×

জাতীয়

শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০১৯, ০২:৩২ পিএম

শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে

পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি, বাঙালি ও সরকারের প্রশাসনের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে। এই অঞ্চলের উন্নয়ন গতিশীল এবং সংঘাত নিরসনে সবার মাঝে আস্থা তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে পার্বত্য শান্তিচুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমেই ওই এলাকায় সব ধরনের সংঘাত দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।

রবিবার ( ১ ডিসেম্বর) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে ভোরের কাগজ ও আইসিএলডিএস যৌথভাবে আয়োজিত ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি : প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইসিএলডিএসের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইসিএলডিএসের নির্বাহী পরিচালক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম শফিউল্লাহ প্রমুখ।

ডা. মো. মুরাদ হাসান বলেন, দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার খাতায় নাম লেখানোর জন্য আওয়ামী লীগের জন্ম হয়নি। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরাতে পার্বত্য শান্তিচুক্তি একটি অসাধারণ ও দূরদর্শী চুক্তি। চুক্তির কিছু ধারা বাকি থাকলেও বেশিরভাগ চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। আমরা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পুরো বাস্তবায়ন করব। বর্তমানের সংকট কোনো রাজনৈতিক সংকট নয়। স্বার্থবাদী ও সুবিধাবাদী আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর কারণে সেখানে সংঘাত হচ্ছে। উন্নয়নে বাংলাদেশ বিশে^র কাছে রোল মডেল। সারাদেশে উন্নয়ন হচ্ছে। পার্বত্য এলাকায় সব নাগরিক সুবিধা দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি দেয়া হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর এখন আমাদের জাতিসত্তা নির্ধারণ নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলে গেছেন, আমরা সবাই বাঙালি। সংখ্যালঘু, নৃ-গোষ্ঠী বলে কিছুই নেই। আমরা আলাদা কোনো জাতি না।

পার্বত্য এলাকার জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনাদের এলাকায় অন্য জেলার মানুষ জমি কিনতে পারে না, এটা আপনাদের অনেক বড় সম্মান দেয়া হয়েছে। অন্য জেলার মানুষ সেখানে গিয়ে সমস্যা করছে না। আপনারাই সমস্যা করছেন। সমস্যা সমাধানে পার্বত্য জেলার সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের সংঘাতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পথ উন্মোচিত হয়েছে। সংঘাত কমেছে। চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নে সব পক্ষের আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। অনেকেই সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তবে এখন এটা আর সম্ভব না। কারণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আর থেমে থাকবে না। স্থানীয় জনগণ উন্নয়ন চায়। প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাস্তাঘাট হচ্ছে। সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা হয়েছে। অনেক সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটি রয়েছে। ভূমি সমস্যার সমাধান নিয়েও কাজ হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে আঞ্চলিক পরিষদের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়।

অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিনের জাতিগত সমস্যা সমাধানে বিদেশিদের সহায়তা নেয়া হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার দৃঢ়তায় পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে কোনো বিদেশি বা তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার প্রয়োজন হয়নি। সন্তু লারমা এবং সরকার উভয়পক্ষই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। কিন্তু কিছু স্থানীয় মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে চুক্তির বাস্তবায়ন চায় না। এ কারণেই সেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে।

মেজর জেনারেল (অব.) মো. আব্দুর রশীদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ বা অপ্রাপ্তি থাকায় সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। আত্মপরিচয়ের লড়াই বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কোনো জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। যারা ক্ষুব্ধ হয়েছে রাষ্ট্র তাদের কথা শুনলে সমস্যার সমাধান করতে পারবে। সবার অধিকার সমুন্নত রেখে একটি অবস্থানে পৌঁছাতে হবে। চুক্তি ধীর গতিতে বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে ভূমি সমস্যার দ্রুত সমাধান হলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। চুক্তির পর সংঘাত ক্রমান্বয়ে কমছে। এই পরিবর্তন আরো বেগবান করতে হবে।

অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের ভাবনার পাশাপাশি স্থানীয়দের ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে হবে। এখনো সাংঘর্ষিক পরিবেশ রয়েছে। এই অবস্থা কিভাবে নিরসন করা যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের মতামত নিয়ে কাজ করতে হবে। ভূমির অধিকার সমস্যাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। সব সমস্যা নিরসনে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে বিশ^াসের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। ভ‚-রাজনৈতিক অবস্থানে পার্বত্য চট্টগ্রামের গুরুত্ব রয়েছে। তাই সেখানে সেনাবাহিনী থাকতে পারে। তবে সেনা শাসন থাকতে পারে না। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে স্থানীয়দের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এই আস্থা ফিরে না আসা পর্যন্ত সমস্যার সমাধান হবে না। সবার আস্থা ফিরিয়ে এনে বৈষম্য দূর করতে হবে। পার্বত্য তিন জেলায় সাংস্কৃতিক বৈষম্য রয়েছে। তাদের বাঙালি বানাতে চাইলেই করা সম্ভব না। পার্বত্য এলাকা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবি কোনো যৌক্তিক দাবি না। আগের চেয়ে এখন সেনাবাহিনীর মনতাত্তি¡ক পরিবর্তন হয়েছে। সব মিলিয়ে আস্থার সংকট দূর করলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

এম শফিউল্লাহ বলেন, শান্তিচুক্তির আগে ওই এলাকা অন্ধকার যুগে ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে শান্তি চুক্তি করেছেন। এখন পাহাড়ের মানুষের মধ্যেই দলাদলি এবং নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার প্রতিযোগিতা চলছে। তবে সরকার পার্বত্য এলাকার মানুষকে জনবিচ্ছিন্ন মনে করে না। সরকারি ভাবে পার্বত্য এলাকার মানুষদের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বলা ঠিক হবে না। সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, পার্বত্য এলাকার মানুষকে সম্মানের সঙ্গে দেখতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে। একই সঙ্গে সরকার এবং প্রশাসনে বাঙালি কর্মকর্তাদের আরো বেশি উদারতা দেখিয়ে স্থানীয়দের কাছে যেতে হবে। ভ‚মি সমস্যার সমাধান দ্রুত করা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম জ¦লতে থাকলে এর ধারাবাহিকতা সারাদেশে পড়বে।

পার্বত্য এলাকার সব জনগোষ্ঠীর মাঝে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন, এলাকার উন্নয়ন, অগ্রগতি ও বাস্তবতার মধ্যে একটি সংঘাত রয়েছে। সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এই সংঘাত দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি। তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়া শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণেই শান্তিচুক্তি হয়েছে, পাহাড়ে পরিবর্তন এসেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সুদীপ্ত চাকমা বলেন, শান্তির জন্য সহাবস্থান ও আস্থার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের অন্যান্য এলাকার মানুষের চেয়ে পার্বত্য এলাকার মানুষ পিছিয়ে আছে। তাদের মূলধারায় আনতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।

অতিরিক্ত সচিব আব্দুস সাত্তার বলেন, পার্বত্য এলাকার জন্য সরকারের বরাদ্দ আগের চেয়ে অনেক বেশি। এই এলাকায় শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা স্থানীয় পণ্য বাজারজাত করতে পারলে বেকারত্ব কমবে। শান্তি ফিরে আসবে।

রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহীদুজ্জামান মহসীন (রোমান) বলেন, যাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে তাদের আধিপত্য বিস্তার ঘটছে। চাঁদাবাজি এখন প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। যারা চুক্তি করেছে তারাই এখন চুক্তির বাস্তবায়ন চায় না। আমরা সবাই মিলেমিশে বাস করতে চাই।

লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান বাবুল চৌধুরী বলেন, ভ‚মি সমস্যার সমাধান হলে ৮০ ভাগ সমস্যার সমাধান হবে। পার্বত্য অঞ্চলের ২৬টি উপজেলা পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অধীনে রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। উপজেলা চেয়ারম্যান তার কাজ কি হবে তা জানেন না। প্রশাসনকে আরো বেশি উদারতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দিদারুল আলম বলেন, আমরাও এই অঞ্চলের বাসিন্দা। বাঙালিদেরও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। আঞ্চলিক দলগুলোই পাহাড়ের মূল সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি করছে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।

খাগড়াছড়ি জেলা ছাত্র লীগের সাবেক সভাপতি হেমন্ত ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা জরুরি। ভূমি বেআইনি জবরদখল হচ্ছে। চুক্তির উভয়পক্ষ দায়িত্বশীল আচরণের পরিচয় দিলে অবস্থার আরো উন্নতি হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App