×

জাতীয়

এ কথা অনস্বীকার্য বছরটা উন্নতির

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২০, ১০:২২ এএম

এ কথা অনস্বীকার্য বছরটা উন্নতির

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের একটি বছর পেরিয়ে নতুন বছরে পা ফেললাম আজ। ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি যাত্রা শুরু করলাম নতুনের পথে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এই একটি বছর আমাদের অনেক প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবে, কিন্তু কতটা হবে তা গবেষক ও পণ্ডিতজনরা নির্ণয় করবে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাঙালি আদিবাসী সবাই মিলে যা কিছু পেতে চেয়েছিলাম বিগত একটি বছরের প্রচলিত রীতি অনুসারে, আজ তারই প্রশ্ন তুলছি পেরেছি কী তা পূর্ণ করতে? তবে হ্যাঁ এ কথাতো বলতেই পারি, সরকারের যে প্রগতির হিসাব তা হয়তো অনেকটাই দৃশ্যমান এবং এই দেশের নাগরিক হিসেবে সেজন্য নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞ থাকার কথা চলতি সরকারের কাছে। পারছি কি তা? অবকাঠামোগত উন্নয়নের বহুল প্রচার আমাদের চোখকে ঝাপসা করে দিচ্ছে, কিন্তু সেই অর্ধমগ্ন চোখে আমরা যে দেখতে পাচ্ছি মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ছে। এটা অনস্বীকার্য সরকার যারা পরিচালনা করে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই থাকে দেশের সমৃদ্ধির দিকে। নিমগ্নচিত্তে পরিকল্পিত কর্মসূচির বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা অনেক সময় বাস্তবায়িত কর্মের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে আদৌ কী ভাবি? প্রবৃদ্ধির উন্নতির হারের কামনায় আমরা এতটাই ব্যস্ততায় দিনাতিপাত করি যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব কী কোনো গতিসঞ্চার করতে পেরেছে, তা ভাববার হয়তো সময় পাই না। বছরটা উন্নতির এ কথা অনস্বীকার্য। জনগণের প্রতিক্রিয়াও জানি।

কর্মবর্ষের শুরুটা করি ইংরেজির দিনপঞ্জি হিসেবে। প্রাসঙ্গিকভাবে যদি প্রশ্ন করি, আমরা বাংলার মানুষ, বাংলার সন তারিখের প্রচলনও এ দেশে বর্তমান। তারপরও প্রায় দুশ বছরের ইংরেজ শাসন-শোষণে বাংলার মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য আজো ভুলে আছি। ইংরেজের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ও স্বাধীনতার সংগ্রাম করে ব্রিটিশ ক‚টকৌশলের চালে ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগের পর মুসলিম লীগ শাসিত পাকিস্তান পেয়েছিলাম। সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবসানের পর ঔপনিবেশিক পাকিস্তানে তেইশ বছরের সাম্প্রদায়িক পরাভব আমাদের গর্ব-গৌরবকে হতমান করেছিল। বাংলার সম্পদ অপহরণ করার তেইশ বছর পেরিয়ে মুক্তি সংগ্রামের চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত করেছি এবং দখলদার ঔপনিবেশিক শক্তি সাধারণ মানুষের লড়াইয়ে কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। সেই বিজয়ের আটচল্লিশ বছর পার করে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্র্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি আমরা জনগণ। তবু কেন ১৯৫২-র রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষা বাংলাকে যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম, আজো তা পারিনি। আমলাতান্ত্রিকতার স্বভাবে যে কথকতায় জবাব আসবে, তা হলো, বিশ্ব বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য আমরা ইংরেজি ভাষাকে আজো অবলম্বন করে চলেছি। কিন্তু যদি বলি ভাষা সংগ্রামের অন্যতম স্লোগানই ছিল ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা চাই’।

আমরা তো ইংরেজির ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করতে বলিনি। বলেছিলাম, ‘বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে’। কিন্তু কী আশ্চর্য ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেও তো কত বছর হয়ে গেল। প্রায় দুশটি দেশে দিবসটি পালিতও হচ্ছে। কিন্তু কী দুর্ভাগা ভাষা শহীদ ও তাদের উত্তরসূরি আমরা যে, আজো বাংলাকে অফিস আদালতে, রাস্তাঘাটে, বাড়িঘরে ইত্যাদি জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে অন্তত আমাদের দেশের মধ্যে মাতৃভাষা বাংলার যথোপযুক্ত সম্মান দিতে পারছি না। বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজি বা অন্য ভাষা ব্যবহারে কী আমরা কখনো বাধা সৃষ্টি করছি? অবাক হয়ে যাই মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে বাংলা রীতিমতো অপমানিত হচ্ছে ইংরেজির কাছে। আমরা দেখেও দেখছি না কেন? এ বছর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বছর পালিত হচ্ছে ‘মুজিববর্ষ’ বলে। এই গর্বিত বাঙালি মহানায়কই তো জাতিসংঘে প্রথম বাংলায় বক্তৃতা করে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্তত তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হলেও সরকারকে বলবো এ বছর থেকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা চালু করুন।

বাংলার ইতিহাস ও লড়াই-সংগ্রামের আদ্যোপান্ত লিখিতভাবে আজো গৃহীত হয়নি। ফলে ইতিহাস বিকৃতি, যার যা খুশি সেইভাবেই নতুন ‘ঘটনাপঞ্জি’ যুক্ত করে ইতিহাস সৃষ্টির অপপ্রয়াস করছে তাকে রুখে দেয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগে ইতিহাসবেত্তাদের একটি কর্মপ্রয়াস এ বছর থেকেই চালু করুন। এটা বাংলার মানুষ হিসেবে আমাদের চাওয়া। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদত, সম্পূর্ণ জ্ঞান ও পরিচিতি দিয়ে যাওয়া আমাদেরই কর্তব্য। তাহলে রাষ্ট্র ও সমাজ কীভাবে তৈরি করতে হবে তার সত্যিকার শিক্ষা ওরা পেতে পারবে। সেইসঙ্গে সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কেও সব শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

অতীব দুঃখের সঙ্গে দেশের চলমান দিনপঞ্জিতে হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, ভ‚মি গ্রাস, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের যে অমানবিক পাশব আচরণ সারা বছর ধরে প্রত্যক্ষ করলাম, তা আমাদের চিত্তে চাঞ্চল্য সৃষ্টি অথবা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও আমরা কিন্তু এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি। সংবাদপত্রের লেখা, টিভির টকশো কিংবা সচেতন দু-চারজন ব্যক্তির বিবৃতি অথবা দুয়েকটি ছোট রাজনৈতিক দলের প্রতিবাদ মিছিল বা সমাবেশ এত বড় নিপীড়নকে পরাস্ত করতে পারে না। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথা প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন। এ কলংকিত জীবনের বিরুদ্ধে বিচারালয়ের যথার্থ রায়, পুলিশের সঠিক ও সততাপূর্ণ তদন্ত পারে এসব সমাজবিরোধী কলংকিত চরিত্রকে ঢিট করতে। যদি সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা বাহিনী অপরাধ নির্ণয়ে সঠিক যথার্থ ভ‚মিকা পালন করতে না পারে তাহলে তার দায়ভার সরকারের ওপর এসেই পড়ে। সুতরাং সরকারকে আরো সজাগ থাকতে হবে এবং প্রকৃত অপরাধীদের কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে। ব্যর্থতায় কুৎসিত ওই অপরাধী চক্রই প্রশ্রয় পাবে আরো জঘন্যতম অপরাধ সংগঠনে।....হত্যা আর ধর্ষণের যে ন্যক্কারজনক ঘটনাবলির কথা শুনছি তাতে আমরা শিউরে উঠেছি। মানুষ হিসেবে কেউ যে এমন শিশু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটাতে পারে এটা ইতোপূর্বে আমরা ভাবতে পারিনি। এখনো ভাবতে চাই না। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশা নতুন এই ইংরেজি বছরে যেন আমরা কলংকিত ঘটনাবলির যথার্থ বিচার ও শাস্তিবিধান করতে পারি, তা না হলে অপরাধীরাই নির্বিঘ্ন হবে তাই নয় আমরা কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন অবস্থায় ঠেলে দেবো।

আমাদের অস্বাভাবিক যানজট শহুরে জীবনযাপনে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। কত শ্রমঘণ্টা নির্বিবাদে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তার যেমন হিসাব রাখছি না, তেমনি উন্নয়নের বিড়ম্বনায় বায়ু দূষণের বিষয়ে যেন তেমন কর্ণপাত করছি না। আমাদের ক্রিকেট টিম যখন দিল্লিতে খেলতে গেল তখন দিল্লির পরিবেশ দূষণ নিয়ে আমরা নাক সিটকেছি। অথচ আজ সেই দূষণে আমরাই দুষ্ট। শুধু কি তাই, যে বিকট শব্দ তুলে ট্রাক, লরি, বাস বসতি এলাকার স্কুলের সামনে কিংবা হাসপাতালের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শব্দ দূষণের সৃষ্টি করে, তা নিয়ন্ত্রণের আজো কোনো পদক্ষেপ দেখি না। নিত্যদিনই রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে যে কোনো পরিবহনের পুরো রাস্তা দখল করে রাখার প্রবণতা লক্ষ করি। অথচ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে। বাঁদিক দিয়ে গাড়ি চলাচলের স্বতঃসিদ্ধ প্রথা। তাকে নিয়ম করেও শোধরাতে দেখি না। এমনকি, রোগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে সমানে সাইরেন বাজাতে শুনি, তাতে কারো তাপ-উত্তাপ লক্ষ করি না। অর্থাৎ নাগরিক আচরণ সম্পর্কে চালক, ট্রাফিক পুলিশ কেউই তোয়াক্কা করে না। এই তো রাজধানী শহর ঢাকার চালচিত্র। তাতে আবার যানজট নিরসনের ‘পবিত্র’ প্রত্যাশায় মেট্রোরেলের লাইন বসানোর জন্য শহরময় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব লেগে গেছে। হায়, জানি না এ ব্যবস্থা জট কমাবে না বাড়াবে।

শহরের রাস্তাই তো কম, তাও আবার অপ্রশস্ত তারপরও একে ‘রাজধানী শহর’ আখ্যা দিয়েছি। কিন্তু রাজধানীর যা কিছু উপকরণ থাকার কথা সেই নগরায়ন সঠিকভাবে তো হয়ইনি, তারপর ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’ সৃষ্টি করে তৃপ্তি পাচ্ছি আমরা। বহু বছর ধরে আমরা মোটরগাড়ির লাইসেন্স দেয়া নিয়ন্ত্রণ এবং পাঁচ বছরের জন্য বন্ধ রাখার কথা বলেছি এবং লিখেছি, তার কোনো হদিস নেই। শহরে প্রতিদিন শত শত যানবাহন বাড়ছে। আবার মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে অগণিত। যে প্রাণহানির জন্য কাউকে আবার দায়ী করতে গেলেও পরিবহন নেতারা মানুষ হত্যাকে তোয়াক্কা না করে পরিবহন শ্রমিকদের পাশে প্রবল শক্তি নিয়ে দাঁড়ান। আর ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য, দুর্ঘটনায় মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করতেও পারা যাচ্ছে না। ওরা এখন দুর্ঘটনার শিকার যে পথচারী; দুর্ঘটনার জন্য সেই পথচারীদেরও দোষারোপ করছে। অসতর্কতা মানুষকে বিপদে ফেলে, এটা আমরা সবাই জানি। ‘ফুটওভার ব্রিজ’ রাস্তার যেখানে সেখানে তৈরি করে ফেলে রাখার চেয়ে অপ্রশস্ত রাস্তায় ট্রাফিক চিহ্ন দিয়ে পুলিশের নজরদারিতে রাস্তা পারাপারের ব্যবস্থা নেয়াটা কি ঠিক নয়?

এ বছরে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রেখেছে এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু এ বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মাত্র একটি থাকায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঢিমেতেতালায় চলছে। এটা প্রত্যাশিত নয়। জানি না সরকার কেন ট্রাইব্যুনাল বাড়াচ্ছেন না এবং এ বিচার ত্বরান্বিত করতে চাইছেন না। তবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করে খালেদ ভ‚ইয়া, স¤্রাট, জি কে শামীম প্রমুখদের গ্রেপ্তার করে এবং আওয়ামী যুবলীগের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর ফারুক চৌধুরীসহ অনেকের ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ করে সরকার যে নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রতি সাধুবাদ জানিয়েছে দেশবাসী সবাই। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারিসহ ৭৩ জনকে নানা অযোগ্যতার কারণ দেখিয়ে কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এমন ঘটনাও বহুল প্রশংসিত হয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে যে সমালোচনা হচ্ছে, তাকে যদিও

অনুপ্রবেশকারীদের অপকর্ম বলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বক্তব্য দিচ্ছেন, তারপরও প্রশ্ন থাকছে এই অনুপ্রবেশকারী সংগঠনে ঢুকলো কি করে... জানি না হবে কিনা, তবু প্রত্যাশা করব, আসছে ইংরেজি বছরে যখন ‘মুজিব বর্ষ’ পালন করা হচ্ছে ও ২০২১-এ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হবে, তখন যেন এ ধরনের ‘ব্যাখ্যা’ দিতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

২০১৯-এর উল্লেখযোগ্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনা হলো ২৭ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ বা ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠান। যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক না কেন এর ফলাফলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের অধিকার সংরক্ষণ কমিটির প্রতিনিধি নূরুল হক নুরু ও তার দুয়েকজন ছাড়া ডাকসুর সব পদেই ছাত্রলীগের সদস্যরাই নির্বাচিত হয়েছেন। ডাকসুর জি এস পদে নির্বাচিত হয়েছে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত গোলাম রাব্বানী। সংগঠন থেকে অপসারিত হলেও তিনি তো ডাকসুতে নির্বাচিত জিএস। নির্বাচনের আগে থেকে নূরুল হক নুরুর সঙ্গে ওদের আদর্শিক বিরোধ চলে আসছে। আর সেই বিরোধের কারণেই নুরু ভিপির দায়িত্ব পালন করতে পারছেনই না বরং নয় নয়বার মার খেয়েছে প্রতিপক্ষের হাতে। কোনোবারই প্রহারের দায়দায়িত্ব গোলাম রাব্বানীরা নেননি।

সর্বশেষ বেধড়ক মার দিয়েছে ভিপির কক্ষে ঢুকে লাইট অফ করে। এই মারের পর ক্ষমতাসীন দল এই প্রহারের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে একটা ভ‚মিকা নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের’ তিনজন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নুরুর ওপর আক্রমণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এদিকে ভিপি নুরু শাহবাগ থানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। ভিপির কক্ষে বেধড়ক মার খাওয়ার পর পাঁচজন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। একজনকে তো বেশ কয়েকদিন আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করতে হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জাহাঙ্গীর কবির নানক ও বাহাউদ্দিন নাসিম আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন বারবার নুরুর ওপর আক্রমণ হয়েছে তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন। এদিকে সুযোগ বুঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দল অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত শিবিরের কয়েকজন উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তার আগে অবশ্য ‘অপরাজেয় বাংলার’ পাদদেশে দাঁড়িয়ে মাত্র কয়েকজন বেশ জোরেশোরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার কথা বলেছেন। আমাদের সবার আশা ছিল দীর্ঘ ২৭ বছর পরে যখন ডাকসুর নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তখন তার ফলও আশাব্যঞ্জক হবে। কিন্তু নির্বাচন-উত্তর সময়ে নুরু ও রাব্বানীদের মধ্যে অর্থাৎ ভিপি জিএসের অনৈক্যের যে খতিয়ান লক্ষ করছি তাতে আমরা শুধু আশাহতই হইনি বরঞ্চ চিন্তিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতি কী মর্মান্তিক পরিণতির দিকেই না যাচ্ছে। দেখছি একে অপরকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা ছাড়াও আঘাত করার জন্য অস্ত্রও ব্যবহার করছে। আমরা তো কোনোভাবেই এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

এই আশাহত পরিস্থিতি থেকে নতুন ইংরেজি বছর আমাদের মুক্তি দিক, এটাই কামনা করছি। ডাকসু ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানি জামানার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির চর্চা করবে এটাই প্রত্যাশা করছি। এই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে যেসব সচেতন ব্যক্তি নিয়োজিত রয়েছেন, তারা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে ছাত্রদের উসকানি যেন না দেন, আসছে বছরে সে আশাও করতে চাই। শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসুক এই কামনা রইলো।

আমাদের জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক দলগুলোর কি যে ভ‚মিকা, তা ঠাহর করে উঠতে পারছি না। এক যুগ ধরে রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগই বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা ধরে রেখেছে। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার বিএনপি-জামাতের বিরাট যুক্তফ্রন্ট-২০ দলীয় জোট যে কোথায় উবে গেল, তা হাতড়ে মরছি, খুঁজে পাচ্ছি না। এই জোটই আবার কামাল হোসেন, বি. চৌধুরী, মান্না, আ স ম রব, কাদের সিদ্দিকী- এদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কোনো জোট বা ফ্রন্টের ‘গলাবাজি’ ছাড়া আর তো কোনো কার্যক্রম দেখছি না। মনে হয় দায় বড় বিএনপির। কারণ তাদের নেত্রী খালেদা জিয়া এতিমের অর্থ আত্মসাতের দায়ে দীর্ঘ কারাবাসে রয়েছেন। বিস্ময়কর ঘটনা হলো দণ্ডিতত দলীয় প্রধান বিএনপির নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তারই পলাতক পুত্র তারেক জিয়ার হাতে। তিনি কিন্তু রয়েছেন সাত সমুদ্দুর তের নদীর পারে লন্ডন শহরে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির দেউলিয়াপনার এ কী অপরূপ দৃষ্টান্ত? দেশের নাকি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, তাকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দলীয় প্রধান তবে কেন ভরসা করলেন পলাতক পুত্রকে? দেশে কি তাহলে যারা মাঝে মাঝে অফিসের অভ্যন্তরে, জিয়ার কবরস্থানে কিংবা প্রেসক্লাবের আলোচনা সভায়, ‘গণআন্দোলন করেই নেত্রীকে মুক্ত করতে হবে’ বলেন, অথবা রাজপথের ভয় দেখান, এদের মধ্যে কি কেউই দলীয় নেতৃত্বের দায়িত্বগ্রহণের যোগ্য নন। হায়রে স্বদেশ! এই তোমার বিরোধী দলের চরিত্র। এরাই আবার আওয়ামী লীগ সরকারকে গদি ছাড়া করতে চায়। দেশে যারা বিএনপি করেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ তো দল ছেড়ে চলেই গেছেন।

আর যারা আছেন তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গয়েশ্বর রায়, নজরুল ইসলাম খান, রুহুল কবির রিজভী অথবা আইনজীবী খোন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নাল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন- এদের মাঝেমধ্যেই গণমাধ্যমের মাইক্রোফোনে কথা বলতে শুনি। সেখানে তাঁরা ক্ষমতাসীনদের বেশ ধমকও দেন। কিন্তু হায়রে বুদবুদ, সবটাই তার পানিতে মিলিয়ে যায়। এতগুলো বছর চলে গেল তথাকথিত বিরোধী দল কেবলই ‘লেজ নেড়ে’ গেল আঘাত হানতে পারল না। ...একেই কি বিরোধী দল বলে? তাহলে আমরা কি ভাবতে পারি যে, দেশের ‘বৃহত্তম’ বিরোধী দল যত অন্তর্দ্ব›দ্বই থাক না কেন সামনের বছর খোলস থেকে বেরিয়ে ‘ফোঁস’ করে উঠবে? যদি তা হয় তবে তো ভালো। এমন প্রত্যাশাই রইল।

দেশ ও জনগণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ছিল বলেই ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধে সব জানপ্রাণ দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলাম এবং তথাকথিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আমরা দেশপ্রেমিক মুক্তিফৌজ প্রাণপণ যুদ্ধে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছিলাম। আমাদের তো তাই প্রত্যাশা বিজয়ী স্বদেশ যেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই সম্পূর্ণভাবে ধারণ করে নিজেদের গড়ে তুলতে পারি, সে আশাই সর্বক্ষণ করছি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা প্রভ‚ত উন্নয়ন সাধন করছি, আমাদের প্রবৃদ্ধিতে সম্মৃদ্ধি আসছে, জনগণ সচেতন হয়েছি পূর্বের তুলনায় ঢের বেশি; কিন্তু একি, আমরা কেন পাকিস্তানি জামানার মৌলবাদী প্রেতাত্মাকে নতুন করে প্রশ্রয় দিয়ে ওই হেফাজতের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে দীক্ষিত করতে চাইছি? মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কুৎসিত চক্রান্ত কৌশলে আমাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ‘আইয়ামে জাহেলিয়াত’ এর যুগে।

এই ধর্মান্ধতার ভ‚ত আকস্মিক চেপে বসেছে আমাদের কাঁধে, একে ঝেড়ে ফেলতে হবে। না হলে যে বঙ্গবন্ধুর ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ তথা স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারবো না। এমনই ব্যর্থতা দিয়ে আমরা কি মুজিব বর্ষকে আবাহন করতে চাই? না, চাই না। ধর্ম নিরপেক্ষতার দীক্ষায় দীক্ষিত হবে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ, তাতেই তো আমরা সমাজতান্ত্রিক চরিত্রধারণে আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিকে ধনশালী করতে চাই। মাদকাসক্তি, নানা বর্ণের দুর্নীতি সর্বোপরি ধর্মান্ধতার পরিবেশকে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের কপালে বিজয় তীলক এঁকে দিক, এই তো বিজয়ী বাংলার রক্তিম শপথের অঙ্গীকারে প্রদীপ্ত জনগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষা। সামনের ইংরেজি বছর যেন তারই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে মুক্ত স্বদেশকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে এই কামনাই রইলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির কাছে।

কামাল লোহানী: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও সমাজ বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App