×

জাতীয়

পাফোর ‘অন্তরবাদ্যি’তে হার মানল ফণী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ মে ২০১৯, ০২:১১ পিএম

পাফোর ‘অন্তরবাদ্যি’তে হার মানল ফণী
উৎসব আয়োজনের তোড়জোড়ের মধ্যেই চোখ রাঙাচ্ছিল ‘ফণী’। কী হয়, কী হবে- এমনই ছিল শঙ্কা। তবে পাঠক ফোরামের (পাফো) বন্ধুরা ছিলেন সিদ্ধান্তে অটল। হবে এবং হতেই হবে- প্রাণের টান বলে যে কথা! পঁচিশ বছরের স্মৃতিরা তাড়া দেয়। তাই ফণীর ফণা উপেক্ষা করেই প্রাণের টানে দেশের নানাপ্রান্ত থেকে ছুটে আসতে থাকেন পাফোর বন্ধুরা। ভোরের কাগজ পাঠক ফোরামের রজতজয়ন্তী উৎসব হয় রাজধানীর নিউ ইস্কাটনের বিয়াম মিলনায়তনে। গতকাল শুক্রবার সকালের আকাশে ছিল ফণীর পদধ্বনি আঁকা গম্ভীর মেঘ। এর মধ্যেই একে একে সপরিবারে হাজির হতে থাকেন নবীন-প্রবীণ বন্ধুরা। সবাই উপস্থিত হওয়ার আগেই এক পশলা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যায় চারপাশটা। শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। তবে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই প্রাণের টানে হাজির হয়েছিলেন বিশেষ অতিথি নাগরিক টিভির সিইও জনপ্রিয় উপস্থাপক ডা. আবদুন নূর তুষার। এরপর আসেন উৎসবের অভিভাবক ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত। খানিকটা পরে হলেও অসুস্থ শরীর নিয়েই ভোরের কাগজের ডাকে সাড়া দিতে আসেন প্রধান অতিথি সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী ও বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জমান নূর। অতিথিদের আলো আর পাফো বন্ধুদের মুখরতায় প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে গোটা মিলনায়তন। খেলাঘর আসর সাংস্কৃতিক দলের অনিকেত আচার্যের নির্দেশনায় ক্ষুদে শিল্পী নাবিহা, অর্চি, তাজিম, কানিতা, মেঘা, শামা, রাফি, রাইসা, হামজা ও অয়নের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র মধ্য দিয়ে সূচনা হয় উৎসবের। এরপর জন্মভ‚মির প্রতি মায়া-মমতার সুর ছড়িয়ে তারা গায় ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভ‚মি’। পাফো বন্ধু তনিমা ইসলামের ‘মম চিত্ত নিতি নৃত্য, তা-তা থৈ-থৈ- গানের তালে নৃত্য দ্যুতি ছড়ায় মিলনায়তনে। এরপর শ্যামল দত্তের সভাপতিত্বে মূল আলোচনা পর্বে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন আসাদুজ্জমান নূর ও আবদুন নূর তুষার। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ভোরের কাগজের বার্তা সম্পাদক ইখতিয়ার উদ্দিন, পাফোর সাবেক বিভাগীয় সম্পাদক গিয়াস আহমেদ, ভোরের কাগজের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও পাফোর বর্তমান বিভাগীয় সম্পাদক মুকুল শাহরিয়ার, উৎসবের আহবায়ক ও ঢাকা কমিটির উপদেষ্টা ভোলানাথ পোদ্দার এবং ঢাকা কমিটির সভাপতি মরিযাদ হারুন। শুরুতে ক্ষুদেবন্ধু জাইমা ও অথৈ প্রধান ও বিশেষ অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। ভোরের কাগজ সম্পাদককে শুভেচ্ছা স্মারক উপহার দেন চট্টগ্রাম থেকে আসা বন্ধুরা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে ভোলানাথ পোদ্দার বলেন, পুরনো দিনকে নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছে রজতজয়ন্তী উৎসব। তিনি পাফোর জনক সঞ্জীব চৌধুরীকে স্মরণ করার পাশাপাশি ফণীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে প্রাণের টানে উৎসবে যোগ দেয়া দূরদূরান্তের বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান নূর নতুন প্রজন্মকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পাফোর নবীন-প্রবীণদের প্রতি আহবান জানান। বাবা-মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, সন্তানরা যেন বইয়ের পাতা ও মোবাইলে ডুবে থাকা অনুভূতিহীন মানুষ না হয়ে ওঠে। তারা যেন খোলা আকাশ, নদী, উন্মুক্ত মাঠকে অনুভব করে। জিপিএ ৫-কে নির্যাতন হিসেবে উল্লেখ করে মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ তৈরির দিকে নজর দিতে বলেন তিনি। শেষে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে নিয়ে কবিতা ‘নুসরাত আগুনে ডুবিয়ে দিলাম তোমাকে’ পাঠ করে শোনান। বিশেষ অতিথি আবদুন নূর তুষার সঞ্জীব চৌধুরীর মাধ্যমে পাফোর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্মৃতিচারণ করেন। নবীন চিকিৎসক হিসেবে তার ‘দেহঘড়ি’ শিরোনামের জনপ্রিয় লেখা নিয়েও নানা অভিজ্ঞতার কথা বলেন। বলেন, জীবনে যারা আনন্দ দিয়েছে তাদের কথাই স্মরণ করুন। জীবনের আনন্দ যেন আমরা ভুলে না যাই। ইখতিয়ার উদ্দিন বলেন, শুধু সৃজনশীল লেখালেখিই নয়, পাঠক ফোরাম সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত। এই ফোরামে যুক্ত হয়ে অনেকেই হয়েছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক, লেখক। মুকুল শাহরিয়ার পাফো নিয়ে অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ করেন। কৃতজ্ঞতা জানান সব বন্ধুদের প্রতি। বলেন, আমাদের হৃদয়ের দক্ষিণ দুয়ার খোলা আছে সবার জন্য। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে মরিযাদ হারুন বলেন, আমরা আজ ২৫ বছর পূর্তি উৎসব করছি। ৫০ বছর পূর্তিও উদযাপন করব। এ পর্যায়ে মঞ্চে পাফোর রজতজয়ন্তী সংকলন ‘অন্তরবাদ্যি’ প্রদর্শন করেন অতিথিরা। সংকলন নিয়ে গিয়াস আহমেদ বলেন, আমরা এক সময় কেউ থাকব না কিন্তু এসব লেখা থাকবে। পববর্তী প্রজন্ম এসব লেখা পড়বে। তিনি আরো বলেন, যে ভালোবাসা নিয়ে আমরা পাফো শুরু করেছিলাম, সে অনুভূতি আজ আর নেই। তবে আমাদের মানবিক বোধগুলো বেঁচে থাকুক। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, পাঠক ফোরামের সব ভালো কাজ, আয়োজন আর উদ্যোগে সর্বাত্মক সহযোগিতা থাকবে। সেই সঙ্গে বর্তমান বাস্তবতায় পাঠক ফোরাম নতুন পথ তৈরি করে তার গতি অব্যাহত রাখবে। আলোচনা পর্ব শেষে নামাজের বিরতির পর মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন সবাই। বিরতি শেষে মঞ্চে ‘পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়’ গানটির সঙ্গে নাচ পরিবেশন করে পাফো বন্ধু সুব্রত শেখর ভক্তের কন্যা কথা। এরপর পরিচয়পর্ব, স্মৃতিচারণ, পাফো নিয়ে নানা অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, পরিকল্পনার কথা বলেন পাফো পরিবারের নবীন-প্রবীণ সদস্যরা। প্রথমেই চট্টগ্রামের পাফো পরিবারের জালাল উদ্দিন সাগর, আনোয়ার আফসার, মইন, মামুন, রিমঝিম, ফারুকী, ফহিদা সোমা মঞ্চে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। যোগ দেন মোশারফর হোসেন পলাশকে নিয়ে পাহাড়তলীর বন্ধুরা। তারা সম্মিলিতভাবে পাফোকে গতিশীল করার অঙ্গীকার করেন। খালি গলায় রিমঝিমের কণ্ঠে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার গান ‘ও হালা চান গলার মালা পেট ফুরেরদে তোঁয়ারলাই’ গাওয়ার পরেই মঞ্চে আসেন জনপ্রিয় শিল্পী ফকির শাহাবুদ্দিন। তিনি গেয়ে শোনান, দেখে যারে মাইজভাণ্ডারী/শিনার ভেতর বাইধ্যা রাখুম তোঁয়ারে/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম গানগুলো। এরপর লোকসঙ্গীত শিল্পী শাহনাজ বেলীর গাওয়া- আইলানা রে বন্ধু/করি মনা কাম ছাড়ে না, মদনে/গড়ি চলে না চলে না চলে না রে/ গাউসে আজম- গানে উন্মাতাল হয়ে উঠে গোটা মিলনায়তন। পাফো বন্ধুদের অনুরোধে ‘দয়াল বাবা কেবলা কাবা আয়নার কারিগর’ গানটি গাওয়ার সময় শিল্পীর পাশে গিয়ে নাচতে শুরু করেন পাফো বন্ধুরা। গান শেষে ভোরের কাগজ সম্পাদক শিল্পীর গানের প্রশংসা করেন। তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান ও হাতে উপহার সামগ্রী তুলে দেন। গান শেষে সিলেটসহ বিভিন্ন জেলার বন্ধুরা মঞ্চে উঠে তাদের পরিচয় দেন। মঞ্চে আসেন ভোরের কাগজের সিলেট ব্যুরোপ্রধান ফারুক আহমেদ, সালাম ফারুক, উজ্জ্বল ধর, আসিফ, কাজল, আশুতোষ, মান্নান, ঢাকার সরফরাজ, গোয়াইনঘাটের ইলিয়াস আকরাম, ময়মনসিংহের শ্যামগঞ্জের শহীদুল্লাহ। এ সময় আঞ্চলিক ভাষার কবিতা ‘অ্যানা কিছু করহান’ আবৃত্তি করেন শহীদুল্লাহ। ইলিয়াস আকরাম ভোরের কাগজকে নিয়ে স্বরচিত গান ‘আমি ভোরের কাগজ, আমি সোনালি সোপান’ গেয়ে শোনান। এরপর ঢাকাসহ অন্য জেলার পাফো পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ওয়াহিদ মুরাদ, মরিযাদ হারুন, শেখ শামীমা নাসরিন পলি, রেজাউর রহমান সবুজ, কাজী সেলিম, রিমি, জলি, সিঞ্জন, নীলা, শারমিন, দন্ত্যস সফিক, সামস সাগর, মেজবাহ য়াযাদ মঞ্চে গিয়ে পরিচয় ও অনুভ‚তি ব্যক্ত করেন। এ সময় রেজা য়ারিফের ‘পাতানো মেয়ে’র হাতে প্রতীকী চেক তুলে দেয়া হয়। এ পর্বে উপস্থিত ছিলেন ভোরের কাগজের সাবেক ফিচার সম্পাদক আবিদা নাসরিন কলি। শেষে মেজবাহ য়াযাদ সবার অনুভূতি ছুঁয়ে গেয়ে ওঠেন, আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে রেখ...। প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় পুরো আয়োজন মাতিয়ে রাখেন মো. বোরহান উদ্দিন ও মোর্জিনা মতিন কবিতা। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ছিল আকর্ষণীয় র‌্যাফেল ড্র। গোটা দিনজুড়েই চেনা, অচেনা, কাছের-দূরের নবীন-প্রবীণ পাফো বন্ধু ও তাদের পরিবারের সদস্যরা একে অপরের প্রতি অপার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। ফ্রেমেবন্দি হয়েছেন দফায় দফায়। পাফোর পঁচিশ বছরের এ ‘অন্তরবাদ্যি’তে মিলনায়তনের বাইরের ফণীর গোমড়া আকাশও যেন হার মেনেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App