×

জাতীয়

অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়ের অভাব

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২০, ০৯:৩৫ এএম

সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখনো খুব বেশি বিস্তার ঘটাতে পারেনি করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)। এই ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধে কাজ করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তবে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট এই তিন দপ্তরের মধ্যে স্বচ্ছতা ও সমন্বয়ের অভাব দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই তিন দপ্তরের তথ্য ও বক্তব্যে মিল নেই- যা মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করছে। আর সঠিক তথ্যের অভাবে ডালপালা মেলছে নানা গুজব। এতে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

অভিযোগ আছে, করোনা ভাইরাস শনাক্তে কিট ও পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্টের (পিপিই) মজুত না থাকার পরও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবারই বলেছেন, এসবের কোনো সংকট হবে না। পর্যাপ্ত মজুত আছে। তাই যদি হয়; তাহলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিরাময় কেন্দ্র ১৭ ফেব্রুয়ারি কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে এক লাখ পিপিই, পাঁচ লাখ মাস্ক, সার্জিক্যাল গগলস ও অন্যান্য সরঞ্জাম চেয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছিল? অথচ এ বিষয়ে গড়িমসি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত কিনা- এই পরীক্ষার সুবিধা সারাদেশে সম্প্রসারণ না করে এবং অধিক সংখ্যক ব্যক্তিকে পরীক্ষা না করেই মন্ত্রী বলছেন উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনেক ভালো আছে। অথচ ভাইরাসে আক্রান্তদের পরীক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বলেছেন, ‘সব দেশের প্রতি আমাদের খুব সাধারণ একটি বার্তা, তা হলো- পরীক্ষা, পরীক্ষা, পরীক্ষা। সব দেশেরই উচিত সন্দেহজনক সব রোগীকে পরীক্ষা করা। চোখ বন্ধ করে থাকলে দেশগুলো এই মহামারির সঙ্গে লড়াই করতে পারবে না। পরীক্ষা ছাড়া সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা যাবে না, সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। বিভিন্ন দেশই যে এই কাজে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য সারাদেশে ১২৬টি ভেন্টিলেটর প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবরই বলছেন ৫০০ ভেন্টিলেটর রাখা হয়েছে। আরো সাড়ে ৩০০ ভেন্টিলেটর যুক্ত করা হবে। দেশের বিভিন্ন এলাকার চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা পিপিই পাচ্ছেন না এমন অভিযোগ করলেও মন্ত্রী বলে যাচ্ছেন ৩ লাখ পিপিই বিতরণ করা হয়েছে। তাই যদি হয় তবে এসব পিপিই কোথায় যাচ্ছে? এমন অনেক প্রশ্ন, অসঙ্গতিপূর্ণ তথ্যে সাধারণ মানুষ তো বটেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও।

এ পরিস্থিতিকে ‘লেজে গোবরে অবস্থা’ আখ্যা দেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. মো. মোজাহেরুল হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী এমন পরিস্থিতিতে ‘লিড’ দেবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। দেশের কোন হাসপাতালে কী ধরনের সুবিধা আছে, আরো কী প্রয়োজন এর পুরোটা জানেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি হেলথ সিস্টেমের একটি অঙ্গকে নেতৃত্বে আনা হয়েছে। আইইডিসিআরের কাজ হলো আক্রান্তদের টেস্ট করা, টেস্টের সুবিধা সম্প্রসারণ করা, সার্ভিলেন্স করা। নিয়মিত ব্রিফিং করা নয়। মন্ত্রী যা বলছেন সেই কথার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের বক্তব্যের মিল থাকে না। তাই কিট, পিপিই কিংবা ভেন্টিলেটরের সংখ্যা বাড়িয়ে বললেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে তা প্রমাণ হয় না। মানুষ বোকা নয়। এমন পরিস্থিতিতে যখন মানুষ সঠিক তথ্য পাবে না তখন গুজবে বিশ্বাস করবে। এতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

জোর করে বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, দোষারোপ করতে চাই না। তবে সরকারের স্বাস্থ্য খাতের যে তিনটি দপ্তর বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করছে তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। চেইন অব কমান্ড না থাকলে এবং তথ্যের বিভ্রাট অনেক ভালো উদ্যোগকেও ব্যর্থ করে দিতে পারে। স্বাস্থ্য খাতে যারা আছেন তারা সবাই চিকিৎসক নন। তারা টেকনিক্যাল বিষয়গুলো ভালো বুঝবেন না এটাই স্বাভাবিক। তবে বক্তব্য দেয়ার আগে এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনেই বক্তব্য দেয়া উচিত।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ভোরের কাগজকে বলেন, কাজ করতে গিয়ে সরকারের এই তিন দপ্তরের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করেছি। তবে ধীরে ধীরে তা কমে এসেছে। টেকনিক্যাল বিষয়গুলো আরো বিস্তারিত জেনে বক্তব্য দেয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।

প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, সব দেশে যখন রাষ্ট্র প্রধান বা সরকার প্রধান এই বিষয়ে কথা বলছেন, জনগণকে আশ^স্ত করছেন। তখন আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতের একটি প্রতিষ্ঠানকে মুখপাত্র করা হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয়, এই পরিস্থিতিকে আমরা কম গুরুত্ব দিচ্ছি। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের একেকজন একের সময় একেক কথা বলছেন। যা বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতাকেই স্পষ্ট করে তোলে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাচিপের এক নেতা ভোরের কাগজকে বলেন, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব সুস্পষ্ট। করোনা ভাইরাসের বিষয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিন তথ্যাদি সরবরাহ করেছেন আইইডিসিআর পরিচালক। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার যোগ্যতা নিয়ে কোনো রকমের প্রশ্ন না রেখেই এ কথা বলা দরকার, এই ধরনের একটি সংকট বিষয়ে জনগণকে জানানোর দায়িত্ব তার নয়। সেই দায়িত্ব সরকারের। আরো সুস্পষ্ট করে বললে রাজনৈতিক নেতৃত্বের। তবে আইইডিসিআর পরিচালক তার বক্তব্য শুরুর আগে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখছেন বলে উল্লেখ করেন।

বিভিন্ন দেশে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারপ্রধান বা তার নির্দেশে নিয়োজিত টাস্ক ফোর্সের প্রধান কাঠামোর অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়েই গণমাধ্যমগুলোকে জানাচ্ছেন। তবে গত ৩-৪ দিনে সরকারের তৎপরতা যতটা চোখে পড়ছে তাতে মনে হয় সরকার আগে এই নিয়ে ভাবতেই রাজি ছিল না। এর ফলেই পরিস্থিতি আরো বেশি সংকটের পথে ধাবিত হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App