×

জাতীয়

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে পোশাক শিল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:০৮ পিএম

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে পোশাক শিল্প

* বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসার সুযোগ নাই * জোর দেয়া হচ্ছে ‘ব্রান্ডিং ও ভার্চুয়াল মার্কেটে’ * প্রশিক্ষণ-শিক্ষার মানে গুরুত্ব প্রয়োজন * কৃত্রিম সুতার ক্ষেত্রে দরকার বিশেষ পদক্ষেপ

একটি গোষ্ঠী সবসময় বাংলাদেশকে বিপাকে ফেলতে তাদের বিদেশী প্রভুদের কাছে নালিশ করে নানা রকম ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসছে, পোশাক শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ সমঅধিকার বিবেচনা করলে বাংলাদেশে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসার কোনোই সুযোগ নেই। যদি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসেও, সেক্ষেত্রে পোশাক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে না।

তবে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোয় কিছু কিছু কারখানায় সমস্যা দেখা দিতে পারে। পোশাকের বাজারগুলোতে কৃত্রিম সুতার পোশাকের চাহিদা বাড়ায় বাংলাদেশের জন্য এটিও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি দেশের পোশাক খাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতেও এ ধরনের অনেক চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আগামীতেও সবধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পোশাক শিল্প এগিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে ১৫ বছরের রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। রোডম্যাপে ভার্চুয়াল মার্কেট ও কৃত্রিম ফাইবারে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আগামীতেও পোশাক খাত অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে।

বুধবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ভোরের কাগজ ও দ্যা অ্যাপারেল নিউজের যৌথ উদ্যোগে ‘পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক সংকট : সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্তের সভাপতিত্বে দ্যা অ্যাপরেল নিউজের সম্পাদক ও প্রকাশক অমিত কে. বিশ্বাসের সঞ্চালনায় উক্ত বৈঠকে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিজিবিএ সাবেক সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন, আইটিইটি’র (বাংলাদেশ) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের অধ্যাপক ড. সুবোধ দেবনাথ, মাসকো গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর এটিএম মাহবুবুল আলম চৌধুরী, বিজিএমইএ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান (ট্রেড ফেয়ার) মো. কামাল উদ্দিন ও বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুকসানা আক্তার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে কি-নোট উপস্থাপন করেন এস্কয়ার নিট কম্পোজিট লিমিটেডের (বাংলাদেশ) চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার দেবাশীষ কুমার সাহা।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক শিল্পে ২০২৩ সাল ভালো যাবে না এটা সবারই জানা ছিল। বিশেষ করে করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো পৃথিবীকে এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়েছে। তবে ২০২২ সাল দেশের পোশাক খাতের জন্য অনেক ভালো কেটেছে। ২০২৩ সাল যে খারাপ সেটি বলবো না। কারণ পোশাক রপ্তানির বড় দেশগুলো সবাই খারাপ করেছে। বাংলাদেশ কোনো মতে ভালো অবস্থান কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে। গর্ব করার মতোও অনেক কিছু আছে। বিশ্বের ১০ গ্রিন পোশাক কারখানার ৯টিই বাংলাদেশের।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ২০৩০ সালে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এজন্য বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেকনোলজির ব্যবহারও বাড়ছে কারখানাগুলোতে। সবাই বর্তমানের সংকট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন- সে বিষয়ে আমি বলবো- এ সংকট সাময়িক। এটি দ্রুতই কেটে যাবে।

ফারুক হাসান বলেন, বিশ্বে কৃত্রিম সুতার পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু এটি আমাদের আমদানি করতে হয়। এই জায়গাটিতে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি রিসাইকেল নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাস সময়ের পরিসংখ্যান নিট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। অর্থাৎ অন্যদের চেয়ে আমরা ভালো করছি। ভবিষ্যতেও করবো। এজন্য ১৫ বছরের রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ভার্চুয়াল মার্কেট ও কৃত্রিম সুতায় জোর দেয়া হয়েছে।

ভোরের কাগজ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসকাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোয় দেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলে কানাকানি চলছে। কিন্তু অতীতে রানা প্লাজা তানজীন ফ্যাশনের ঘটনাগুলো মোকাবিলা করে দেশের পোশাক খাত এগিয়ে গেছে। বাস্তবতা হলো- বাংলাদেশের পোশাক খাত আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হয়ে গেছে। সামান্য কিছু হলেই ফলাও করে এটিকে সামনে আনা হচ্ছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের শ্রমিকদের নাম উল্লেখ করে বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্যদেশের বেলায় এরকমটা হতে দেখি না। পোশাক শিল্প আসলেই আমরা গ্রিন কারখানার কথা বলছি। অথচ এটি সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা জানি না।

তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে কেমিক্যাল ফ্রি বাংলাদেশের কাপড় বিক্রি হচ্ছে। নীলফামারীর একটি ইপিজেডে এগুলো তৈরি হচ্ছে। অথচ ব্রান্ডিং করা হচ্ছে না সেভাবে। এছাড়াও পোশাক শিল্পে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে টেকনোলজির ব্যবহার। অনেক দেশেই এখন ১০০ জন শ্রমিকের পরিবর্তে মাত্র একজন শ্রমিক প্রয়োজন হচ্ছে। এই বাস্তবতায় আগামী ১৫-২০ বছর পর দেশের পোশাক খাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন? এর বাইরে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের বয়স ১৮-২৬ বছর। তারা নিজেদের মানসিকভাবে কারখানার অংশ ভাবতে পারছে না। জুট মিলেতো ৮-১০ বছর বেতন হতো না, তাও কেউ অগ্নিসংযোগ করেনি। এখন কিছু হলেই নিজের কর্মস্থলে অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। এসব বাস্তবতায় ৪০-৪৫ বছরের পোশাক শিল্প কিভাবে আরো সমৃদ্ধির দিকে নেয়া যায় সেদিকে নজর দিতে হবে।পাশাপাশি মিডিয়ার সঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। কেউ যাতে কোনো ভুল তথ্য প্রচার করে আতঙ্ক ছড়াতে না পারে সেজন্য এই যোগাযোগ স্থাপন জরুরি।

বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যারা এনজিও এর নামে বিদেশী টাকা আনার কৌশল এটেছেন, তারাই তাদের বিদেশী প্রভুদের কাছে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে খারাপভাবে উপস্থাপন করছেন। এটি স্পষ্ট করে বলতে চাই- শ্রম অধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সুযোগ নাই। এরপরও যদি রাজনৈতিক কারণে কেউ নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেটি সরকার কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করবে। এক্ষেত্রে আমরা সরকারের পাশে থাকবো। এটা স্পষ্ট করা জরুরি- নিষেধাজ্ঞা দিলে পোশাক খাতে কোনো প্রভাব পড়বে না।

বিজিবিএ সাবেক সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতে কোনো ডাটাবেজ নেই। এই শিল্প এগিয়ে নিতে হলে ডাটাবেজ তৈরি করে কি ধরনের কারখানা কতটি হবে সেটি নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি একটি রিসার্চ ইনস্টিটিউট করে কিভাবে এই শিল্প এগিয়ে নিতে হবে, সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের গ্রেড বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইটিইটি’র (বাংলাদেশ) সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান বলেন, পোশাক শিল্পে সাপ্লাই চেন নিয়ে কাজ কম হয়। এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এরবাইরে এনবিআর, কাস্টমস, বন্ড, পরিবেশ অধিদপ্তর ও কল-কারখানা অধিদপ্তর এই খাতের বড় শত্রু। সরকারকে উদ্যোগ নিয়ে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, আমেরিকা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরেও বাজার ধরতে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি উপযুক্ত জনবল তৈরিতে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে জেনারেল সাবজেক্টও পড়ানো হয়। ফলে আসল উদ্দেশ্যে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর প্রভাব পোশাক খাতেও পড়ছে। বাইরের কর্মীরা এসে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের বিজনেস স্টাজি অনুষদের অধ্যাপক ড. সুবোধ দেবনাথ বলেন, পোশাক খাত এগিয়ে নিতে হলে ব্রান্ডিং করাটা খুব জরুরি। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান গ্রিন পোশাক কারখানা বাংলাদেশে রয়েছে এটি ব্রান্ডিংয়ের একটি অংশ হতে পারে। এছাড়াও ইইউ চাচ্ছে, পণ্যের প্রাইস ট্যাগ স্ক্যান করলে কোথায় তৈরি হয়েছে, কারখানার নামসহ বিস্তারিত তথ্য যুক্ত করতে। এটির জন্য উপযুক্ত টেকনোলজির ব্যবহার শুরু করতে হবে।

মাসকো গ্রুপের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর এটিএম মাহবুবুল আলম চৌধুরী, সারা বিশ্ব কার্বন নিঃস্বরণ ঠেকাতে জোর দিচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে পোশাক খাতের কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় আনার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এদিকে খেয়াল রেখে আগাতে হবে।

বিজিএমইএ স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান (ট্রেড ফেয়ার) মো. কামাল উদ্দিন, কৃত্রির সুতা আমাদের দেশে হয়না। এজন্য ভারত থেকে আমদানি করা হচ্ছে। কৃত্রিম সুতার আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে ভারতকে প্রয়োজনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করারও আহ্বানও জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সাধারণ সম্পাদক রুকসানা আক্তার বলেন, পোশাকের ক্রেতাদের জানানো উচিত, বাংলাদেশের মতো সস্তা শ্রম আর কোথাও নেই। তারা যেন মজুরি বাড়িয়ে দেয়।

কি-নোট উপস্থাপনায় এস্কয়ার নিট কম্পোজিট লিমিটেডের (বাংলাদেশ) চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার দেবাশীষ কুমার সাহা বলেন, বর্তমানে এশিয়াতে ১২৫ ট্রিলিয়ন ডলারের পোশাকের ব্যবসা হয়। ভবিষ্যতে এই বাজার কমে আফ্রিকাতে বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের আরো ভালো ভালো পোশাক কারখানা গড়ে তুলতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App