×

জাতীয়

আকস্মিক সফরে কৌতূহল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৯ এএম

ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশে ভারত-চীনের লড়াই।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার আকস্মিক ঢাকা সফরে নানা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে- তার এই সফর ঝটিকা নয়, রুটিনমাফিক। তবু অত্যন্ত গোপনীয়তায় ভরা এই সফরের প্রথম দিনে শ্রিংলা কী কী করেছেন- তার আদ্যোপান্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন কিংবা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।

এরকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সূত্র বলছে, গণভবনে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু এ নিয়েও কোনো পক্ষই মুখ খোলেনি। তবে আজ বুধবার পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার যে বৈঠক হবে ঘটা করে তার খবর জানানো হয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকটি সফর এবং বৈঠক বাতিল হয়েছে করোনাকালে। ভারতে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। আবার শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্র উইং ক্রমশই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে খোদ ভারতের মিডিয়াও প্রচার করছে। ভারত-চীনের মধ্যকার দ্ব›দ্ব, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন, বিদায়ী ভারতীয় হাইকমিশনার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎ না পাওয়ার মতো বিষয়গুলো কূটনৈতিক মহলে নানাভাবেই আলোচিত হচ্ছে। এমন আলোচনার মধ্যেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার হঠাৎ দুদিনের সফরে ঢাকা আসায় কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের অবাক করেছে। এমনকি ভারত-বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এ সফর নিয়ে কোনো পূর্বাভাসও দেয়া হয়নি- যা দুই দেশের সম্পর্কের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। হঠাৎ করে তার এই ঢাকা সফর নিয়ে কূটনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। কেন তিনি ঢাকা এলেন তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ৩ কারণে শ্রিংলা ঢাকা এসেছেন। বিশেষ করে চীনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশে ট্রায়াল হতে পারে- এরকম আশঙ্কা থেকেই তড়িঘড়ি করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফর। কারণ চূড়ান্ত ট্রায়ালে থাকা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন উৎপাদন এবং বাজারজাত করার জন্য ভারতীয় একটি কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। চীনের ভ্যাকসিন ট্রায়াল হলে বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বিক্রি কমে যাবে। ফলে বাণিজ্যিক গুরুত্ব বিবেচনায় তিনি ঢাকা এসেছেন।

এছাড়া ভারত চায় না যে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক আবার নতুন মাত্রা পাক। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ভারত-চীনের লড়াই বেশ জমে উঠেছে। অন্যদিকে, হঠাৎ করে পাকিস্তানও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটা নিয়ে ভারতের অস্বস্তি আছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এ বছরে দুবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন করেছেন এবং কাশ্মির ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। কাশ্মির ভারতের জন্য খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। ভারত এতে মার্কিন হস্তক্ষেপও মানেনি। এছাড়া করোনা মোকাবিলায় ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন কৌশল চাইছে দিল্লি। সম্প্রতি মোদির মন্ত্রিসভায় নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদ দিয়েছেন। এই তাগিদের অংশ হিসেবেই শ্রিংলা ঢাকায় এসেছেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. এম শাহেদুজ্জামান বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঝটিকা সফর দেশটির কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব প্রমাণ করে। ভারতের নীতি- বাংলাদেশে চীনকে ঠেকাও। আর এ কারণেই তিনি ঢাকা এসেছেন। কিন্তু ঢাকার এমন সফর সত্যিই অবাক করেছে। হয়তো করোনাকাল চলছে বলে বিষয়টি অন্যভাবে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এভাবে ঝটিকা সফর করবেন, তা অবশ্যই বিশ্লেষণের ব্যাপার।

এদিকে শ্রিংলার সফরের প্রথম দিনে ঢাকায় ছিলেন না বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। গতকাল বিকালে সিলেট থেকে ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, শ্রিংলা সফর এমন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে যখন আমি পূর্বনির্ধারিত সূচি অনুযায়ী সিলেটে এসেছি। তবু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কী কী স্থান পেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইদানীং দুই দেশের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নানা প্রচারণা চলছে। এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত কীভাবে কোভিড মোকাবিলা করবে সে নিয়েও আলোচনা হতে পারে। এছাড়া দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন নিয়েও কথা হতে পারে বলে মন্ত্রী জানান।

এর আগে গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকে বহনকারী ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিমান ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে অবতরণ করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর এটি শ্রিংলার দ্বিতীয় বাংলাদেশ সফর। এর আগে মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তিনি। ৩ বছর ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালনের পর গত বছর জানুয়ারিতে বিদায় নেন শ্রিংলা।

শ্রিংলার আকস্মিক সফর নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন মুখ না খুললেও গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটি ‘বিশেষ বার্তা’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দিতে ঢাকায় এসেছেন শ্রিংলা।

শ্রিংলার এই সফর নিয়ে প্রথমে ভারত কিংবা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফে সরকারিভাবে মুখ খোলা হয়নি। তিনি ঢাকা পৌঁছানোর পর গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে এক বাক্যের বিবৃতিতে সাউথ ব্লকের তরফে বলা হয়, ‘দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা এবং পারস্পরিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে’ মঙ্গলবার ও বুধবার বাংলাদেশ সফরে এসেছেন পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা।

করোনা ভাইরাস মহামারির জন্য যাতায়াতের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের পর থেকে এই প্রথম ভারতের কোনো উচ্চপদের কর্মকর্তা বাংলাদেশে এলেন। এমনিতেই গত বছর থেকে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কে বেশ খানিকটা জল ঘোলা করেছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ)। আসাম থেকে অবৈধ শরণার্থীদের বিতাড়িত করা নিয়ে বিজেপি নেতাদের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের নেতানেত্রীরা। এমনকি চলতি বছরের গোড়ার দিকে একটি সাক্ষাৎকারে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে গত মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশে আসার কথা ছিল মোদির। কিন্তু করোনার জেরে সেই সফর বাতিল হয়েছিল। তারপর থেকে একাধিকবার ফোনে কথা বলেছেন মোদি ও হাসিনা। শেষবার কথা হয়েছিল মে মাসে। সে ক্ষেত্রেও দুদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য একাধিক পদক্ষেপ করেছে নয়াদিল্লি।

এদিকে আজ বুধবার দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সঙ্গে দুদেশের সম্পর্কোন্নয়ন, করোনা ভ্যাকসিন ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সচিব বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। এ সম্পর্কে যাতে ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সে জন্য যত্ন নেয়া লাগে। এছাড়া সম্প্রতি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে কিছু কাল্পনিক সংবাদ হয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা হবে, যাতে সম্পর্কে কোনো গ্যাপ (ফাঁকফোকর) না থাকে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচুর ইন্টারেকশন (আলোচনা) হয়। করোনার কারণে সে হিসেবে এ বছর কমই হয়েছে। সব সময় আলোচনায় সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়টি থাকে।

তিনি বলেন, তাদের (ভারত) দেশে এখন করোনার ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। ভ্যাকসিন নিয়ে আমরা কে কোন পর্যায়ে আছি- সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশ সফর শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সরাসরি মিয়ানমারে যাবেন। তাই সেখানে যাওয়ার আগে শ্রিংলার সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হবে কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, হতে পারে। তারা তো এ বিষয়ে আমাদের সহযোগিতার কথা বলে আসছে। তারা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করছে যাতে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে আপডেট জানতে চাইতে পারি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App