২০২০ সালেই স্বপ্নপূরণ!
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০১৯, ১১:১৫ এএম
ফাইল ছবি
আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই বহুল আলোচিত ও আকাক্সিক্ষত পদ্মা বহুমুখী সেতুর সবগুলো পিলার নির্মাণকাজ শেষ করতে চায় সেতু কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে ইতোমধ্যেই নির্মিত পিলারগুলোর ওপর স্প্যান বসানোর কাজও এগিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। কিন্তু নদী শাসনের কাজ আশানুরূপ হয়নি। গত বছর প্রচণ্ড স্রোতের কারণে নদী শাসনের কাজে ব্যঘাত ঘটে। এখন এই শীতে নদী শাসনের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। তবে নাব্য সংকটের কারণে স্প্যান বসানো সম্ভব হচ্ছে না। সেতুর সবচেয়ে ঝামেলাপূর্ণ ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশা চূড়ান্ত হওয়ায় সব ধরনের জটিলতা কেটে গেছে। এই সেতু নির্মাণে এখন আর কোনো বাধা নেই। রেললাইনের গার্ডার বসানোর কাজও ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের সার্বিক নির্মাণকাজের ৬৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে এবং জটিলতা কেটে যাওয়ায় এখন আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে সার্বিক নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। এভাবে কাজ চলমান থাকলে ২০২০ সাল নাগাদ পদ্মা সেতু চালু হবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের ৬৩ শতাংশ সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে। সেতুর মোট ২৬১টি পাইলের মধ্যে ১৯১টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরো ১৫টি পাইলের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিলারের মধ্যে ১৬টির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। ১৫টি পিলারের কাজ এগিয়ে চলছে।
প্রকল্প এলাকায় দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদী শাসন এবং ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশা জটিলতার কারণে সেতুর নির্মাণকাজ এক বছর পিছিয়ে গেছে। গত বর্ষা মৌসুমে নদী শাসনের কাজ একেবারেই করা
যায়নি। আমাজন নদীর মতো পদ্মা নদীর চরিত্রও বোঝা কঠিন। এখন শীত মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী শাসনের কাজ শুরু করার পর পুরোদমে কাজ চলছে। বøক ফেলে নদী শাসন করা হচ্ছে। তবে এখন স্রোত না থাকলেও তীব্র নাব্য সংকট দেখা দিয়েছে। আগে যেখানে ক্রেন নিয়ে যাওয়া যেত, সেখানে এখন স্পিডবোট নিয়েও যাওয়া কঠিন। নাব্য সংকটের কারণে সেতুর ৬ নম্বর স্প্যানটি পিলারের ওপর স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। মাওয়া প্রান্তের কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্প্যান তৈরি হয়ে আছে। স্প্যানটির ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। স্প্যানটি বহনকারী ক্রেনটির ওজন ৩ হাজার ৬০০ টন। সব মিলিয়ে ক্রেনটির ওজন প্রায় ৭ হাজার টনে এসে দাঁড়ায়। নাব্য সংকটের কারণে ক্রেনটি স্প্যান নিয়ে ৩ কিলোমিটার দূরের জাজিরা প্রান্তে যেতে পারছে না। গভীরতা কম। ক্রেনটি চলাচল করতে কমপক্ষে ১৩ মিটার গভীরতার প্রয়োজন। নদীতে তা নেই। এখন নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি ড্রেজার দিয়ে নদী খননের কাজ চলছে। ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নদী শাসনের কাজ ৪৮ শতাংশ শেষ হয়েছে বলে তারা জানান। নদী শাসনের জন্য ৩৮ লাখ টন পাথরের প্রয়োজন হবে। এ ছাড়া ১ কোটি ৩৩ লাখ বøগ ও প্রায় ২ কোটি জিও ব্যাগ লাগবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে নদী শাসন বাবদ ৮ হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
প্রকৌশলীরা জানান, রেললাইনের স্লাব জাজিরা প্রান্ত থেকে বসানো শুরু হয়েছে। একেকটি স্প্যানে ৪টি সেকশনে ৮টি করে মোট ৩২টি স্লাব বসবে। এই অনুসারে ৪১টি স্প্যানে মোট ১ হাজার ৩১২টি রেল স্লাব বসবে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশার জটিলতা কেটে গেছে। এই দুই পিলার দ্রুত উঠে যাবে। পিলারের নকশা নিয়ে এখন আর কোনো জটিলতা নেই। পদ্মা সেতুর ২০টি পিলারের নির্মাণকাজ ৬টি পাইলের মাধ্যমে শেষ করা গেলেও মাওয়া প্রান্তের ৬ ও ৭ নম্বর পিলার নির্মাণে জটিতলা দেখা দেয়। এ কারণে পিলারের নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন ৬টি পাইলের পরিবর্তে ৭টি পাইলের মাধ্যমে এই দুটি পিলার নির্মাণ করা হবে। বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলীদের দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গত ১৫ জানুয়ারি পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ নকশা অনুমোদন দেয়। ফলে মাওয়া প্রান্তেও সেতু দৃশ্যমান হবে। এই প্রান্তে ২, ৩, ৪, ৫ ও ১৩ নম্বর পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। এই পিলারগুলোর ওপরে পাইল ক্যাপও বসানো হয়েছে। এখন যে কোনো সময় স্প্যান বসানো সম্ভব। ১৪ নম্বর পিলারের কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই সেতুর সবগুলো পিলার দৃশ্যমান করাই আমাদের টার্গেট। সেতুর সব দিকের কাজই আগের তুলনায় দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলছে। নদীর নাব্য ফিরে এলে চলতি মাসের শেষে অথবা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই সেতুর ৩৬ ও ৩৭ নম্বর পিলারের ওপর ৬ষ্ঠ স্প্যানটি বসানোর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। এই স্প্যানটি বসানো হলে সেতুর ৯০০ মিটার দৃশ্যমান হবে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৫টি স্প্যান বসানো হয়। আরো ৯টি স্প্যান প্রস্তুত রয়েছে। এরপর প্রতি মাসে একটি করে স্প্যান পিলারের ওপরে বসবে। শফিকুল ইসলাম আরো জানান, এ ছাড়া রেললাইনের গার্ডার বসানোর কাজ এখন চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ গার্ডার ও ১১২টি রেল স্লাব বসেছে। ৮ টন ওজনের একেকটি স্লাবের দৈর্ঘ্য ২ মিটার ও প্রস্থ ৫.১৫ মিটার। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতুর সার্বিক নির্মাণকাজের ৬৩ শতাংশ এবং মূল সেতুর ৭১ শতাংশ কাজের অগ্রগতি হয়েছে। বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টা নির্মাণকাজ চলছে।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়। এরপর ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি দ্বিতীয় স্প্যান, দেড় মাস পর ১১ মার্চ শরীয়তপুর জাজিরা প্রান্তে তৃতীয় স্প্যান, এর দুই মাস পর ১৩ মে চতুর্থ স্প্যান ও জুলাই মাসের শেষের দিকে পঞ্চম স্প্যানটি বসানো হয়। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুতে ৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যান বসবে। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত পদ্ম সেতুর দুদিকের ডাঙ্গার অংশ ধরলে এর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ৯ কিলোমিটার।