ও খাদ্য

Icon

এসএম মিজান

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪৫ পিএম

জলবায়ু পরিবর্তনে ওলটপালট প্রকৃতি : হুমকিতে কৃষি ও খাদ্য

জলবায়ু পরিবর্তনে ওলটপালট প্রকৃতি : হুমকিতে কৃষি ও খাদ্য

মাঘের দ্বিতীয়ার্ধে এসেও বৃষ্টির কবলে দেশ। যেন বর্ষাকাল! আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, এটি অসময়ের বৃষ্টি। আর অসময়ের এ বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে রবি ফসলসহ শীতকালীন সবজির। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চাষিরা। আবহাওয়ার এই ধরন দেখে বোঝার উপায় নেই প্রকৃতিতে কখন কোন ঋতু বিরাজ করছে। এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। পরিবেশ দূষণের কারণে মূল চরিত্র বদলাচ্ছে সব ঋতু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে আমাদের কৃষির। আর কৃষির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে খাদ্য নিরাপত্তা।

এভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ এমন এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়ে একদিকে বৃষ্টি তো অন্য দিকে চলছে খরা। যেখানে বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি নেই, আবার অসময়ে অতিবর্ষণ, অতি বজ্রপাত, মাত্রাতিরিক্ত গরম, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি এবং নদীভাঙনসহ বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে আবহাওয়া আর প্রকৃতির গতি-প্রকৃতি বুঝে ওঠা দায় হয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে আবহাওয়ার চরিত্র। প্রকৃতিও বিচিত্র ধরনের আচরণ করছে। জলবায়ুর পরিবর্তনে আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশের পাশাপাশি কৃষি, খাদ্য ও মানব স্বাস্থ্যও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত তথ্য বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বিদায়ী বছর ছিল এই দশকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। গত গ্রীষ্মে ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সঙ্গে উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। উষ্ণায়নের কারণে জলবায়ু ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটে। এতে নানা ধরনের দুর্যোগ বেড়ে যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বে জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণের পরিবর্তন ঘটেছে। চলতি বছরে দফায় দফায় তাপপ্রবাহ, বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়, মৌসুমের শুরুতে বন্যা- এগুলোই হলো তার প্রভাব।

বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম জোরদারের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে কৃষিবিদ ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিতে দৃশ্যমান এবং হুমকির মুখে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা। বীজ গজানো, পরাগায়ন ও পরিপক্ব হতে সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত ও সূর্যালোকের প্রয়োজন। জলবায়ুর এ উপাদানগুলো পরিবর্ধিত হচ্ছে, কিন্তু বীজ বপন ও চারা রোপণের সময় পরিবর্তন সম্ভব হয়নি। ফলে কৃষি মৌসুমের সঙ্গে ফসলের চাষাবাদ খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না। 

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রমকে জোরদার করতে হবে। তাছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরো দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একটি হলো- প্রতিকূল পরিবেশে সহনশীল স্বল্পমেয়াদি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমাগত বৃদ্ধিরত জনসংখ্যার জন্য খাদ্যের যোগান দেয়া। অন্যটি পরিবর্তিত বিরূপ পরিবেশে কৃষিকে খাপ খাওয়ানো। ক্লাইমেট স্মার্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে মিল রেখে টেকসই করতে খাপ খাওয়ানো বা অভিযোজন কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। 

তিনি বলেন, জলবায়ু বলতে সাধারণত কোনো স্থানের ৩০ বছরের বেশি সময়ের আবহাওয়া অর্থাৎ বায়ু, তাপ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড়কে বোঝানো হয়। অন্যদিকে আবহাওয়া বলতে কোনো স্থানের স্বল্প সময়ের অর্থাৎ ১ থেকে ৭ দিনের বায়ু, তাপ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতির গড় বোঝানো হয়ে থাকে। আবহাওয়া প্রতিদিন, এমনকি প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তন হয়। আবার কোনো স্থানের জলবায়ু পরিবর্তন হতে দীর্ঘ সময় লাগে। আবহাওয়ার বিস্তার স্বল্প পরিসরে ঘটলেও জলবায়ুর বিস্তার বিশাল পরিসরে ঘটে থাকে। তারপরও আবহাওয়া ও জলবায়ু একে অপরের পরিপূরক। আবহাওয়া ও জলবায়ু উভয়েরই কৃষিতে প্রভাব উল্লেখযোগ্য।

জলবায়ুজনিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক ভোরের কাগজকে বলেন, এলনিনোর প্রভাবে সারা পৃথিবীতে তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। আবহাওয়ার দুটি ব্যবস্থা (সিস্টেম) সক্রিয় হলে পৃথিবীতে ঝড়বৃষ্টি, শুষ্কতা বা খরা এবং শীতের প্রকোপ ইত্যাদি বেড়ে যায়। এর একটি হচ্ছে ‘এল-নিনো বা লা-নিনো’, আরেকটি হচ্ছে ‘ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ (এমজেও)। তার মতে, এভাবে উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে গাছপালা বিলীন এবং শস্য আবাদে চরম ঘাটতি দেখা দিতে পারে। যত দ্রুত সম্ভব এর মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, ভূ-পৃষ্ঠে পানির রিজার্ভার বাড়াতে খাল খনন, পুকুর খনন ও সংস্কার করা প্রয়োজন। সে সঙ্গে গাছপালা বাড়ানো গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা হলেও মোকাবিলা সম্ভব হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে পরিবেশ বিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুর রব ভোরের কাগজকে বলেন, মানুষের হস্তক্ষেপের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রকৃতি ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে সুমুদ্রের উচ্চতা। নষ্ট হচ্ছে ইকো-সিস্টেম। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। জলাভূমি হচ্ছে মরুভূমি। এতে উপকূলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকৃতির ক্রমাগত পরিবর্তন তাদের জীবিকায় সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বহু কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, জোয়ারের তীব্রতা, নদীভাঙন, নদীতে মাছ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণ বহু জেলেকে পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য করেছে, যা একাধিক পরিসংখ্যানেও উঠে এসেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় পাল্টে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে ভয়াবহ বন্যার সঙ্গে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় যখন তখন ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টি হচ্ছে। বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। এতে করে আগামী বছরগুলোতে মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্ষয়ক্ষতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বাড়বে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App