×

জাতীয়

দুর্বল সিগন্যালিং সিস্টেমে ঝুঁকি নিয়ে চলে ট্রেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৩৬ পিএম

বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬ লাখ কোটি টাকার ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৪৫) মাস্টারপ্ল্যানে সমস্যায় জর্জরিত রেলওয়ের সিগন্যালিং ব্যবস্থা কম্পিউটারাইজড করাসহ রেল টেলিকমিউনিকেশনের আমূল পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে দেশের সিংহভাগ রেলওয়ে স্টেশনকে আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থায় আনার জন্য পৃথক ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নেরও সুপারিশ করা হয় মাস্টারপ্ল্যানে। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের চার বছর পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। অথচ দেশের ৩৪২টি স্টেশনের মধ্যে মাত্র ১৫৩টিতে (৪৪ শতাংশ) চালু হয়েছে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা। বাকি ১৮৯টি (৫৬ শতাংশ) রেলওয়ে স্টেশনে এখনো পুরনো পদ্ধতির ম্যানুয়াল বা হ্যান্ডেল সিগন্যালে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।

গত ১২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ স্টেশনে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন যাত্রী। তার পরের দিন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আগুন লেগে লাইনচ্যুত হয় রংপুর এক্সপ্রেস। আবার গত বৃহস্পতিবার কিশোরগঞ্জে ভৈরববাজার রেল জংশনের কাছে চট্টগ্রামগামী নাসিরাবাদ মেইল ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এর তিনটিই কোনো না কোনোভাবে অত্যাধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে ঘটেছে বলে তদন্ত রিপোর্টে উঠে এসেছে। এ ছাড়া সারাদেশে চলতি বছরে প্রায় শতাধিক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্বল সিগন্যালিং ব্যবস্থাই অধিকাংশ ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্যতম কারণ হিসেবে উঠে এসেছে তদন্ত রিপোর্টে।

রেল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে পাঁচ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়েতে। এর মধ্যে সর্বাধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থাটি হচ্ছে রিলে ইন্টারলকিং সিগন্যালিং। এ ব্যবস্থাটি পুরোপুরি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত যেসব স্টেশনে ট্রেন চলাচল বেশি, সেসব স্টেশনে এ সিগন্যাল ব্যবস্থা রাখা হয়। রেলওয়েতে এ ধরনের সিগন্যাল ব্যবস্থা সম্পন্ন স্টেশনের সংখ্যা মাত্র ৩৩টি। এর ৩১টিই রয়েছে পূর্বাঞ্চলে। অন্যদিকে সিবিআইয়ের (কম্পিউটার বেজড ইন্টারলকিং) মতো আধুনিক সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে ১০৮টি স্টেশনে। মাত্র ১২টি স্টেশনে ব্যবহার করা হচ্ছে সিটিসি (সেন্ট্রাল ট্রাফিক কন্ট্রোল) সিগন্যালিং ব্যবস্থা। বাকি ১৮৯টি রেলওয়ে স্টেশনে এখনো পুরনো পদ্ধতিতে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

পুরনো পদ্ধতিগুলোর একটি হলো মেকানিক্যাল ইন্টারলকড সিগন্যাল ব্যবস্থা। এ রকম সিগন্যালের জন্য লাইনের পাশে এক ধরনের তার ব্যবহার করা হয়, যা সংযুক্ত থাকে স্টেশন এলাকায় স্থাপিত লিভারের সঙ্গে। এ লিভারে টান দিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের ৭২টি স্টেশনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। লাল-সবুজ বাতি ব্যবহার করে ট্রেনের সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয় দেশের ৯১টি রেলস্টেশনে। আবার অনেক স্টেশনে সেই ব্যবস্থাও নেই। সেসব স্টেশনে ট্রেন প্রবেশের আগ মুহূর্তে স্টেশন মাস্টার ঠিক করেন, কোন লাইন দিয়ে ট্রেনটি যাবে। সে অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা ট্রেন যাওয়ার লাইনটি ঠিক করে দেন।

রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ১০ বছরে ১৩১টি নতুন ট্রেন চালু করেছে রেলওয়ে। রুট স¤প্রসারণ করা হয়েছে আরো ৩৮টি ট্রেনের। বিদ্যমান রেলপথে এসব নতুন ট্রেন যুক্ত করলেও সে অনুপাতে সিগন্যাল ব্যবস্থা আধুনিকায়নে মনোযোগ দেয়নি রেল। যদিও সিগনালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকায়নের জন্য নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি প্রকল্প, খরচ হয়েছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাজের কাজ হয়েছে খুব কমই। বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের প্রকল্প পরিচালক আতিকুর রহমান বলেন, এখনো অনেক স্টেশনে তারের কুÐলী দিয়ে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এটা তো ব্রিটিশ আমলের সিগন্যালিং পদ্ধতি। গত ১০ বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও রেলওয়ের এ বেহাল দশা আসলে খুবই কষ্টের।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, উন্নত বিশ্বে ট্রেনের সিগন্যাল ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রযুক্তি এসে জটিল এ কাজটি সহজ করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ঘটছে উল্টোটি। এখানে কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই নামানো হয় একের পর এক ট্রেন। কিন্তু এ ট্রেনগুলো সুশৃঙ্খল ও ঝুঁকিমুক্তভাবে চলাচলের জন্য যে সিগন্যাল ব্যবস্থা দরকার, সেদিকে নজর দেয়া হচ্ছে না। যার খেসারত দিতে হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা উল্লাপাড়ার মতো দুর্ঘটনার মাধ্যমে। পাশাপাশি তিনি এসব দুর্ঘটনার জন্য রেলওয়েতে অদক্ষ জনবলের আধিক্যকেও দায়ী করেছেন।

রেলওয়েতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেল খাত দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছিল। রেলের উন্নয়ন শুরু হয়েছে ১০ বছর ধরে। রেলওয়ে সিগন্যাল ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নিয়েও কাজ করে যাচ্ছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে যে একটা বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটি চাইলেই একদিনে দূর করা সম্ভব নয়। রেলের উন্নয়নে মন্ত্রণালয় সিগনালিং ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডাবল লাইন, নতুন ইঞ্জিন ও প্রযুক্তি আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App