×

জাতীয়

মাস্ক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

মাস্ক কেলেঙ্কারি ধামাচাপা!

প্রতীকী ছবি

অপ্রয়োজনে কেনাকাটা আর কেনাকাটায় দুর্নীতির মহোৎসব স্বাস্থ্য খাতে স্বাভাবিক ঘটনা গত কয়েক দশক ধরেই। বালিশ, পর্দা, বই কাণ্ডর পর করোনার এই দুর্যোগে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির তালিকায় যোগ হয়েছে গ্লাভস, পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) ও এন-৯৫ মাস্ক কাণ্ড। এত কাণ্ডের হোতারা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এছাড়া এসব দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির রিপোর্ট কেন আলোর মুখ দেখে না তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে করোনাকালেও স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটার দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসে, যা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। বিষয়টি তদন্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে ওই তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয় এক মাসের বেশি সময় আগে। কিন্তু সেই প্রতিবেদনে কী আছে তা জানা যায়নি এখনো। ৩০ মে জনপ্রশাসন সচিবের কাছে একটি চিঠি দেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল্লাহ। তদন্ত প্রতিবেদন কেন আলোর মুখ দেখেনি সিএমএসডি পরিচালকের সেই চিঠিতে অনেকটাই স্পষ্ট। ওই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিএস তাকে মেডিটেক ইমেজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তার ছেলের ওই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে বলে তাকে জানান ওই দুই কর্মকর্তা। এদিকে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিনের নামও। এলান করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আমিনের বিরুদ্ধে গত ২৯ মে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেছে খোদ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। থানায় ৪৬৮, ৪৭১ ও ১৯৮ ধারার মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়। আর এই দুর্নীতির খবর প্রকাশ হবার পর সিএমএসডি পরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবকে বদলি করা হয়। এদিকে পিপিই ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতিসহ স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানিয়েছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে কমিশন গঠিত প্রাতিষ্ঠানিক টিমও কাজ করেছে। তবে এই কাজে দুদক কতটা সফল হবেন তা নিয়েও রয়েছে সন্দেহ। কেননা, এর আগে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বন্ধে দুদক কিছু পদক্ষেপ নিলেও মন্ত্রণালয় সব সময় উদাসীন থেকেছে। সংসদেও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে কথা উঠেছে বহুবার। কিন্তু এ নিয়ে খুব একটা সরব হতে দেখা যায়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশর (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে ভোরের কাগজকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতের সেবা ও ক্রয় এই দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতি হয়। এসব দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হলেও তা আলোর মুখ দেখে না। করোনার এই দুর্যোগে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করে একটি মহল দুর্নীতি করে যাচ্ছে। করোনার এই সময়কে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় দুর্যোগ বলে ঘোষণা দিয়ে শুরু থেকেই বলে এসেছেন, এই সময়ে কোনো ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়ম তিনি সহ্য করবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও অমান্য করা হয়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয় এই দুর্নীতির সঙ্গে এমন একটি চক্র জড়িত যারা প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও নিজেদের বেশি ক্ষমতাধর ভাবছেন। তাই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ অমান্য করার সাহস পাচ্ছেন। তারা স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সুফলভোগী। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ কাজে তার সহায়ক শক্তি সহযোগিতা করবে। এই সহায়ক শক্তির মধ্যেই একটি মহল দুর্নীতিগ্রস্ত ও সুফলভোগী। যার ফলে দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) পরিচালক ও মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের বদলি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুর্নীতির দায়ে বদলি কোনো শাস্তি হতে পারে না। বদলি হলো এক সেক্টর থেকে দুর্নীতি অন্য সেক্টরে স্থানান্তরিত করা। আমি বলব বদলি করার অর্থ হচ্ছে পুরস্কৃত করা। স্বাস্থ্য খাতের শক্তিশালী সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে কয়েকটি অংশ আছে। একটি অংশ দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, একটি অংশ দুর্নীতিবাজদের আশ্রয় দেয় এবং অপর অংশটি এই দুর্নীতির সুফল ভোগ করে। এখানে প্রশাসন, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে শক্তিশালী এই তিন মহল জড়িত। যারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অমান্য করার সাহস ও শক্তি রাখে। বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, বিগত কয়েক বছরে স্বাস্থ্য খাতে মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরে যারা প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অদূরদর্শিতা, অক্ষমতায় দুর্নীতিতে ডুবেছে স্বাস্থ্য খাত। বিগত কয়েক বছর শুধু কেনাকাটাই যেন ছিল মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। আর অনেক ক্ষেত্রে কেনাকাটার চাহিদা হাসপাতাল কিংবা সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক নয়; ঠিক করে দিতেন মন্ত্রণালয়ের কর্তা-ব্যক্তিদের পছন্দের ঠিকাদাররা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই কেনাকাটা নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের না দিতে পারলে অনেক হাসপাতাল ব্যবস্থাপক ওএসডি কিংবা বদলি হয়েছেন। অনেকে উপর মহলের টেলিফোনে কাজ দেয়ার পর আজ দুদকের মামলায় জেলে কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছেন। যার হুকুমে কাজটি হলো তিনি বা তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও মন্ত্রণালয় তা আমলে নেয়নি কিংবা অভিযোগ খতিয়েও দেখেনি। এন-৯৫ মাস্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা কেন প্রকাশ হচ্ছে না? এ থেকে প্রমাণিত হয় দুর্নীতি উচ্চপর্যায়েও পৌঁছেছে। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালার ক্যাডার শিডিউল তছনছ করে দিয়ে অধিদপ্তরে মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তাদের আর্শীবাদপুষ্টদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমল থেকেই মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তর পর্যন্ত স্বাস্থ্য খাতের ঘাটে ঘাটে লুটপাটের সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা পরিবর্তন হলেও এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয় না। সরকারি দলের নাম ভাঙিয়ে তারা স্বাস্থ্য খাতের যাবতীয় টেন্ডারের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট কোনোভাবেই বন্ধ হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App