×

জাতীয়

হাতিরঝিলের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১১ মে ২০১৯, ১২:১৪ পিএম

হাতিরঝিলের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে!
নির্মাণশৈলী, নান্দনিকতা আর সৌন্দর্যে অনন্য হাতিরঝিল হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল নগরবাসীকে। কারণ যান্ত্রিক শহরের বুকে এটি ছিল এক চিলতে সবুজের হাতছানি। ইটপাথরের নগর জীবনের ব্যস্ততা ভুলে একটু প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে হাতিরঝিলে ঘুরতে আসেন অনেকেই। দুপাশে গাঢ় সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে দূর্বা ঘাসের পাতাগুলো। মাঝখানে সিরামিকের হাঁটার পথ। ওপর থেকে ক্লান্ত পথিককে ছায়া দিচ্ছে নবযৌবনা খেজুর, পাম, কৃষ্ণচ‚ড়ার পত্রপল্লব। লেক থেকে হিমেল হাওয়া ভেসে আসে অবিরাম। কখনো ঝিরিঝিরি বরষায় সব একসঙ্গে জেগে ওঠে নতুন করে। গোধূলি বেলায় এ সৌন্দর্য আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। রাতের মিটিমিটি আলোর লুকোচুরিতে অপরূপার বেশে ধরা দেয়। সকালে শরীরচর্চা, বিকেলে সাইক্লিং আর সন্ধ্যে হলে আড্ডা; সারাবেলাই মুখর থাকে হাতিরঝিল এলাকা। এভাবেই চলছিল। কিন্তু এখন ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসু মানুষকে পড়তে হচ্ছে বিপদে। পানির দুর্গন্ধের কারণে হাতিরঝিলের পাড়ে বসা দূরে থাক, হেঁটে চলাও দায়। এর পচা পানির দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ দর্শনার্থীরা। পানির রং কালচে আকার ধারণ করে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। সেই সঙ্গে বেড়েছে পানিতে ভাসমান ময়লা-আবর্জনা। এমনকি লেকের পাড়ে বিভিন্ন অংশে দেখা মেলে ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প। নেই পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দর্শনার্থী ও পথচারীরা নাকে রুমাল চেপে ঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। ঝিলপাড়ের আশপাশের এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে দুর্গন্ধ। প্রতিনিয়ত লেকে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। এমনকি হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা কিছু অসচেতন দর্শনার্থী ও পথচারী হরহামেশাই ঝিলের পানিতে ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানি দূষিত করছেন। এসব দেখার যেন কেউ নেই! সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, হাতিরঝিলের এফডিসি মোড় অংশ থেকে লেকের মধুবাগ ব্রিজ পর্যন্ত পানির রং কালচে। সেই কালচে পানির দুর্গন্ধে টেকাই দায়। পানিতে ভাসতে দেখা গেছে, ফলের খোসা, চানাচুর ও চিপসের প্যাকেট, পলিথিন, পানির বোতলসহ আশপাশের বাসাবাড়ির গৃহস্থালি ময়লা-আবর্জনা। হাতিরঝিলের চারপাশে গড়ে ওঠা দোকান ও রেস্তোরাঁর ময়লাও ফেলা হচ্ছে ঝিলের পানিতে। কয়েকটি ড্রেন দিয়ে আশপাশে এলাকার পচা আবর্জনা ঝিলে প্রবেশ করে নষ্ট করছে পানির স্বচ্ছতা। এ পানি অনেক দিন ঝিলে আটকে থাকায় ক্রমেই পানির রং কালো হয়ে বাড়ছে দুর্গন্ধ। বাতাসের সঙ্গে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে ঝিলপাড় ও আশপাশের এলাকায়। ময়লা পানির ঘনত্বে ঢেউয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সাদা ফেনার। একই চিত্র দেখা মেলে এফডিসি মোড়, বেগুনবাড়ি লেকপাড়, গুদারাঘাট, নিকেতন ও রামপুরা অংশে। এ ছাড়া, বাইরে থেকে ভেসে আসছে শিল্পবর্জ্য। লেকের উত্তরপাড় দিয়ে মগবাজার থেকে গুলশান-বাড্ডা যাওয়ার পথে দেখা গেল, রাস্তা পাশে ময়লা-আবর্জনা পড়ে রয়েছে। অনেক স্থানেই স্থানীয় লোকজন নির্মাণ কাজের জন্য আনা বাঁশ মজুদ করে রেখেছে লেকের কিনারার পানিতে। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি চলাচল। এদিকে নানা অব্যবস্থাপনা ও অসঙ্গতির নজিরও নজরে এসেছে। ওভারলুপগুলোর নিচে গড়ে উঠেছে হকারদের অবৈধ অস্থায়ী দোকান। যেখানে মাদকাসক্তরা প্রকাশ্যেই মাদক সেবন করছে, টিজ করা হচ্ছে নারীদের। বিব্রত হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। হাতিরঝিলে নিরাপত্তা সদস্যদের তেমন চোখে পড়ছে না। তাই অনেকটা অবাধেই চলছে রিকশা, লেন মানছে না গাড়ি ও মোটরবাইক। ডাস্টবিন থাকা সত্তে¡ও যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এমনকি কিছু দুষ্টু লোকের মলমূত্র ত্যাগের অভয়স্থলে পরিণত হয়েছে হাতিরঝিল। আর রাতের হাতিরঝিল যেন নিরাপত্তাহীন। প্রকল্পের প্রথম দুবছর হাতিরঝিলের রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার কথা সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্ক ডিভিশনের। কিন্তু এখন অনেকটা ঢিলেঢালা ভাব দেখা যাচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভির আদর হাতির ঝিলের গল্প শুনে দেখতে এসেছেন, সঙ্গে অন্য বন্ধুরা। তারা লেকের পাশে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তানভির বলেন, অনেক মুগ্ধতা নিয়ে সবাই মিলে হাতিরঝিলে আড্ডা দিতে এসেছি। কিন্তু হোঁচট খেলাম। লেকের পানির দুর্গন্ধে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। এত তীব্র দুর্গন্ধ। আরেক দর্শনার্থী মাসুমা আজাদ বলেন, পুতুল বানালেই পর দায়িত্ব শেষ হয় না, তাকে মনের মতো গড়ে তোলাই সার্থকতা। ঠিক তেমনি এত টাকা খরচ করে এই হাতিরঝিল করা হয়েছে। অথচ এর রক্ষণাবেক্ষণ ভালোভাবে করা হচ্ছে না। তাহলে এমন ধরনের প্রকল্প করার প্রয়োজন নেই। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে এই বিনোদন কেন্দ্র বানিয়ে লাভ কী? যদি নগরবাসী কোনো বেনিফিট না পান। ঝিলের পানির দুর্গন্ধে টেকা মুশকিল। এই দুর্গন্ধ পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। অবিলম্বে এর বর্জ্য অপসারণ করে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। দ্রæতই এ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী ও হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক এইচ এম রায়হানুল ফেরদৌস বলেন, হাতিরঝিলের পানি দূষণ বন্ধে ৪৯ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প করা হয়েছে। ঝিলের পানি শোধনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় তৈরি হাই ক্যাপাসিটি এয়ার কম্প্রেসার স্থাপন করা হবে। এটি প্রক্রিয়াধীন আছে। দুই পাশে পাইপলাইন বসানোসহ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পানি দূষণের স্থায়ী সমাধান করা হবে। আগামী মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। উল্লেখ্য, হাতিরঝিল প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারিতে উদ্বোধন হয়। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অধীনে ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজটি করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্ক অর্গানাইজেশন। প্রায় ৩০২ একর জমির ওপর ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য বৃষ্টির পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যমে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতা দূর করা এবং নগরের নান্দনিক সৌন্দর্য় বৃদ্ধি করা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App