×

জাতীয়

‘মিতুকে আমার ছেলে হত্যা করেছে, তাকে মাফ করে দিন’

Icon

কাগজ ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৫৭ এএম

‘মিতুকে আমার ছেলে হত্যা করেছে, তাকে মাফ করে দিন’

ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ার জেরে সাবেক এসপি বাবুল আক্তার তার স্ত্রী মিতুকে ভাড়াটে খুনি দিয়ে খুন করিয়েছেন। চট্টগ্রামে এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের মামলায় আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে এসব তথ্য জানান মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে বাবুলের মা নিজে তার কাছে স্বীকার করেছেন বাবুল মিতুকে হত্যা করেছে, তাকে যেন আমরা মাফ করে দিই। 

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) চট্টগ্রামের তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জসিম উদ্দিনের আদালতে সাক্ষ্য দেন শাহেদা মোশাররফ। এসময় সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারসহ হত্যা মামলার অন্য আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

আদালতে দেয়া সাক্ষ্যে মিতুর মা শাহেদা মোশাররফ বলেন, ২০০২ সালের ২৬ এপ্রিল বাবুল আক্তারের সঙ্গে আমার বড় মেয়ে মাহমুদ খানম মিতুর বিয়ে হয়। তখন বাবুল আক্তার বেকার ছিলেন। বিয়ের পর শুরু থেকেই তাদের সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না, মোটামুটি ছিল। পরে বাবুল পুলিশে যোগদান করে। এরপর কক্সবাজারে এসপি (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) হিসেবে বদলি হয়। সেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক নারীর সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়ে।

শাহেদা মোশাররফ বলেন, একদিন বাবুল আক্তার মিতুকে নিয়ে কক্সবাজারের একটি হোটেলে ওঠে। পাশের রুমে ওই নারীও ওঠেন। ওই নারীর রুমে বাবুল আক্তারকে আপত্তিকর অবস্থায় মিতু দেখে ফেলে। তখন মিতু জানতে চায় সে এখানে কী করছে? বাবুল মিতুকে বলে, বিদেশে যাওয়ার জন্য ল্যাপটপে কাজ করছে। তাদের দুজনকে এ অবস্থায় দেখে মিতুর খারাপ লাগে। সে কিছুক্ষণ ওখানে ছিল। বাচ্চারা একা থাকায় মিতু তাদের রুমে চলে আসে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত ৩টার দিকে মিতুর ঘুম ভেঙে যায়। তখনও বাবুল আক্তার মিতুর রুমে ছিল না। মিতু আবার ওই নারীর রুমে গেলে তাদের দুজনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পায়। মিতু রুমে এসে কেঁদে কেঁদে আমাকে ফোন দেয়। তখন আমি তাকে বলি, তুই চলে আয়। মিতু তখন বলে, আমার ছেলে-মেয়েরা আমাকে খারাপ মনে করবে।

শাহেদা মোশাররফ বলেন, চট্টগ্রামে বদলি হওয়ার পর আমার মেয়ের সঙ্গে এক বাসায় থাকলেও বাবুল আলাদা রুমে থাকত। বাবুল আক্তার গভীর রাত পর্যন্ত অনেক মেয়ের সঙ্গে কথা বলত। মিতু সেগুলো আড়ি পেতে শুনত। বাবুল ২০১৪ সালে মিশনে যায়। মিশনে যাওয়ার সময় তার একটি মোবাইল বাসায় রেখে যায়। ওই মোবাইলে বাবুল আক্তারকে দেওয়া ওই ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারীর মেসেজ খুঁজে পায় মিতু। একইসঙ্গে বাবুল আক্তারকে ওই নারীর উপহার দেওয়া দুটি ইংরেজি বই পায়। মিতু মেসেজগুলো দুটি বড় পৃষ্ঠা ও দুটি ছোট পৃষ্ঠায় লিখে রাখে।

শাহেদা মোশাররফ বলেন, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার ছোট মেয়ের বাসায় মিতু ও তার ছেলেমেয়েরা বেড়াতে যায়। মিতু তখন আমাকে পৃষ্ঠায় লেখা মেসেজগুলো দেয়। এসব আমাদের বলায় বাবুল মিতুর ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন শুরু করে। এরপর মিতু তিন-চারবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে। মিতু চট্টগ্রামের বাসা থেকে ঢাকায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। ২০১৬ সালের জুনের ৪ তারিখ রাতে মিতু আমাকে ফোন দেয়। ফোন দিয়ে বলে, আম্মা মাহিরের স্কুল থেকে ম্যাসেজ এসেছে। আমাকে খুব ভোরে মাহিরকে নিয়ে স্কুলে চলে যেতে হবে। ৫ জুন সকালে মিতুর বাসার পাশ থেকে একজন নারী আমাকে ফোন দেন।

ওই নারী আমাকে বলেন, মিতু গাড়ির সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে। আমি বলি, মা তুমি মিতুকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাও। আমি টাকা নিয়ে আসছি। এরপর মাহির (মিতুর ছেলে) একজনের মোবাইল থেকে কল দিয়ে বলে, নানু, আম্মুকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়েছে, গুলি করেছে। তখন আমি মাহিরকে বলি, তোমার আম্মু কি কথা বলছে? মাহির বলে, না, আম্মু তাকিয়ে আছে শুধু।’

‘আমি মাহিরকে বলি, তুমি তোমার বাবাকে কল দিয়েছ? মাহির বলে, হ্যাঁ নানু, ফোন দিয়েছি, তবে বাবা কথা বলে না। আমি মাহিরকে বলি তোমার আম্মুকে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখো। এরপর আমি, আমার ছোট দুই দেবর, জা ও ছোট মেয়েকে নিয়ে বিমানযোগে চট্টগ্রাম চলে আসি। মিতুকে যেখানে খুন করা হয়েছে, আমি সেখানে যাই। এরপর আমি মিতুর বাসায় আসি। ওখানে শুনি মিতু (লাশ) হাসপাতালে আছে।’

শাহেদা বলেন, ‘বাসায় যাওয়ার পর মাহির আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বলে, নানু আমার মা চলে গেছে। মিতুকে (লাশ) এরপর হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসা হয় পুলিশ লাইনে। সেখানেই তার জানাজা হয়। পুলিশ লাইনে জানাজা হওয়ার পর আমার দুই দেবর মিতুর লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা নিয়ে যায়। আমরা ফ্লাইটে করে ঢাকা যাই। এরপর আমাদের বাড়ি মেরাদিয়াতে মিতুর জানাজা হয়। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। মিতু মারা যাওয়ার পর ছেলে মাহির বাবুল আক্তারকে তিনবার কল দিয়েছিল। কিন্তু বাবুল কল রিসিভ করলেও কোনো কথা বলেননি। শাহেদাও একবার কল দিয়েছিলেন, কিন্তু বাবুল সেটি রিসিভ করেননি।

শাহেদা মোশাররফ বলেন, ‌‘বাবুল আক্তার বিদেশে (মিশনে) থাকার সময় তিন-চারবার বাংলাদেশে আসে। দেশে ফিরলেও সে বাসায় অর্থাৎ মিতু বা ছেলেমেয়েদের কাছে যায়নি। মিশন শেষ করে ফিরেই সে চীনে চলে যায়। সেখানে বসেই বাবুল মিতুকে মারার পরিকল্পনা করে।’

শাহেদা বলেন, ‘মিতুর একটি ব্যবসা ছিল। ব্যবসার তিন লাখ টাকা দিয়েই মিতুকে খুন করায় বাবুল। মিতু মারা যাওয়ার পর বাবুল আক্তার আমাদের বাসায় ওঠে। ছয়মাস আমাদের বাসায় ছিল সে। সেখানে বসে সে আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ২৪ জুন (২০১৬) বাবুল আক্তারকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর বাবুল সেখান থেকে চাকরি ছেড়ে আসে। আমি তখন তাকে জিজ্ঞেস করি, চাকরি ছাড়লে কেন? তখন সে বলে, মিতু খুন হওয়ার কারণে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। আমি তাকে বলি, তোমার চাকরি ছাড়ার বিষয় কি মিতুর খুনের বিচারের জন্য?’

‘বাবুল আক্তার মিতুকে খুন করার জন্য মুসাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে দেয়। একথা বলেছে মুসার স্ত্রী। মুসার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মিতুকে খুন করেছ ? তখন মুসা তার স্ত্রীকে বলে, আমি খুন না করলে বাবুল আক্তার আমাকে ক্রসফায়ার দেবে। বাবুল আক্তার আমাদের বলেছিল, মিতুর খুনের আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। আমি ক্রসফায়ার দিতে বলেছি।’

শাহেদা আরো বলেন, আসামি ওয়াসিম, আনোয়ার গ্রেপ্তার হয়েছিল। এর কিছুদিন পরেই ভোলা ধরা পড়ে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে আদালতে জবানবন্দি দেয়, বাবুল আক্তারের নির্দেশেই মুসা মিতুকে খুন করেছে। মিতু মারা যাওয়ার দেড় মাস পর সে যে বাসায় ছিল ওখানে মিলাদ পড়ানোর জন্য আমরা চট্টগ্রাম আসি। এর কিছুদিন পর আসামি কালু ও শাহজাহান গ্রেপ্তার হয়। আমরা চট্টগ্রাম আসার পরে অবস্থা দেখে মনে হয়েছে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে বাবুল আক্তার মিতুকে খুন করেছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও নিজেই মিতু হত্যার মামলা করেছে।’

শাহেদা মোশাররফ বলেন, ‘১৫ দিন আগে বাবুল আক্তারের মা আমাকে কল দিয়ে বলেছেন, বেয়াইন, মিতুকে আমার ছেলেই খুন করেছে। তাকে আপনি মাফ করে দিন। আমি তাকে বলি, বাবুল মরলে কি এ কথা বলতেন?’

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে এসপি বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App