×

জাতীয়

দুর্যোগ-দুর্ঘটনা মোকাবেলায় প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু টানেল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২০ এএম

দুর্যোগ-দুর্ঘটনা মোকাবেলায় প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু টানেল

দুর্যোগ ও দুর্ঘটনাকে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ ব্যবস্থাপনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। টানেলের ভেতরে কোনো কারণে অগ্নিকাণ্ড বা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সেগুলো কীভাবে দ্রুত নিরসন করা হবে। এ ছাড়া, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাস অথবা অতিবৃষ্টিতে পানি ঢুকে পড়লে টানেল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে- এসব বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে টানেল কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক কোনো স্থানের অগ্নিদুর্ঘটনা আর টানেলের মধ্যকার দুর্ঘটনা এক নয়। কারণ, টানেল বদ্ধ জায়গা। পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় টানেল দিয়ে ধোঁয়া বের হতে পারবে না। সেখানে দ্রুত আগুন নেভানোর গতানুগতিক ব্যবস্থা কার্যকর নয়। এ ছাড়া, টানেলের কোথাও সড়ক দুর্ঘটনা বা গাড়ি বিকল হয়ে গেলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে টানেলের ভেতরে অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

টানেল নির্মাণ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, টানেলের ভেতরে প্রতিটি টিউবের ওপরে একটি বিশেষ হিট সেন্সর রয়েছে। কোথাও অগ্নিকাণ্ড হলে অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে হিট সেন্সর দুর্ঘটনার স্থান শনাক্ত করবে। সেই সঙ্গে টানেলে থাকা অটোমেটিক সিসিটিভি ক্যামেরা সেদিকে ঘুরে যাবে। এরপর মনিটরিং স্থান থেকে দ্রুত টানেলের ব্যবস্থাপনায় থাকা চীনা কর্তৃপক্ষের রেসপন্স টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে। তারা সেখানে গিয়ে আগুন নির্বাপণ করবেন।

এ ছাড়াও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে টানেলের ভেতরে ৫০ মিটার পরপর অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে। একই দূরত্বে ফায়ার হোস রয়েছে। যেখান থেকে পানি ছিটিয়ে দ্রুত আগুন নেভানো যাবে। যদি আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হবে। এ কারণে টানেলের দুই প্রান্তে দুটি ফায়ার স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে।

অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনার সময় গাড়ি চলবে কি না

টানেলের কোনো স্থানে অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে প্রবেশের শুরুতে স্ক্রিনে নির্দেশনা আসবে। গাড়ি প্রবেশের সময় দেখা যাবে ভেতরের কোন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ড হলে সঙ্গে সঙ্গে দুটি লেনই বন্ধ করে দেয়া হবে। আর ওজন স্কেলের জায়গা থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাইরে চলে আসতে পারবে। এরপর নির্বাপণ করে ধীরে ধীরে প্রথমে একটি লেন এবং পরে দুটি লেনই পুরোপুরি স্বাভাবিক করা হবে। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দুই লেনের সড়কে ঘটনাস্থলের লেন বাদে অন্য লেনে গাড়ি চলাচল করবে। আবার যদি দুর্ঘটনা বড় হয় সেক্ষেত্রে দুটি লেনই বন্ধ করে দেয়া হবে।

অগ্নিকাণ্ডের সময় লোকজন কোথায় যাবে

হঠাৎ ভয়াবহ কোনো অগ্নিকাণ্ড ঘটলে টানেলের লোকজনের এদিক-সেদিক যাওয়ার সুযোগ নেই। সেজন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। টানেলে প্রায় ৬৫০ মিটার পরপর ক্রস প্যাসেজ রয়েছে। অর্থাৎ একটি টিউব থেকে আরেকটি টিউবে যাওয়ার পথ রাখা হয়েছে। লোকজন যদি ক্রস প্যাসেজের কাছাকাছি থাকেন তাহলে দ্রুত অন্য টিউবে গিয়ে হেঁটে টানেলের যেকোনো প্রান্তে উঠে যেতে পারবেন।

প্রকৌশলীরা জানান, টিউবের মাঝ বরাবর গাড়ি চলাচলের জন্য সড়ক বানানো হয়েছে। সড়কের ওপরের অংশ খালি এবং নিচের অংশে রয়েছে দুটি বিশেষ চ্যানেল। একটি দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যাবল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরেকটি চ্যানেল পুরোপুরি ফাঁকা রয়েছে। এ চ্যানেল দিয়ে লোকজন চলাচল করতে পারবেন। টানেলের ভেতরের সড়ক থেকে এই চলাচলের চ্যানেলে নামতে ৮০ মিটার পরপর ব্যবস্থা রাখা রয়েছে। কোথাও অগ্নিকাণ্ড বা দুর্ঘটনা ঘটলে কাছে যদি ক্রস প্যাসেজ না থাকে তাহলে লোকজন এই চ্যানেলে নেমে যাবেন। এরপর চ্যানেলটি দিয়ে টানেলের যেকোনো প্রান্তে নিরাপদে উঠে যেতে পারবেন।

১৫০ মিটার পরপর ভেন্টিলেশন ফ্যান

অগ্নিকাণ্ডের সময় প্রচুর ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, যেগুলো বিষাক্ত। এসব ধোঁয়া দ্রুত বের করতে টানেলের ভেতরে ১৫০ মিটার পরপর বসানো হয়েছে বড় বড় ভেন্টিলেশন ফ্যান। অগ্নিকাণ্ড ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে বাতাস চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এসব ফ্যান কাজ করবে।

অতিবৃষ্টি, বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসেও সুরক্ষিত থাকবে টানেল

সমতলের সঙ্গে সঙ্গে অবতল আকৃতির এই টানেল। এ কারণে স্থলভাগে পানি থাকলে সোজা তা টানেলে প্রবেশ করতে পারে। এ ছাড়া, ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা (সি লেভেল) বেড়ে ৬ দশমিক ৮ মিটার হলে টানেলে পানি প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে। এ পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য নেওয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। টানেলের দুই টিউবের চার মুখে বসানো হয়েছে ফ্লাড গেট। চীন থেকে এসব ফ্লাড গেট আনা হয়েছে। এমনটি হলে ফ্লাড গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। এয়ার টাইড এসব ফ্লাড গেট বন্ধ করে দিলে প্রায় ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের পানিও সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। ফলে টানেল থাকবে সুরক্ষিত।

এ ছাড়া, বৃষ্টি বা নানা কারণে প্রবেশমুখ দিয়ে টানেলে পানি প্রবেশ করতে পারে। এ পানি দ্রুত নিষ্কাশনেরও ব্যবস্থা রয়েছে। টানেলে প্রতিটি টিউবের মাঝে গভীরতম স্থানে পাম্প স্টেশন বসানো হয়েছে। সেখানে গিয়ে পানি জমবে। এরপর টিউবের নিচের অংশে থাকা চ্যানেল দিয়ে এসব পানি আনোয়ারা অংশে ফেলে দেয়া হবে।

সমীক্ষা

জানা গেছে, নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পকারখানা।

টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App