×

জাতীয়

চিকিৎসার করুণ চিত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২০, ১০:০৯ এএম

চিকিৎসার করুণ চিত্র

সাংবাদিক শাহাদাৎ হোসেন ও আশিকুর রহমান রাজু

বৈশ্বিক দুর্যোগ করোনা ভাইরাসে দেশে এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩ হাজার ৩৮২ জনের মধ্যে অনেকেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আইসোলেশনে থেকে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষ। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে দুটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত দুজন গণমাধ্যমকর্মীও রয়েছেন। তারা দুটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা, জনবল সংকট ও সেবার দুরবস্থা- সব মিলিয়ে তাদের দুজনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। এই করোনা জয়ীর মতে, কেউ করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হলে যদি তার পূর্বের শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিসসহ জটিল কোনো রোগ না থাকে, তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাড়িতে আইসোলেশনে থাকা উত্তম। ভেন্টিলেটর সুবিধা না লাগলে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়াই শ্রেয়।

করোনা জয় করে ঘরে ফেরা দুই গণমাধ্যমকর্মীর বর্ণনা

করোনাকে জয় করে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরা যমুনা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহাদাৎ হোসেন ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের ভিডিওগ্রাফার আশিকুর রহমান রাজুর অভিজ্ঞতা বর্ণনায় উঠে এসেছে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল এবং কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের আইসোলেশন সেবা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার করুণ চিত্র। শাহাদাৎ হোসেন গতকাল মঙ্গলবার ভোরের কাগজকে জানান, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে তিনি গুলশানের নিকেতনে নিজের বাসা ছেড়ে পরিবার নিয়ে শান্তিনগরে শ্বশুরের ফ্ল্যাটে ওঠেন। এর মধ্যে তিনি কীভাবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন তা এখনো নিশ্চিত হতে পারছেন না। তবে তার ধারণা, অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। ৮ এপ্রিল করোনা ভাইরাসের আলামতনিয়ে শঙ্কার মধ্যে ৯ এপ্রিল তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। ১০ এপ্রিল তার ব্যাংকার স্ত্রী, সাড়ে ৩ মাস বয়সী শিশুকন্যা ও শ্বশুর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আঁচ করতে পারেন। তার শ্বশুর ভর্তি হন একই হাসপাতালে।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে শাহাদাৎ হোসেন বলেন, সেখানে একটি ওয়ার্ডে সারি সারি বেডে শতাধিক করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। এক হাত পর পর বিছানা। সবার ব্যবহারের জন্য ৩টি টয়লেট, ৪টা বেসিন ও ৩টি গোসলখানা। ২৪ ঘণ্টায় ডাক্তার আসেন একবার। তার মতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফর্মুলায় যে আইসোলেশনের কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে ওই হাসপাতালের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। সুস্থ হতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল। সেখানে নিজের সুস্থতার জন্য নিজেই গরম পানি পান ও গার্গেল করা; আদা, লবঙ্গ, তেজপাতা মিশিয়ে চা পান করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতে ঠাণ্ডা, জ্বর ও কাশির ওষুধ নিয়মিত সেবন করতে হয়। পাশাপাশি নামাজ ও ব্যায়াম করার মধ্য দিয়ে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

শাহাদাৎ বলেন, একান্ত নিরুপায় ও বাধ্য না হলে বিশেষ করে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট প্রয়োজন হয় এমন পরিস্থিতি না হলে এই রোগীদের জন্য বাসার আইসোলেশন ভালো। নিরুপায় না হলে হাসপাতাল এড়িয়ে চলাই উত্তম বলে তিনি মনে করেন। হাসপাতালের পরিবেশ রোগীকে আরো অসুস্থ এবং মনোবল দুর্বল করে দেয় বলেও মনে করেন তিনি। ১৫ এপ্রিল পরীক্ষার রিপোর্ট পজেটিভ এলেও ১৭ এপ্রিল প্রথম দফায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরই সেখানকার পরিবেশের কারণে তিনি উদ্যোগী হয়ে ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি ফেরেন। গতকাল মঙ্গলবার দ্বিতীয় দফায়ও তার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তার শ্বশুরও এখন বাসায় আইসোলেশনে আছেন। এছাড়া শাহাদাতের স্ত্রী ও সন্তান বাসায় আইসোলেশনে রয়েছেন শুরু থেকেই। তারাও ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে করোনাকে জয় করে ফেরা এই গণমাধ্যমকর্মীর পরামর্শ হচ্ছে, এ থেকে বাঁচতে হলে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

আরেক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ইন্ডিপেন্ডেন্টের ভিডিওগ্রাফার আশিকুর রহমান রাজুও বলেছেন তার তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। তিনি উত্তরার কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢাকার যাত্রাবাড়ী মীরহাজীরবাগের বাসিন্দা এই গণমাধ্যমকর্মী জানান, ২৬ মার্চ রাতে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি ও শরীর ব্যথার মধ্য দিয়ে তিনি করোনার আলামত পান। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হটলাইনে যোগাযোগ করেন। তারা কিছু পরামর্শ দিয়ে দুদিন রক্তের স্যাম্পল সংগ্রহ করেন। পরীক্ষায় ফলাফল করোনা ভাইরাস পজেটিভ আসার পর ২ এপ্রিল তিনি কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে ৬টি করে বেড রয়েছে। অনেক সময় পর ডাক্তার-নার্স এসে রোগীদের নাম ধরে অবস্থা জানতে চান। ওয়ার্ডের বাইরে কেচি গেটের ভেতরে একটি স্থানে রোগীদের যার যার নাম লিখে পলিব্যাগে করে ওষুধ রেখে যাওয়া হয়। এছাড়া তালাবদ্ধ কেচি গেট খুলে ভেতরে চেয়ারের উপর তিনবেলার নির্দিষ্ট খাবার দিয়ে হ্যান্ডমাইকে সবাইকে খাবার সংগ্রহ করতে বলা হয়। এরপর রোগীরা নিজ দায়িত্বে তা গ্রহণ করেন। রাজু জানান, তাকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কেটলিতে পানি গরম করে গার্গেল ও চা পানের ব্যবস্থা করতে হতো। আদা, লবঙ্গ, তেজপাতা দিয়ে চা বানিয়ে তিনি সেবন করতেন। ভর্তির পর তার পীড়াপীড়ির কারণে সেখানে দুটি গ্যাসের চুলা বসানো হয়েছে। তার অভিজ্ঞতায় সেখানে ডাক্তার ও নার্সদের চেয়ে আইসিইউ স্টাফ ও ওয়ার্ড বয়রা কিছুটা তৎপর। যারা স্যাম্পল সংগ্রহ করেন, তারা রোগীর কাছে যান। সেখানে তীব্র জনবল সংকট এবং ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।

রাজুর মতে, সেখানে মূলত ঠাণ্ডা, জ্বর, এন্টিবায়োটিক ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দেয়া হতো। তার প্রতিষ্ঠান থেকে সার্বক্ষণিককভাবে তার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ভিটামিন জাতীয় খাবার, হরলিক্স, ফল পাঠানো হতো। গেটের বাইরে নির্দিষ্টস্থানে রোগীর নাম-ঠিকানা লিখে ওইসব সামগ্রী পৌঁছে দেয়া হলে হাসপাতাল স্টাফরা তাদের সময় করে সেগুলো রোগীর কাছে পৌঁছে দিতেন। ১২ এপ্রিল প্রথম রাজুর রিপোর্ট নেগেটিভ আসার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফায়ও রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এরপর ১৮ এপ্রিল তিনি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে ফিরে গেছেন শরীয়তপুরের গ্রামের বাড়িতে। সেখানেও তিনি ১৪ দিনের আইসোলেশনে রয়েছেন।

অসুস্থ হওয়া এবং পরবর্তী পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে রাজু বলেন, একেবারেই নিরুপায় না হলে এমন রোগীদের হাসপাতালে না যাওয়া উচিত। বাসায় আাইসোলেশন নিশ্চিত করা গেলে ভালো। হাসপাতালের পরিবেশ ও চিকিৎসাসেবা রোগীকে মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত করে ফেলছে বলেও তিনি মনে করেন। তার মতে, যেহেতু এই রোগের কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার হয়নি তাই আক্রান্ত হলে যতটুকু সম্ভব বাসায় থেকেই শুশ্রুষার চেষ্টা করা ভালো। এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে ঘরে থাকার বিকল্প নেই বলেও তিনি মনে করেন। রাজু আক্ষেপ করে বলেন, ঢাকার বাসায় যখন আইইডিসিআর সদস্যরা তার রক্তের নমুনা পরীক্ষার জন্য যান তখন এলাকাবাসী ও বাড়ির মালিক বিড়ম্বনার সৃৃষ্টি করেন। ওই অবস্থায় তখনকার পরিস্থিতি অবর্ণনীয়। আবার সুস্থ হয়ে গ্রামের বাড়ি ফিরলে সেখানকার মানুষজনও তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারছেন না। এলাকায় মানুষজন চলাচল সীমিত করেছে। সামাজিক এমন পরিস্থিতিতে তিনি হতবাক হয়ে বলেছেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে যেন তিনি কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন? তিনি সবাইকে মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App