×

জাতীয়

বিভক্তির দুয়ারে বিএনপি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০১৯, ১১:৩৭ এএম

বিভক্তির দুয়ারে বিএনপি
খালেদার মুক্তির আন্দোলন নেই। গুলশান-নয়াপল্টন অফিসের সমন্বয় নেই। চেইন অব কমান্ডের বালাই নেই দলের মধ্যে। সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় ঘটছে না তারেকের। ঘুরে দাঁড়ানোর রোডম্যাপ ছাড়াই চলছে দল। দমনপীড়নে বিপর্যস্ত তৃণমূল নেতাকর্মীদের খবর নেয় না কেউ। ঐক্যফ্রন্টের ২০ দলেও চলছে টানাপড়েন। কোনো অগ্রগতি নেই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলার। ফলত পারস্পরিক অবিশ্বাস আর হতাশার আগ্রাসনে খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে একদা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বিএনপিতে বিভেদ বাড়ছে। প্রকাশ হচ্ছে সিনিয়র নেতাদের পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতা। কেউ একে অপরকে ঘায়েল করে কড়া বক্তব্য দিচ্ছেন। ইতোমধ্যেই দু-টুকরো হয়ে গেছে স্থায়ী কমিটি। ফলে থিতিয়ে আসছে দলের কার্যক্রম। নির্বাচনের পরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো তাগিদ নেই বিএনপিতে। বরং পারস্পরিক দোষারোপেই মুখর হয়ে আছে দলটি। তিন বছর আগের দলীয় কাউন্সিলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অসুস্থ অবস্থায় ১৪ মাস ধরে কারাগারে কাতরাচ্ছেন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে জোর তাগিদ থাকলেও তার মুক্তির দাবিতে রাজপথে নেই কোনো কর্মসূচি। অগ্রগতি নেই আইনি প্রক্রিয়ারও। কোন পথে খালেদা জিয়ার মুক্তি, এমন প্রশ্নের উত্তর নেই কারো কাছেই। ভাগ হয়ে পড়েছে নয়াপল্টন ও গুলশান অফিসের কার্যক্রম। সিনিয়র নেতারা কেউ কাউকে মানছেন না। নির্বাচনের সময়ে মাঠের যেসব নেতা আহত হয়েছিলেন বা মামলা, দমন-নিপীড়নের ভয়ে পালিয়ে রয়েছেন তাদের খোঁজ রাখেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের টানাপড়েনে দ্বিধায় নেতারা। দলে ঐক্যফ্রন্টের কদর বেশি, এমন অভিযোগে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন ২০ দলের নেতারা। জামায়াতকে সঙ্গে রাখা নিয়ে মতবিরোধ চরমে। নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে তড়িঘড়ি ট্রাইব্যুনালে যে মামলা করা হয়েছিল তাতেও গতি নেই। সমন্বয়হীনতার কারণে দলীয় আদেশ অমান্য করেই উপজেলা নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন বিভিন্ন উপজেলার নেতারা। তবে দলের মধ্যে বিভাজন বা আস্থার সংকট, কোনোটাই মানতে নারাজ বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, দলকে বিভক্ত করার চক্রান্ত চলছে। নির্বাচনের পরেই দল গোছানোর কাজ চলছে। সাংগঠনিক এ কার্যক্রম শেষে গণতান্ত্রিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা নেই বলেও দাবি করেন তিনি। সম্প্রতি দলের ভেতরে নেতাদের স্ববিরোধী বক্তব্যও বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রভাবশালী দুই সিনিয়র নেতার বক্তব্য নিয়ে দুই ভাগ হয়ে পড়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। গত ১৯ জানুয়ারি দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নতুনভাবে বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিএনপিকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আমরা যারা ব্যর্থ বলে পরিচিত হয়েছি, তাদের পদ ছেড়ে দিতে হবে। তরুণদের জায়গা করে দিতে হবে। একই সুরে কথা বলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও। তিনি বলেন, আমাদের যাদের বয়স হয়ে গেছে, আমরা সরে যাব। তারপরেও দলটাকে তো রাখতে হবে। তবে বিএনপির বেশিরভাগ নেতার মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তির আগে কাউন্সিল করা ঠিক হবে না। এর বিরোধের জের ধরেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন ওই দুই নেতা। এরপর থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ এই দুই নেতার উপস্থিতি কমে গেছে দলীয় সভা-সেমিনার ও বৈঠকে। সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির মতো বিএনপিতেও এখন দুইটি ভাগ। এক ভাগ নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়কে নিজেদের বাড়িঘর বানিয়ে বসলেও মহাসচিবের সঙ্গে কর্মসূচির কোনো সমন্বয় রাখছেন না তারা। বরং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে এক ধরনের কোণঠাসা করে রেখেছেন তারা। যে সব নেতা মির্জা ফখরুলের নির্দেশনায় চলতেন নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে তারাই এখন দলীয় মহাসচিবের ভ‚মিকা ও কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে সন্দেহের চোখে দেখছেন। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে সরকারি দলের মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছায় তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের পিঠে ছুরিকাঘাত করে নির্বাচনমুখী হয়েছিলেন, তার বিরুদ্ধে দলে এমন অভিযোগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন ওই নেতারা। গত ২৪ মার্চ রবিবার জিয়ার মুক্তি দাবিতে জোরাল কর্মসূচি না থাকা এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান নিয়ে দলীয় নেতাদের মধ্য অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, কেন খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে গেলাম? নেতাদের অভিযোগের উত্তরে ফখরুল বলেন, আমরা সবাই দেখেছি, নেত্রীর গ্রেপ্তারের পরে যখন আমরা কর্মসূচি দিয়েছি, কতজন এসেছেন, কতজন আসেননি। আমরা তো দেখেছি, কারা সেই কর্মসূচির মধ্য থেকে আস্তে আস্তে চলে গেছেন। ফখরুল বলেন, কথা সবাই বলতে পারেন, কিন্তু কাজ করতে হবে। বিএনপি আসলে চালাচ্ছে কে, এ নিয়েও সন্দেহ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ভেতরে ভেতরে। কেউ বলছেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একাই দল চালাচ্ছেন। কেউ বা বলছেন, তারেক রহমান দলের মহাসচিবের সঙ্গে সমন্বয় করে বিএনপি চালাচ্ছেন। এমন গুঞ্জনও উঠেছে, তারেকের অনুমোদনে টাকার বিনিময়ে নয়াপল্টনের দপ্তর থেকে বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কমিটি ঘোষণা করছেন একজন নেতা। দলীয় আদেশ অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনের অংশগ্রহণ করার অপরাধে নিয়ম করে বহিষ্কার করা হচ্ছে উপজেলা নির্বাচনের অংশগ্রহণকারী নেতাদের। যদিও এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকছেন সিনিয়র নেতারা। দলের নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় নেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের। যার ফলে বিএনপির সুধীজনদের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের ভেতরে তারেক রহমানের জনপ্রিয়তা থাকলেও বাইরে, বিশেষ করে ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তার ভাবমূর্তির সংকট আছে। অনেকের মতে, এ কারণেই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। ফলে দলের বিকল্প নেতৃত্বের সম্ভাবনা নিয়েও কথা তুলছেন তারা। তবে তারেক রহমান নিয়ে কোনো মন্তব্য করে ব্যক্তিগত ক্ষতির মুখে পড়তে চান না কেউই। গত ২৩ মার্চ দলের খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে এক অনশনে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, যারা মামলা-মোকদ্দমায় ভয় পান, তারা দয়া করে দায়িত্ব ছেড়ে দেন। যারা ভয় পাবেন না, তারা দায়িত্ব পালন করবেন। যারা মামলা মোকদ্দমা উপেক্ষা করে রাজপথে থেকে ‘গণতন্ত্রের মা’ খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনকে জোরদার করবেন, তাদের দায়িত্ব দিন। সব মিলিয়ে, নির্বাচনে ভরাডুবি, মামলা-মোকদ্দমার হয়রানি, দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসা এবং সিনিয়র নেতাদের পক্ষ থেকে সঠিক দিক নির্দেশনার অভাব ও তাদের সমন্বয়হীনতার পরিণতিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা। হতাশা, ভয় এবং নেতৃত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা ও আস্থাহীনতার কারণে নেতাকর্মীরা এখন রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। যার ফলে সভা-সেমিনারেও নেতাকর্মীদের উপস্থিতি কমে আসছে। তবে মাঠের নেতারা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এ কারণে রাজপথে কঠোর কর্মসূচি দিতে এখনো জোরাল তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App