×

জাতীয়

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:২৫ পিএম

জাপানযাত্রা ঠেকালেন মন্ত্রী

ছাপাখানার মেশিন পরিদর্শনের নামে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ৫ জন কর্মকর্তা জাপানের টোকিওতে যেতে চেয়েছিলেন। এজন্য কারিগরি বোর্ড থেকে তাদের তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদ্রাসা ও কারিগরি বিভাগে পাঠানো হয় অনুমোদন নিতে। সেখানে তালিকাটি যাওয়ার পর এক দফা কাটছাঁট করে সংশোধন করা হয়। 

তাতে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাদ পড়েন; নতুন করে যুক্ত হন মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের যুগ্ম সচিব (কারিগরি অধিশাখা-১) হাফসা বেগম। এরপরে জাপান যাত্রার অনুমোদনের জন্য সেই নথি শিক্ষামন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হয়। 

নথি দেখেই শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বুঝে নেন- জাপান যাত্রার জন্য যারা মনোনীত হয়েছেন তাদের কেউই ছাপাখানার কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন নন। এরপরই তিনি তাদের জাপান যাত্রার অনুমতি বাতিল করে নথি নিচে নামিয়ে দেন। তবু এই কর্মকর্তারা হাল ছাড়ছেন না। নানা ফন্দিফিকির করে কোনো একটা পথ বের করার তালে আছেন। ১০ মার্চের মধ্যে জাপান যাওয়ার আরেকটি সুযোগ আছে এবং সেই সুযোগটি কাজে লাগাতে চান।

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি নিষ্পত্তি হওয়া নথির প্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় পাবলিক ফান্ডের মাধ্যমে বিদেশযাত্রা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। বর্ণিত অবস্থায় এই মুহূর্তে বিদেশযাত্রায় নির্দেশক্রমে অসম্মতি জ্ঞাপন করা হলো।’ 

এর আগে জাপানে ছাপাখানা মেশিন পরিদর্শনের জন্য বোর্ডের অফসেট প্রিন্টিং মেশিনসহ অন্যান্য মালামাল কেনা এবং সরবরাহের জন্য ‘প্রি-শিফমেন্ট’ নামে ৫ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যদেরই জাপান যাওয়ার কথা ছিল। কমিটির আহ্বায়ক হলেন- কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খান। 

সদস্য হিসেবে আছেন, বোর্ডের সচিব মো. মিজানুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহ, বোর্ডের উপসচিব (প্রশাসন) মো. আবুল হোসেন ও বোর্ডের প্রকিউরমেন্ট অফিসার মো. আবু তারিক সিদ্দিকী। বিদেশ যাত্রার অনুমোদন নিতে তালিকাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পৌঁছলে সেখানে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কেপায়েত উল্লাহকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের যুগ্ম সচিব (কারিগরি অধিশাখা-১) হাফসা বেগমকে তালিকাভুক্ত করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী গত পাঁচ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই উপমন্ত্রী ছিলেন। তখন তিনি কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগেই নজর দিতেন বেশি। তাতেই তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে সরকার শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন করতে চাইলেও কিছু সংখ্যক ‘লোভী’ কর্মকর্তার জন্য সেখানে কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। এখন তিনি শিক্ষামন্ত্রী। দেশের উন্নয়নে যেখানে যা করার তিনি তা করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। 

তাদের মতে, যাদের জাপান যাওয়ার কথা তারা ছাপাখানা মেশিনের কী বুঝেন? শুধু টাকা খরচ হত সরকারের। শিক্ষামন্ত্রী তাদের বিলাসী জাপান যাত্রা বাতিল করে সরকারের আর্থিক সাশ্রয় করে দিলেন।

জানতে চাইলে গতকাল শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে একটি ছাপাখানার মেশিন বসানোর জন্য কয়েকজন কর্মকর্তা জাপান যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই সফরটি প্রয়োজনীয় ছিল না। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি নির্দেশও আছে, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর না করার জন্য। এসব কারণে তাদের জাপান যাত্রার অনুমতি বাতিল করে দিয়েছি।

নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, একটি অফসেট প্রিন্টিং প্রেস, (বাইকালার, ২৩-৩৬ সাইজ), কাটিং মেশিন, নাইফ গ্রাইন্ডিং মেশিন ও প্লেইট এক্সপোজার মেশিন কেনার জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ড গত বছর দরপত্র দেয়। এতে গুলশানের জিসান ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পায়। দরপত্রের বিধি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত ওই ছাপাখানার মেশিন জাপান থেকে এনে দেয়ার কথা। ১০ কোটি টাকা দামের ওই প্রকল্পে ছাপাখানার মেশিনটি পরিদর্শনের জন্য কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ নানা পর্যায়ের ৫ জনের জাপান যাওয়ার কথা। যে ৫ জনের জাপান যাওয়ার কথা ছিল তারা কেউই ছাপাখানার কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন নন। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের জাপান যাত্রা বাতিল হওয়ার কারণ জানার জন্য নানা নথি খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) থেকে প্রি-শিপমেন্ট পরিদর্শনের আওতায় বিদেশ ভ্রমণে যেতে কি কি শর্ত লাগে তা ওয়েবসাইট থেকে বের করে পড়ছেন। কারণ কোনো না কোনো উপায়ে জাপান যাওয়ার পথ বাতলাচ্ছেন তারা।

জানতে চাইলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব মো. মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত নথি নাকচ হওয়ার সেখানে কি লেখা ছিল তা আর এখন মনে নেই। তিনি প্রকিউরমেন্ট অফিসার মো. আবু তারিক সিদ্দিকীর কাছে বিস্তারিত তথ্য জানার পরামর্শ দেন।

প্রকিউরমেন্ট অফিসার মো. আবু তারিক সিদ্দিকী ভোরের কাগজকে বলেন, কেন যে এই সফর বাতিল করলেন শিক্ষামন্ত্রী তা আমরা বুঝতে পারছি না। তারমতে, এই সফরে সরকারের এক টাকাও খরচ হবে না। জাপানি ওই কোম্পানির টাকায় অনায়াসে আমরা টোকিও ঘুরে আসতে পারতাম। কতদিনের সফর ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ দিনের সফরে প্রথম দুদিন ছিল ছাপাখানার কারখানা পরিদর্শন। পরের তিন দিন ছিল টোকিওর দর্শনীয় স্থান পরিদর্শন। কিন্তু যাদের জাপান যাওয়ার কথা ছিল তাদের মধ্যে ছাপাখানার কারিগরি জ্ঞান কতজনের আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি কোনো কাজে বিদেশ গেলে স্যারদের প্রাধান্য দিতে হয়। কারিগরি জ্ঞানের চেয়ে স্যারদের পছন্দ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 

তিনি বলেন, বিদেশযাত্রা বাতিল হওয়ায় এমনিতেই মন খারাপ ছিল। এর মধ্যে আমাদের পাঠানো তালিকা থেকে একজনকে বাদ দিয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে ঢুকানো হয়েছিল, তাতে আরো মনখারাপ হয়েছে। এখন ছাপাখানা মেশিনের কী হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী আর হবে? জাপান গিয়ে দেখে এলে পণ্যটি সম্পর্কে আমরা স্বচ্ছ ধারণা পেতাম। কিন্তু সেটি না হওয়ায় আমরা বলে দিয়েছি, শর্তানুযায়ী যা যা চেয়েছি তা যেন ঠিকঠাকভাবে মেনে জাহাজে তুলে দেয়া হয়। 

এরপরই তিনি বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) থেকে প্রি-শিপমেন্ট পরিদর্শনের আওতায় বিদেশ ভ্রমণে যাওয়ার চিঠি দেখিয়ে বললেন, দেখেন এই চিঠিতে কি সুন্দর করে সবকিছু লিখে দিয়েছে। তবু আমাদের যেতে দেয়া হল না। চাকরি আছে আর মাস পাঁচেক। যাওয়ার আগে মনে একটু কষ্ট থেকে গেল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App