×

জাতীয়

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিজয় দিবস উদযাপন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪২ পিএম

সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিজয় দিবস উদযাপন

দিনব্যাপী বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকী উদযাপন করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যাক্তিবর্গরা। ছবি: ভোরের কাগজ

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত আর দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পরাধীনতার গ্লানি মুক্ত হয়ে গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জন করে বাঙালি জাতি। সেই থেকে স্বাধীনতা, সেই থেকে বাঙালির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের স্বাদ অর্জন করে বাঙালি জাতি। স্মৃতিসৌধে ফুলেল শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শনিবার (১৬ ডিসেম্বর) দিনব্যাপী বিজয়ের ৫২তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষেরা। লাল সবুজের এসব আয়োজনে ধ্বনিত হয়েছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে উৎখাত, মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিসহ সকল ‘অন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ রুখে দেয়ার আহবান।

ছায়ানটের লাল-সবুজের আয়োজন-

বিজয় দিবসে লাল সবুজের আবহে হাজারো কণ্ঠে জাতীয়সঙ্গীত গাইলেন ছায়ানটের শিল্পীরা। বরাবরের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় এই আসর।

ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ৩টা ৪৫ মিনিটে শুরু হয় অনুষ্ঠান। শেষ হয় ৪টা ৩১ মিনিটে। মাঝে থাকা ৪৬ মিনিটে ৭ম বারের মতো ছায়ানটের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে হাজারো বাঙালি আঁকলেন লাল সবুজের পতাকা। সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠেন 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।' এখানে দলে দলে শামিল হয়েছিলেন অগণিত নারী-পুরুষ। এসেছিলেন লাল শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে। মাঠে প্রবেশের বিন্যাসও করা হয়েছিল সেভাবেই। এক পাশে লাল, অন্য পাশে সবুজ। মঞ্চটির মেঝে ছিল বৃত্তাকার লাল রঙের। একটা সময় পুরো এলাকাটা দেখতে হয়ে ওঠে জাতীয় পতাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষাকেন্দ্রের মাঠে আয়োজনের সূচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, দীপ্ত টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান এবং ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।

এবারের অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নৃত্যসহ ৮টি সম্মেলক গান, একটি একক গান (জীবন আমার ধন্য যে হায়) এবং একটি পাঠ দিয়ে। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্য নাটকের নির্বাচিত অংশ উপস্থাপন করেন ত্রপা মজুমদার, একক গান পরিবেশন করেন আবুল কালাম আজাদ। দেশগানগুলো বেছে নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, গোবিন্দ হালদার, আবদুল লতিফ, মোহাম্মদ মোশাদ আলী, গাজী মাজহারুল আনোয়ার এবং গুরু সদয় দত্তের রচনা থেকে। নৃত্য পরিবেশিত হয় ও আমার দেশেন মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা, আজি রক্ত নিশি ভোরে, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, এই না বাংলাদেশের গান গাইতে রে দয়াল, লাখো লাখো শহীদের রক্তমাখা, জয় বাংলার জয়, আরে ভালো ভালো ভালোরে ভাই এবং কারার ঐ লৌহ কপাট গানের সম্মেলক গানের সঙ্গে।

ছায়ানটের শিল্পী-শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে এবারের আয়োজনে যুক্ত ছিল–থার্টিন হুসার্স ওপেন স্কাউট গ্রুপ, আজিমপুর গার্লস হাইস্কুল, আটি ভাওয়াল উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ, একাডেমিয়া, ঢাকা ইমপেরিয়াল কলেজ, নালন্দা বিদ্যালয় ও সানিডেল।

সকলে মিলে দেশের গান গাওয়া ও শোনা, আর কথা বলা ও শোনা এবং সেই সঙ্গে বাংলার নৃত্যশৈলীর রসাস্বাদনের আয়োজন শেষ হয় ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমপর্ণ ও বাঙালির পূর্ণাঙ্গ বিজয়ের ক্ষণকে স্মরণ করে ৪ টা ৩১ মিনিটে ঐতিহ্য অনুযায়ী সম্মিলিত কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে সমাপ্তি টানা হয় অনুষ্ঠানের।

শিল্পকলা একাডেমি-

সারাবিশ্বেই বাংলাদেশকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে বিজয় দিবস উদযাপন করেছে শিল্পকলা একাডেমি। বিজয় দিবসে প্রাক্কালে সকাল নয়টায় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শিল্পকলা একাডেমির দিনব্যাপী আয়োজন। এরপর একাডেমির আয়োজনে দর্শক মুখরিত বেলতলায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপস্থাপন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে এ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছিলো- স্বরচিত কবিতাপাঠ, আবৃত্তি, দেশের গান ও মনোজ্ঞ অ্যাক্রোবেটিক প্রদর্শনী।

এতে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। বিজয় উৎসবের এ আয়োজনে ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানান মহাপরিচালক। পরে দর্শকদের সাথে গলা মিলিয়ে ‘মানুষ মানুষের জন্য, মঙ্গল হোক এই শতকে মঙ্গল সবার’ সঙ্গীত পরিবেশন করেন একাডেমীর মহাপরিচালক।

এরপর ধারাবাহিকভাবে কবি মিনার মনসুর, সালাহউদ্দিন আহাম্মদ, সৈকত হাবিব, আদিত্য নজরুল, কবি আসাদুল্লাহ পাঠ করেন স্বরচিত কবিতা। শিল্পী মনোরঞ্জন ঘোষাল, রাজা বশীর, রাজিয়া মুন্নী, গোলাপী, সজীব, শিল্পী বিশ্বাস, জাকির হোসেন এবং হোমায়েরা বশির সংগীত পরিবেশন করেন। আবৃত্তি করেন অনন্যা লাবণী পুতুল, আহসান উল্লাহ তমাল, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল কাদের তালুকদার, শামিমা চৌধুরী এলিস এবং মাহমুদা আক্তার।

সবশেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অ্যাক্রোবেটিক দলের পরিবেশনায় প্রদর্শিত হয় বিশেষ অ্যাক্রোবেটিক। এছাড়া সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শিত হয় ভ্রাম্যমাণ অ্যাক্রোবেটিক।

সন্ধ্যার পর্বে একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ছিলো বিজয়ের আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে. এম খালিদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এবং সাংবাদিক মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।

আলোচনা পর্ব শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শুরুতেই পরিবেশিত হয় সমবেত নৃত্য ‘স্বাধীনতা শব্দটি কি করে আমাদের হলো’। এটি পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যদল। এরপর একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী রন্টি দাস। সমবেত সংগীত পরিবেশন করে সংগীত কলেজ ‘ইতিহাস জানো তুমি আমরা, আমরা পরাজিত হই নি’ এবং ‘কারার ওই লৌহ কপাট’। অনুষ্ঠানে কবি কণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন নির্মলেন্দু গুণ।

এরপর সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যদল কালারস অব হিল ‘হরেক রঙ্গের মানুষ’। অ্যাক্রোবেটিক শো পরিবেশন করে শিল্পকলা একাডেমির অ্যাক্রোবেটিক দল। একক সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী ইউসুফ আহমেদ খান ‘সূর্যোদয়ে তুমি’ এবং ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে’। এরপর সমবেত সংগীত পরিবেশন করে ঢাকা সাংস্কৃতিক দল।

এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ পরিবেশন করে সমবেত সংগীত ‘নোঙ্গর তোল তোল ও পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠেছে’। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ পরিবেশন করে সমবেত সঙ্গীত ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য, ও আমার দেশের মাটি’। প্রিয়াংকা গোপ পরিবেশন করেন একক সংগীত ‘সব কটা জানালা’ এবং ‘প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্যের আগে’। এছাড়াও একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন সুজিত মোস্তফা।

কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ করেন কবি ওয়াজেদ। একক সংগীত পরিবেশন করেন অনিমা মুক্তি গোমেজ ‘তোমরা কেউ জানো এবং বঙ্গবন্ধু মানেই’। ‘আগামীর বাংলাদেশ’ সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে ম্যাশ মাহাবুব কোরিওগ্রাফি টিম, ‘মারমা ময়ূর নৃত্য’ পরিবেশন করে কালারস অব হিল, ‘অন্তহীন’ শিরোনামে নৃত্য পরিবেশন করে কাথ্যাকিয়া এবং ‘দেশাচার্য’ সমবেত নৃত্য পরিবেশন করে দীক্ষা নৃত্যদল।

আজ ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসব ২০২৩ এর শেষ দিনের অনুষ্ঠানমালা।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট-

‘আমার দেশ, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশ’ এই স্লোগানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শেষ হলো চারদিনের বিজয় উৎসব। সকাল ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে বিজয় শোভাযাত্রা-২০২৩ এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমাপনী আসর।

এরপর বিকেল ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় উৎসবের শেষ দিনের শেষ আয়োজন।

বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের সাংস্কৃতিক সংগঠন কারিশমার দলীয় নৃত্য ও দলীয় সঙ্গীত পরিবেশনা দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। এতে অংশ নেয় শিশু সংগঠন- ঋদ্ধস্বর, স্বরতরঙ্গ, ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী, সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী, স্বভূমি লেখক শিল্পী কেন্দ্র; ঢাকা স্বরকল্পন, উদীচী কেন্দ্রীয় আবৃত্তি বিভাগ, ত্রিলোক বাচিক পাঠশালা, স্বর ব্যঞ্জন; নৃত্যাক্ষ;। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন অনিমা মুক্তি গোমেজ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বিজন চন্দ্র মিস্ত্রি, অলক দাশগুপ্ত ও ফয়জুল বারী ইমু। একক আবৃত্তি পরিবেশন করেন মাহফুজা আক্তার মিরা, বেলায়েত হোসেন ও তামান্না সারোয়ার নীপা; পথনাটক পরিবেশন করে উৎস নাট্যদল ও বাঙলা নাট্যদল।

জাতীয় জাদুঘর-

মহান বিজয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা বিভাগ জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে ‘বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়’ শীর্ষক একটি বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। বিকাল পাঁচটায় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠিত হয়।

প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

প্রদর্শনীটি আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শনিবার থেকে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে সন্ধ্যা ৭ টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। বৃহস্পতিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন প্রদর্শনী বন্ধ থাকবে। প্রদর্শনীটি বিনা টিকিটে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App