×

জাতীয়

অসময়ের বৃষ্টিতে রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের আশঙ্কা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:১৫ পিএম

অসময়ের বৃষ্টিতে রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতি, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের আশঙ্কা

ছবি: সংগৃহীত

অগ্রহায়ণের শেষ সময়ে সাধারণত বৃষ্টি খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) সারাদিন রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশের আকাশ ছিল ধূসর মেঘে ঢাকা। দিনভর ঝরেছে ঝিরঝিরি বৃষ্টি। যেন বর্ষাকাল। অসময়ের এ বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে পাকা আমন ধান ও রবি ফসলসহ শীতকালীন সবজির। বিশেষ করে আলু ও পেয়াজ চাষীদের মাথায় হাত পড়েছে। টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে রোপণকৃত বীজ ও ফসলে পচন ধরেছে। পানি দ্রুত না সরলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কা কৃষকদের।

এর আগেও গত ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন চাষিরা। ফলে বারবার দুর্যোগে দিশেহারা হয়ে পড়া কৃষকের চোখে শুধুই পানি। এ অবস্থায় উৎপাদন পিছিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাজারে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে গত বুধবার (৬ ডিসেম্বর) রাত থেকে বৃহস্পতিবার (৭ ডিসেম্বর) রাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টিপাতে মুন্সিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, নরসিংদী ও বরিশালসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় আবাদকৃত বীজ আলু, পেয়াজ, সরিষা ক্ষেত ও বিভিন্ন রকম সবজির জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আলু এবং পেয়াজের। এতে রোপণ করা এসব বীজ আলু ও পেয়াজ পচে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে যাচ্ছেন দেশের আলু ও পেয়াজ উৎপাদনকারী চাষিরা।

শুক্রবারও (৮ ডিসেম্বর) আকাশের অবস্থা ছিল গোমট। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে শনিবার (৯ ডিসেম্বর) পর্যন্ত আকাশ মেঘলা থাকবে। দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় কৃষকদের মাথায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ লম্বা হচ্ছে।

দেশের সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদনকারী জেলা মুন্সিগঞ্জ। এই জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে এ পর্যন্ত ৬ উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। তবে কৃষকরা বলছেন, আলু আবাদের পরিমাণ এর থেকেও বেশি। একদিনের বৃষ্টিতে রোপণ করা আলুর ৭০-৮০ ভাগই পচে নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কোথাও কোথাও পানিতে তলিয়ে গেছে আলুর জমি, কোথাও আবার জমিতে জমাট বেঁধেছে পানি। আলু উৎপাদনের জন্য চাষ দিয়ে প্রস্তুত করা জমি পুরোটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আলুর জমিতে নালা করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছেন কৃষকরা। বৃষ্টি দীর্ঘমেয়াদী হলে নষ্ট হবে সব বীজ। মৌসুমের শুরুতেই প্রকৃতির এমন বৈরিতায় দিশেহারা কৃষকরা।

এ বিষয়ে জেলা আলুচাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের প্রতি হেক্টরে বর্গা নিয়ে চাষ করতে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ২ হাজার ৯৫০ টাকা। রোপণকৃত বীজ আলুর ৭০-৮০ শতাংশ নষ্ট হবে। বাকি আলুতেও আশানুরূপ ফলন হবে না। ক্ষতির পরিমাণ কয়েক’শ কোটি টাকা ছাড়াবে। এখন বীজ যদি পচে নষ্ট হয়, তাহলে বীজ সংকটে পড়তে হবে চাষিদের। তাছাড়া আবারো আলু রোপণ করতে অনেকটা বিলম্ব হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমাদের সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হোক। অন্তত বীজ-সার সুলভ-মূল্যে পেলে আমাদের অনেক উপকার হবে।

মুন্সিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা এবিএম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, এখন যদি বৃষ্টি কমে যায় তাহলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হবে না। তবে দীর্ঘমেয়াদী হলে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, চাষিরা অনেক টাকা দিয়ে আবাদ করেছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে জমির আলু কতখানি নষ্ট হয়েছে আর কতটুকু ভালো রয়েছে তা স্পষ্ট হবে। পরবর্তীতে সেই রিপোর্ট নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হবে। তখন কোনো প্রণোদনা দেয়া হলে কৃষকদের মাঝে বণ্টন করা হবে।

এদিকে, দেশের সবচেয়ে বেশি পেয়াজ উৎপাদনকারী জেলা ফরিদপুর। এ জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজের উৎপাদন হয় সালথা ও নগরকান্দা উপজেলায়। হঠাৎ বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে মুড়িকাটা-হালি পেঁয়াজের ক্ষেত ও বীজতলা। এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে কৃষকের। আর কয়েকদিন পরই খেত থেকে ওঠার অপেক্ষায় ছিল মুড়িকাটা পেঁয়াজ। জমি তলিয়ে যাওয়ায় সেই পেঁয়াজও পচে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে ওই এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকার জমিতে মুড়িকাটা পেঁয়াজের বয়স হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ দিন। এ পেঁয়াজ পরিপক্ব হতে সময় লাগে ৯০ দিন। পানি দ্রুত না নেমে গেলে এ পেঁয়াজ পচে যাবে।

অন্যদিকে, নতুন করে লাগানো হচ্ছে হালি পেঁয়াজের চারা। পাশাপাশি রয়েছে হালি পেঁয়াজের বীজ তলাও। বৃষ্টির পানিতে এসব পেঁয়াজ তলিয়ে যাওয়ায় সব চারা মরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ এলাকার কৃষকরা জানান, জমিতে চাষ দিয়ে, সার-কীটনাশক পানি ও কৃষাণ খরচ দিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এখন পানিতে ডুবে যাওয়ায় এসব খেতে আবার নতুন করে চারা লাগাতে হালিসহ বিঘাপ্রতি ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা খরচ হবে।

বিষয়টি নিয়ে কৃষকরা বলেন, আমরা ধার-দেনা করে পেঁয়াজ লাগাই। আবার অনেক সময় হুটহাট করে দাম বাড়লেও আমরা সেই দাম পাই না। তার ওপর প্রকৃতির এমন অভিশাপ আমাদের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা।

নগরকান্দা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তিলক কুমার ঘোষ বলেন, এ উপজেলায় চলতি বছর প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হবে। এর মধ্যে মুড়িকাটা পেঁয়াজ ৩৫০ হেক্টর এবং হালি পেঁয়াজের ৪০ হেক্টর জমিতে হঠাৎ বৃষ্টিতে পানি জমে গেছে। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে কিছু পেঁয়াজের ক্ষতি হবে। তবে বড় কথা হলো পেঁয়াজের মৌসুম পিছিয়ে যাবে। এ বৃষ্টির কারণে এটা খুব সংকটজনক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে চলতি বছর ফরিদপুর জেলায় ২৫ হাজার হেক্টর হালি পেঁয়াজ ও ৫ হাজার হেক্টর মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

এদিকে, আলুর পাশাপাশি সরিষা উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলা। এছাড়া সারাদেশে সবজি উৎপাদনের দিক থেকেও তালিকার এক নম্বরে নরসিংদী। ফলে এই দুই জেলায়ও বৃষ্টিতে ধানসহ রবিশস্যের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় আছেন কৃষকরা। জেলা দুটিতে এখনো কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ধান কাটা বাকি ও যে ধান কেটে রাখা আছে তা ঘরে তোলাও বাকি রয়ছে। তার আগেই নিম্নচাপের বৃষ্টির পানিতে ভাসছে সোনালি ফসল পাকা ধান। এ দুই জেলার নিচু জমি গুলোতে পানি জমে থাকায় সদ্য লাগানো আলুর বীজ পচে যেতে পারে। তাছাড়া অধিকাংশ সরিষার ক্ষেতও নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নরসিংদী ও কিশোরগঞ্জ জেলার আলু ও সরিষা চাষিরা জানান, অসময়ের বৃষ্টির কারণে আমাদের আলু ও সরিষার ক্ষেত নষ্ট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এত বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো বা পুনরায় চাষ করা মুশকিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App