×

জাতীয়

নৌকা-ধানের শীষ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৫০ এএম

নৌকা-ধানের শীষ হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
ভোটের মাঠে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক এক বছর পর আজ শনিবার ফের ভোটযুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকা বনাম ধানের শীষের জমজমাট লড়াই দেখার অপেক্ষায় নগরবাসী। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও উন্নয়নের মন্ত্র; অন্যদিকে ‘গণতন্ত্র রক্ষা’ ও খালেদা জিয়ার মুক্তির আকুতি। রাজনৈতিক দলের প্রতীক নিয়ে মনোনীত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় স্থানীয় সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠানের এই নির্বাচনও পরিণত হয়েছে আদর্শিক লড়াইয়ে। পরস্পরের প্রতিপক্ষ আদর্শিকভাবে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হওয়ায় প্রার্থীদের মনোভাবও ‘বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’। এরই মধ্যে হয়ে গেছে কয়েক দফা হাতাহাতি-মারামারি। বাদ যায়নি আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও। দুই সিটির পুরো ভোটই নেয়া হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা ইভিএম সমর্থন করলেও ঘোর আপত্তি বিএনপি প্রার্থীদের। তারা সন্দেহের চোখে দেখছে খোদ নির্বাচন কমিশনকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের ভ‚মিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দলটির নেতারা। এ ছাড়া, সরকারি দল কারচুপির ষড়যন্ত্র করছে এমন অভিযোগ শুরু থেকেই করে আসছে বিএনপি। যদিও পাল্টা অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও। দলটির অভিযোগ, ভোট জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখল করতে রাজধানীর বাইরে থেকে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের এনে জড়ো করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের অন্তত ১৭০ কেন্দ্র দখলের ষড়যন্ত্র করছে বিএনপি, এমন অভিযোগ এই সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের। এই অভিযোগ সমর্থন করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও। এমন পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, সংশয়-শঙ্কার মধ্যেও জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী দুদলের প্রার্থীরাই। অন্যদিকে সব সন্দেহ-অবিশ্বাস উড়িয়ে দিয়ে ঢাকাবাসীকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়া হবে এমন দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই সিটিতেই ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীদের বিপুল ভোটে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। অবশ্য উত্তরের জনপ্রিয় মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার শূন্যপদে ৯ মাস আগে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম বিএনপির ওয়াকওভারের সুবাদে কার্যকর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই মেয়র নির্বাচিত হন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য খুব অল্প সময় পাওয়ায় ভোটারদের সামনে সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান দেয়ার দায়ভার তেমন একটা নেই তার। অবশ্য ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম কর্মনিষ্ঠ ও সজ্জন ভাবমূর্তির অধিকারী। তার প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়ালও একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। তার পিতা বিএনপি প্রভাবশালী নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু দেশের শীর্ষ শিল্পপতি। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটির সদ্য বিদায়ী মেয়র সাঈদ খোকন এবার দলের মনোনয়ন পাননি। তার জায়গার নৌকার কাণ্ডারি হয়ে এসেছেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য। সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে লড়তে নেমেছেন নগরপিতা হওয়ার লড়াইয়ে। চৌকষ আইনজীবী তাপসের রয়েছে বিশাল রাজনৈতিক প্রভাব। সংসদ সদস্য হিসেবেও তিনি সফল। স্বচ্চ ভাবমূর্তি গণমুখী ব্যক্তিত্বের জন্য সব মহলেই প্রসংশিত তাপস। আবার তার প্রতিদ্ব›দ্বী বিএনপির ইশরাক হোসেনও রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা সাদেক হোসেন খোকা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ও অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র। প্রকৌশলী ইশরাকও পুরান ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে তাপসের প্রবল প্রতিদ্ব›দ্বী হয়ে উঠেছেন। সব মিলিয়ে কঠিন এক লড়াইয়ে নেমেছেন দুদলের ৪ মেয়র প্রার্থীই। শেষ সিদ্ধান্ত সাধারণ ভোটারদের। রাজধানীর দুই সিটিতে আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ‘নগরপিতা’ নির্বাচনে রায় দেবেন ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন ভোটার। এরমধ্যে উত্তর সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪টি ও সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮টি। এই সিটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। ভোটকেন্দ্র রয়েছে এক হাজার ৩১৮টি ও ভোটকক্ষ ৭ হাজার ৫১৬টি। আর দক্ষিণ সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড ৭৫, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ২৫। এখানে মোট ভোটার রয়েছেন ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন। ভোটকেন্দ্র রয়েছে এক হাজার ১৫০টি, ভোটকক্ষ ৫ হাজার ৯৯৮টি। গতকাল শুক্রবার ৮টি করে মোট ১৬টি ভেন্যু থেকে ২ হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রের ভোটের সরঞ্জাম বিতরণ করা হচ্ছে। ভোটের নিরাপত্তায় আগের দিন থেকেই মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সদস্য। দুই সিটি নির্বাচনে ১৩ মেয়র প্রার্থীসহ কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রায় সাড়ে ৭শ প্রার্থী। তবে মাঠের লড়াই মূলত নৌকা আর ধানের শীষের প্রার্থীর মধ্যেই। আনুষ্ঠানিক প্রচারণা না থাকলেও গতকাল প্রধান দুদলের মেয়র প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। প্রত্যেকেই তাদের জয়ের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম উত্তরার একটি ক্লাবে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান। পরে বনানীতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমেদের বাসায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের আশাপ্রকাশ করেন নেতারা। এসময় আতিকুল ইসলাম বলেন, আমি আশাবাদী। নৌকার কোনো ব্যাকগিয়ার নেই, নৌকা কোনো দিন ব্যাকে যাবে না। নৌকা সবসময় সামনের দিকে যাবে। উত্তর সিটিতে বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল কারওয়ান বাজার এলাকায় গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। নির্বাচনের দিন তার দলের পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কাপ্রকাশ করেন তিনি। তাবিথ বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ রাখব পোলিং এজেন্টরা যাতে কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে থাকতে পারে সেজন্য সব সহযোগিতা করার জন্য। ইভিএমে যেন কারচুপি না হয় সেটা জনগণের কাছে তাদেরই প্রমাণ করতে হবে। এ ছাড়া দক্ষিণে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস ভোটকেন্দ্রগুলোতে এজেন্ট নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রের বিষয়ে, কাজের বিষয়ে কথা হয়েছে। এদিকে বারিধারার একটি বাসায় মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তার সঙ্গে এক বৈঠকশেষে সাংবাদিকদের কাছে ইভিএমসহ নানা বিষয় নিজের আপত্তির কথা তুলে ধরেন দক্ষিণ সিটিতে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেন। তিনি বলেন, ঢাকার বাইরে থেকে যে সরকারদলীয় বিভিন্ন জেলার কমিটি করে সন্ত্রাসীদের জড়ো করা হচ্ছে। কেন্দ্র দখলের পাঁয়তারা করা হচ্ছে সেই বিষয়গুলো আমরা বলেছি। আমরা কেন্দ্র দখল করব না, দখলমুক্ত করব। তবে কমিশনের ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা-অনাস্থা তাদের মানসিকতার ওপর নির্ভর করে মন্তব্য করে সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, ইসির প্রতি রাজনৈতিক দলের আস্থা ছিল, এটি কোনো দিন দেখিনি। যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের বক্তব্য একরকম হবে। আবার যারা বিরোধী দলে ইসির ওপর তাদের আস্থা আসবে না এটিই দেশের পকিটিক্যাল কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিইসি বলেন, আমরা পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন করিনি, করব না। এ ছাড়া ‘শূন্য গণনা’র প্রমাণ দেখিয়ে প্রত্যেক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম। তিনি বলেন, নিয়ম অনুসারে ব্যালট বাক্স খালি দেখিয়ে ভোট শুরু করা হয়, কিন্তু ইভিএম সিস্টেমে ব্যালট বাক্স নেই, তাই খালি বাক্স দেখানোরও সুযোগ নেই। এজন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোট শুরুর আধা ঘণ্টা আগে ইভিএমের ক্ষেত্রে ‘শূন্য ভোট’ গণনার কাগজ প্রিন্ট করা হবে। এদিকে গত ২০ দিনের আনুষ্ঠানিক প্রচারণা এবং নির্বাচনী ইশতেহারে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন নগরী, সবুজ ঢাকা, আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে ভোটারদের মন পাবার চেষ্টা করেছেন হবু নগরপিতারা। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ক্ষমতা ও সাধ্যের মিশেলে জনতা রায় দেবে এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে নগরবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, জনগণ উন্নয়ন চান। নিরাপদ জীবন চান। প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতিগুলো স্মার্ট। কিন্তু পার্লামেন্টের আদলে নগর সরকার না হলে প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি পূরণ অসম্ভব। প্রসঙ্গত, ঢাকার ২ সিটির নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২২ ডিসেম্বর। তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ৩১ ডিসেম্বর। ২ জানুয়ারি মনোনয়নপত্র বাছাই এবং মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ছিল ৯ জানুয়ারি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App