×

জাতীয়

গঙ্গা নিয়ে আলোচনা শুরু করল বাংলাদেশ ও ভারত

Icon

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০১:২৩ পিএম

গঙ্গা নিয়ে আলোচনা শুরু করল বাংলাদেশ ও ভারত

গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে প্রায় ২ বছর পর- ২০২৬ সালে। তার আগেই এই চুক্তি নবীকরণে কাজ শুরু করল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তার সদ্য দিল্লি সফরে চুক্তির নবীকরণ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেন। এ বিষয়ে ভারতও সম্মত হয়ে বলেছে, চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে দেশটির জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের পরই চুক্তি নবীকরণের কাজ শুরু হবে।

এদিকে, বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও গঙ্গার পানিচুক্তির নবীকরণের বিষয়ে তাদেরই একজন যুগ্ম-সচিবকে দায়িত্ব দিয়ে অভ্যন্তরীণ কাজও শুরু করেছে। এরপর পুরো বিষয়টি নিয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে সব প্রক্রিয়া শেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে সব চূড়ান্ত হলে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে চুক্তির নবীকরণে চুক্তি হতে পারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে কথা হয়েছে। এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চুক্তির নবায়ন করতে চাই। এ বিষয়ে ভারতের তরফ থেকেও দ্বিমত নেই। তারা শুধু বলেছে, সামনেই নির্বাচন। নির্বাচনের পর বিস্তারিত কাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল প্রায় ২৮ বছর আগে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৗড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীই তখন সবেমাত্র প্রথমবার দেশের ক্ষমতায় এলেও বহু বছরের এই অমীমাংসিত বিষয়টি অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে নিষ্পত্তি হয়েছিল তাদের আমলেই। সে সময় চুক্তির শুরুতেই বলা হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক এবং জনগণের অবস্থার উন্নয়নে পানিবণ্টনের বিষয়ে, বন্যা ব্যবস্থাপনা, সেচ, নদী অববাহিকা উন্নয়ন এবং পানি বিদ্যুৎ উন্নয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলের পানিসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য এই চুক্তি করা হয়। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবেগৌড়া এবং পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর উদ্যোগে চুক্তি হয়েছিল বলে বিশ্লেষকরা বলেছেন। এবার চুক্তি নবীকরণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কী ভূমিকা থাকবে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভারত সরকার রাজি থাকলেও মমতা ব্যানার্জির কারণে তিস্তার পানি ভাগাভাগি চুক্তি হচ্ছে না। গঙ্গা চুক্তির নবীকরণের সময়ও যদি তিনি বাগড়া দেন তাহলে পানি নিয়ে বড় সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ।

তবে গঙ্গা পানিচুক্তির নবীকরণে এরকম সমস্যা দেখছেন না জানিয়ে বাংলাদেশের পানি সম্পদ সচিব নাজমুল আহসান ভোরের কাগজকে বলেন, গঙ্গার পানির ক্ষেত্রে আমরা নতুন কিছুই চাইছি না। যেভাবে আছে সেভাবেই চুক্তির নবীকরণ চাই। সেই চুক্তির আদ্যোপান্ত খতিয়ে দেখতে এরইমধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে চুক্তি করতে গিয়ে কি হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল এবং ভবিষ্যতে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে তারই নথিপত্র খতিয়ে দেখছি আমরা। এরপর আমরা একটি প্রস্তাব পাঠাব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

পুরোনো নথি ঘেঁটে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম থেকেই গঙ্গার পানি নিয়ে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মনোমালিন্য চলে আসছিল। সীমান্তের কাছে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ সেই মনোমালিন্যকে আরো তিক্ত করে তোলে। এরকম পরিস্থিতি চলতে থাকার মধ্য দিয়ে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই ক্ষমতার পালাবদল হয়। দিল্লিতে যুক্তফ্রন্ট বা তৃতীয় শক্তির সরকার, আর ঢাকায় একুশ বছর বাদে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ। আর তার পর মাত্র ছয় মাস ঘুরতে না-ঘুরতেই দেখা গেল, দুই প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়া ও শেখ হাসিনা দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে বসে গঙ্গা-চুক্তিতে সই করছেন; তার আগের পঁচিশ বছরে যা কখনও ভাবাই যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, এই মাপের একটা চুক্তি তখনই সই হতে পারে যখন দুপক্ষ থেকেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নেতৃত্বের আগ্রহ তৈরি হয়। আর তখন দক্ষিণ এশিয়াতে সেই শর্তটাই পূরণ হয়েছিল। গঙ্গাচুক্তির মতো একটা জটিল বিষয় নিয়ে এগোতে গেলে রাজনৈতিক সাহস লাগে, শেখ হাসিনার পূর্বসূরিরা তা দেখাতে না পারলেও তিনি কিন্তু পেরেছিলেন এবং ভারতের দিক থেকেও তাতে সাড়া মিলেছিল। কিন্তু দীর্ঘ কংগ্রেস আমলে যে চুক্তি করা সম্ভব হয়নি, ভারতের কয়েকটি আঞ্চলিক ও বামপন্থী দলের জোটে তৈরি নবীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কীভাবে সেটা সম্ভব করে ফেলল- সেনিয়ে বহু আলোচনা উঠে।

ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, গঙ্গার পানি চুক্তির কৃতিত্ব প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর। তাদের মতে, সেসময় ভারতের যুক্তফ্রন্ট সরকারে বামপন্থিদের বড় ভূমিকা ছিল। সিপিএম সরকারে না গেলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন সিপিআইয়ের। আর সেই সরকারে জ্যোতি বসু-সুরজিতের মতো নেতাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশি। সেই জ্যোতি বসু যখন ঠিক করলেন, কলকাতা বন্দরের স্বার্থরক্ষা করেও গঙ্গা নিয়ে চুক্তি করা উচিত; তখন প্রধানমন্ত্রী দেবেগৌড়া নিজের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চেয়েও তার মতামতকে বেশি গুরুত্ব দিলেন। সব মিলিয়ে ত্রিশ বছর মেয়াদি এই চুক্তি দুই-তৃতীয়াংশ পথ পেরিয়ে এসেছে বড় কোনো বিঘœ ছাড়াই। তখন জ্যোতি বসু আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন বলেই কিন্তু এত বছরের পুরোনো একটা সমস্যা সমাধান হয়েছিল। ভবিষ্যতে কী হবে?

জানতে চাইলে পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ভোরের কাগজকে বলেন, তাদের বিষয়ে ভাবার আগে আমাদের নিজেদের দিকে তাকানো উচিত। সম্প্রতি ভোরের কাগজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ভারত আমাদের পানি দিল, আমরা কি তা ঠিকঠাকমতো ব্যবহার করতে পেরেছি? সব মিলিয়ে পানি চুক্তির যেমন নবীকরণ দরকার; তেমনি পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়েও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চুক্তি হলেও পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ভারতের দক্ষতা থাকলেও বাংলাদেশের ছিল না। পানি ব্যবস্থাপনা কীভাবে করতে হয় ভারত তারও একটি কৌশল ঠিক করে দিতে চেয়েছিল। একইসঙ্গে বর্ষা মৌসুমে যে পানি জমা হয় সেটি জলাধার করে সংরক্ষণের একটি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা ছিল। সেজন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পানি ধরে রাখার জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ সিদ্ধান্তও হয়। এরপর কাগজপত্রও তৈরি হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুই দেশের মধ্যে কারিগরি কমিটিও হবে। বাংলাদেশের তরফে কমিটি হলেও ভারতের তরফে এখনো কোনো কারিগরি কমিটি করা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে চুক্তির নবীকরণের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ-ভারত।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। চুক্তি মসৃণভাবে চলছে, পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুদেশের মানুষই খুশি। আজ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছে, আগামীতেও চলবে। 

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App