×

জাতীয়

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির দায় কার?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৫ এএম

ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির দায় কার?

ছবি: সংগৃহীত

অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ীমূল্যে যাতায়াত সুবিধা থাকায় ট্রেনের টিকিটের চাহিদা সবসময়ই বেশি। তবে এই চাহিদা বহুগুণ বাড়ে দুই ঈদ সামনে রেখে। টিকিটের এই বিপুল চাহিদাকে পুঁজি করে বছরের পর বছর ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হয়ে আসছে। এই কালোবাজারি রুখতে ট্রেনের টিকিট ডিজিটাল পদ্ধতিতে বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ট্রেনের টিকিট অনলাইন সিস্টেমে আনতে ২০০৭ সালে কাজ পায় সিএনএস নামের একটি কোম্পানি। 

কোম্পানিটি প্রায় একযুগ বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে কাজ করে। তবে এই একযুগেও ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনার যে ডিজিটালাইজেশন সেটি সম্পূর্ণরুপে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এরপর ২০১৯ সালে টেন্ডারে কমমূল্যে সেবা দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে কাজ পায় সহজ-সিনেসিস-ভিন্সেন জেভি, যার লিড পার্টনার ‘সহজ ডটকম’।  

কোম্পানিটি দায়িত্ব পাওয়ার পর শুরুতে ৫০ ভাগ টিকিট অনলাইনে দেয়া হচ্ছিল, গত বছর ২০২৩ ঈদ থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট পুরোটাই অনলাইনে দেয়া হয়েছে। এখন প্রতিদিন ৭০-৮০ হাজার টিকিট অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু রেলওয়ের সার্ভার ডাউন হয়েছে - এটি এবার শোনা যায়নি। নিঃসন্দেহে এটি রেলওয়ের সাফল্য যার অংশিদার সহজ ডটকমও।

তবে এই অনলাইন প্রক্রিয়ার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে কালোবাজারি চক্র। কালোবাজারির অভিযোগে গত ২১ মার্চ ৯ জন এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে  তিনজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরমধ্যে রেলের তিনজন বুকিং সহকারী রয়েছেন। এ ঘটনাই প্রমাণ করছে, ডিজিটালাইজেশন হলেও টিকিট ‘কালোবাজারির ভূত’  তাড়ানো যায়নি। ডিজিটালাইজেশনের পরেও কেন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি হচ্ছে সেটি খোঁজা যাক। 

ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনায় এখন দুটি পক্ষ কাজ করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং ‘সহজ ডটকম’। ‘সহজ ডটকম’ ট্রেনের টিকিট ব্যবস্থাপনায় রেলওয়েকে যাবতীয় কারিগরি (হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার) সহযোগিতা করছে। 

টিকিট কাউন্টারে ব্যবহৃত কম্পিউটার, প্রিন্টার, মাউস, কিবোর্ড, সফটওয়্যার, রিপোর্ট পেপার ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে ‘সহজ’। এসব ডিভাইস পরিচর্যার জন্য প্রতিটি স্টেশনে সহজ-সিনেসিস-ভিন্সেন জেভি (Shohoz-Synesis-Vincen JV)-এর কর্মী রয়েছেন। এসব ডিভাইসে কিংবা ইন্টারনেটে সমস্যা হলে, বিদ্যুৎ চলে গেলে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান দেন ‘সহজ ডটকম’-এর কর্মীরা। কাউন্টারে ব্যবহৃত টিকিট কাটার কম্পিউটারসহ অন্যান্য সকল ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণ থাকে রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার ও টিকিট বুকিং সহকারীর। কাজেই সহজের কর্মীর পক্ষে সিস্টেমে ঢুকে টিকিট জালিয়াতির কোনো সুযোগ নেই। 

রেলওয়ের টিকিট বুকিং সহকারীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া সহজের কোনো কর্মীর পক্ষে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়, তৃতীয় পক্ষের যে কারও জন্য একই কথা প্রযোজ্য।  এখন বোঝার চেষ্টা করি, জালিয়াতিটা হচ্ছে কীভাবে। রেলওয়ের টিকিট বিক্রির সুযোগ কেবল থাকে স্টেশনের বুকিং সহকারীর। টিকিট কাটতে প্রয়োজন হয় এনআইডি কিংবা জন্মনিবন্ধন সনদ। একটা এনআইডি/জন্ম নিবন্ধন থেকে সর্বোচ্চ চারটা টিকিট কাটা যায়। প্রত্যেকটা টিকিট কোন কাউন্টার থেকে কাটা হয়েছে এবং রেলওয়ের কোন বুকিং সহকারী টিকিট বুকিং নিয়েছে- এসব তথ্য টিকিটের গায়ে প্রিন্ট করা থাকছে। টিকিট দেখেই ধারণা পাওয়া সম্ভব, কোনো বুকিং সহকারী কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত কিনা। 

কালোবাজারি রোধে ট্রেন ভ্রমণকারীর ট্রেন ভ্রমণকালীন সময়ে এবং রেলওয়ে স্টেশনে ঢোকার মুখে টিকিট এবং এনআইডি চেকিং নিশ্চিত করতে হবে। এখানেই রেলওয়ের স্টেশনে এবং ট্রেনের ভিতরে গাফিলতি লক্ষ্য করা যায়। ঈদকে সামনে রেখে অবশ্য অনলাইন টিকিট কাটার সময় মোবাইল ফোনে ওটিপি পাঠানো হচ্ছে। অনলাইনে একটি আইডি থেকে এখন এক সপ্তাহের মধ্যে সর্বোচ্চ দুটি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আটটি (যাওয়ার এবং ফিরতি) টিকিট কাটা যাচ্ছে। আবার ভ্রমণের সময় যে এনআইডি/জন্মনিবন্ধন সনদের বিপরীতে টিকিট কাটা হয়েছে তাকে অবশ্যই ভ্রমণকারীদের মধ্যে থাকতে হবে। এতে টিকিটের প্রকৃত গ্রাহক ধার্য করতে বাড়তি নিশ্চয়তা পাচ্ছে বলা যায়। পস ডিভাইস ব্যবহার করে কিউআর কোড স্ক্যানিংয়ের মাধ্যমে ট্রেনে অনলাইন টিকিট যাচাই করা যাচ্ছে। এতে করে এই কয়েকদিন কালোবাজারি আগের তুলনায় কমেছে নিশ্চয়ই। তবে এরপরও টিকিট কালোবাজারির সুযোগ একেবারে বন্ধ হয়েছে এটা বলা যাবে না। এসবই হচ্ছে নিয়ম। এ নিয়ম ঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা দেখা জরুরি। 

অনেকে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে দিব্যি ভ্রমণ করছেন, প্রায়ই ট্রেনের টিকিট ভেরিফিকেশন করাই হয় না। এক্ষেত্রে যদি ট্রেনের লোকবল সংকট থাকে, এ খাতে জনবল বাড়াতে হবে। কালোবাজারি রোধের পাশাপাশি ট্রেনকে লাভজনক করতে এনআইডির মাধ্যমে টিকিট ভেরিফিকেশন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সেটিও অনলাইন-ভিত্তিক করা সম্ভব। বিমানের ক্ষেত্রে যার টিকিট তিনি ছাড়া অন্য কেউ ভ্রমণের সুযোগ নেই, ট্রেনের ক্ষেত্রেও সেটি নিশ্চিত করা গেলে ভালো হয়। 

নীতিনির্ধারকরা কি সেদিকে নজর দেবেন? ট্রেনে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে, অবকাঠামো সুবিধা বাড়ছে কিন্তু ট্রেনের সার্ভিস কোয়ালিটি বাড়ানোর দিকে রেলওয়ের কর্মকর্তাদের মনোযোগ কম। এ দিকটায় নজর দিতে হবে। শর্ষের মধ্যের ভূত যদি না তাড়ানো হয় ট্রেনের যেমন কালোবাজারির দৌরাত্ম্য কমবে, তেমনি জনপ্রিয় সেবাটিকে লাভজনকও করা কঠিন হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App