×

জাতীয়

সংবাদ সম্মেলনে কাঁদলেন

টিকটকার বিয়ে করে সর্বস্বান্ত জল্লাদ শাহজাহান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:১৮ পিএম

টিকটকার বিয়ে করে সর্বস্বান্ত জল্লাদ শাহজাহান

সংবাদ সম্মেলনে জল্লাদ শাহজাহান

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য উপাদান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। এগুলোর কোনোটিই আমি পাচ্ছি না। আমি আমার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আমার মা-বাবা নেই, দায়িত্ব নেয়ার মত ভাই-বোন নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিত্তবানদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমাকে থাকার ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন।

সোমবার (১ এপ্রিল) জাতীয় প্রেস ক্লাবে পাবলিক রিলেশনস এজেন্সি টাইমস পিআরের উদ্যোগে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এসব দাবি জানান জল্লাদ শাহজাহান। এ সময় তার আইনজীবী ওসমান গনী ও টাইমস পিআরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সোহেল উপস্থিত ছিলেন। 

তিনি বলেন, আমি চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছি। আমার কাজ করার মত ক্ষমতা নেই, আয়-রোজগার নেই, অর্থের যোগানদাতা নেই, নিজের থাকার জায়গা নেই। ৪৪ বছর কারাভোগ শেষ করে এসে আমি এখন বাইরের মানুষদের বুঝতে পারছি না। যেখানেই যাচ্ছি প্রতারণার খপ্পরে পরছি। গত বছরের ২১ ডিসেম্বর বিয়ে করে সেখানেও সর্বস্বান্ত হয়েছি। বিয়ের কাবিন ৫ লাখ টাকা হলেও আমার কাছে থাকা ১০ লাখ টাকা ষ্ট্যাম্পে লিখিত নিয়ে আমার স্ত্রী সাথী আক্তার ফাতেমা ৫৩ দিনের মাথায় পালিয়ে গেল। পালিয়ে গিয়ে আমার নামে যৌতুকের মামলা দিলো। আমি থানায় মামলা দিতে গেলেও বউয়ের নামে মামলা করা যায় না বলে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। পরে আইনজীবীর সহযোগিতায় গতকাল রবিবার আদালতে আমার স্ত্রী, শাশুড়িসহ ৬ জনের নামে মামলা দিয়েছি। 

জল্লাদ শাহজাহান আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ৪৪ বছর কারাবন্দী থেকে বাইরে এসে নানান প্রতারণায় পরে মনে হচ্ছে কারাগারেই ভালো ছিলাম। কারাগারের বাইরে জীবন এত জটিল কেন? জীবন এত কঠিন হবে জানলে কারাগারেই থেকে যেতাম। আমি কারাগার থেকে বের হলে আমার ভাগিনা নজরুল আমাকে অটো রিকশা কিনে দেবে বলে আমার টাকা মেরে দেয়। এরপর অনেক কষ্টে একটা চায়ের দোকান দেই। আমার সঙ্গে যে ছেলেটি দোকানে সময় দিত, সে ৪ মাস আমার সঙ্গে থাকার পর দোকানে থাকা ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায়। আমি এখন উভয় সংকটে জীবনযাপন করছি। একে তো আমার অচল অর্থনৈতিক অবস্থা অন্যদিকে একজন নারী আমার জীবনের শেষ জমানো টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছি এবং আমাকে যৌতুকের মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। অথচ আমার থেকে ১০ লাখ টাকা নেয়ার সময় ষ্ট্যাম্পে লিখিত দিয়েছে, যার সকল প্রমাণ আমার হাতে রয়েছে। 

শাহজাহান বলেন, কারাগার থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আমাকে পাঁচ লাখ টাকা দেয়া হয়েছিলো। আর কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছ থেকে আশীর্বাদ হিসেবে পাওয়া টাকাসহ মোট ১৮ লাখ টাকা আমি সাহায্য হিসেবে পাই। সেই টাকা দিয়েই মূলত আমি বিয়ে করে এখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। আমি এখন কীভাবে বাঁচবো, আমার জীবন কীভাবে চলবে, কোথায় থাকবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন খেয়ে না খেয়ে অনাহারে আমার জীবন চলছে। আমি এখন দুই-তিনদিন পর ভাত খাই। কেউ আমাকে খাবার দিলে খাই, না দিলে না খেয়ে থাকি। আমার থাকার জায়গা নেই। তাই ফুটপাতে, গ্যারেজে বা কেউ সাময়িক আশ্রয় দিলে সেখানে থেকে খুব কষ্টে সময় পার করছি। আমি আমার উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপির কাছে গিয়েছি কিন্তু কেউ আমাকে এক মুঠো ভাত দেয়নি, কাজ দেয়নি, সাহায্য সহযোগিতা করেনি। আমি এভাবে চলতে থাকলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

বাঁ দিক থেকে টাইমস পিআরের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান সোহেল , জল্লাদ শাহজাহান এবং আইনজীবী ওসমান গনী 

সবশেষে জল্লাদ শাহজাহান বলেন, বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে খুন করে এদেশ থেকে তার নাম যারা মুছে দিতে চেয়েছিলো তাদের ফাঁসি আমার নিজ হাতে কার্যকর করেছি। শেখের বেটির কাছে আমার চাওয়া, এই ঘৃণ্য অপরাধীদের ফাঁসি দেয়ার পুরষ্কার হিসেবে আমাকে একটি আবাসন ও জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত যেন চলতে পারি সে জন্য সহজ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। সমাজের বিত্তবানদের কাছেও আমার একই দাবি। আমার এই অসহয়াত্বের অবসান চাই। প্লীজ আমাকে বাঁচান। 

প্রসঙ্গত, মো. শাহজাহান ভূঁইয়া ওরফে জল্লাদ শাহজাহান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মো. হাসান আলী ভূঁইয়া ও মাতা সব মেহেরের তিন মেয়ে ও একমাত্র ছেলে শাহজাহান। তিনি ১৯৭৪ সালে নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বড় অফিসারদের ধমকের কারণে জিদ করে বাড়ি চলে আসেন। ১৯৭৬ সালে ছিলেন নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি। জীবনে ভুল পথে পরিচালনার ফলে ১৯৭৯ সালে গ্রেপ্তার হন। ১৯৯৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নামে ৩৬টি মামলার রায়ে ১৪৩ বছরের সাঁজা হয়। পরে ৮৭ বছর সাঁজা মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়। তবে ফাঁসি কার্যকর, সশ্রম কারাদণ্ড এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে রেয়াদ পেয়ে ৪৪ বছর কারাভোগ শেষে ২০২৩ সালের ১৮ জুন মুক্তি পান মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। 

২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি আলোচিত প্রায় ৪০টি ফাঁসি কার্যকর করেছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবথেকে বেশি ফাঁসি দেয়ার রেকর্ড। ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন।

তার দেয়া কিছু উল্লেখযোগ্য ফাঁসিগুলো হচ্ছে- ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামী খুকু মুনির, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামী হাসান, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামী এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামী পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ৯ মার্চ ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রথম যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলী, ২০২০ সালের ৫ মে (কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রথম ও একমাত্র ফাঁসি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদসহ প্রায় ৪০ জনের ফাঁসি কার্যকর করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App