×

জাতীয়

পরিকল্পিত হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়েছিলেন ঢাবি শিক্ষক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৫৬ এএম

পরিকল্পিত হত্যাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে চালিয়েছিলেন ঢাবি শিক্ষক

কোহিনূর বেগমকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মামুন রশীদ চৌধুরী ও পালিত কন্যা ফাইজা নূর রশীদ। ছবি: ভোরের কাগজ গ্রাফিক্স টিম

রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার ফার্মাসিস্ট কোহিনূর বেগমকে নির্মমভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়েছিলেন তাঁর স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশীদ চৌধুরী। হত্যায় সহযোগী ছিল তাঁর পালিত কন্যা ফাইজা নূর রশীদ। চলতি বছরের ১০ এপ্রিল কোহিনূর বেগমের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছিল। তবে ময়নাতদন্তের (নম্বর ৪৫০/২০২৩) প্রতিবেদন হাতে পেয়ে পুলিশ জানতে পারে কোহিনূর বেগম আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। পিবিআই জানায়, কোহিনূর বেগমের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর স্বামী মামুন রশীদ ধানমন্ডি থানায় অপমৃত্যুর মামলা করেন। গত ১৫ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে পেয়ে ধানমন্ডি থানার পুলিশ জানতে পারে কোহিনূরকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। এরপর কোহিনূরের ভাই মিগ-২১ পাইলট ও এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিটি বাংলাদেশের (এএআইজি-বিডি) প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় ৩০২/৩৪ ধারায় একটি হত্যা মামলা করেন (মামলা নম্বর ১৪)। মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে কোহিনূরের স্বামী মামুন রশীদ চৌধুরী ও কন্যা ফাইজা নূর রশীদের নাম উল্লেখ করা হয়। দুইজনকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। এ মামলা প্রসঙ্গে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মামলাটি তদন্ত পাওয়ার পর লাশের সুরতহাল রিপোর্টে হত্যাকাণ্ডের মত আলামত পাওয়া গেছে। কিন্তু ময়না তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত তদন্ত করা হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এটি আত্মহত্যা নয়, হত্যাকাণ্ড। পরে কোহিনুরের স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে হত্যার দায় স্বীকার করেন। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাদের পালিত মেয়েও ছিলেন। কোহিনূর বেগম হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলাটি এখন তদন্ত করছে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট পিবিআই সূত্র জানায়, মামুন রশীদ তাঁদের জানিয়েছেন, চলতি বছরের ১০ এপ্রিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসা থেকে কোহিনূরকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে রওনা হন। পথেই কোহিনূরের মৃত্যু হয়। সে সময় তিনি পুলিশকে বলেছিলেন, তিনি স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ধানমন্ডির বাসায় থাকেন। তবে ঘটনার সময় সকালবেলা তিনি বাজারে ছিলেন আর দুই সন্তানই কর্মস্থলে ছিলেন। বাজার থেকে বাসায় ফিরে তিনি দরজায় তালা দেখতে পান। এরপর তিনি চাবি দিয়ে দরজা খুলে স্ত্রীকে খাবারঘরে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ঝুলতে দেখেন। এরপর তিনি সেখান থেকে কোহিনূরকে নামিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মামুন রশীদ পুলিশের কাছে দাবি করেছিলেন, বিষণ্ণতায় ভুগে তাঁর স্ত্রী কোহিনূরে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণের অর্গানাইজড ক্রাইমের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সারওয়ার আলম বলেন, হত্যা মামলা হওয়ার পর মামুন রশীদ ও তাঁদের পালিত মেয়েকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডি থানা পুলিশ। গত ৩ আগস্ট কোহিনূর হত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান তাঁরা। ইতোমধ্যে পিবিআই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া কোহিনূরের স্বামী ও মেয়েকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও তদন্ত শেষে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। কোহিনূরের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, বিয়ের কয়েক বছর হয়ে গেলেও কোহিনূর মা হতে পারছিলেন না। তখন তিনি ফাইজাকে দত্তক নেন। এর মধ্যেই কোহিনূর নিজে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। কোহিনূর বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করায় দুই সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিতে পারছিলেন না। এতে একপর্যায়ে সন্তানেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এই অবস্থা দেখে কোহিনূর চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসারে মনোযোগ দেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। ফাইজার আচরণ এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে সামান্য কথাতেই তিনি মায়ের গায়ে হাত তুলতেন। আর মেয়েকে বাবা মামুন রশীদ সমর্থন যোগাতেন। কোহিনূর ভাই মিগ-২১ পাইলট ও এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিটি বাংলাদেশের (এএআইজি-বিডি) প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ অভিযোগ করে ভোরের কাগজকে বলেন, ময়না তদন্তে প্রমাণিত হয় যে ওটা আত্মহত্যা নয়, ছিল খুন এবং কোহিনুর বেগমকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। কোহিনূরের থুতনির নিচে সমান্তরাল আনুমানিক পাঁচ সেন্টিমিটার দূরত্বে অর্ধ সেন্টিমিটার গর্ত বিশিষ্ট দুইটি জখম ও ঘাড়ে আনুমানিক দশ সেন্টিমিটার কাটা বা চিরা জখমের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। কোহিনূরকে ব্যাটারি চালিত পোর্টেবল স্টান গান অথবা টেসার জাতীয় হাই ভোল্টেজ প্রয়োগকারী ইলেকট্রিক কোনো ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে মারাত্মক জখম ও অচেতন করে অতঃপর শ্বাসরুদ্ধ করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন এম রহমতুল্লাহ আরও বলেন, মৃত্যু পরবর্তী ডক্টর মামুন তাঁর বর্ণনায় উল্লেখ করেন তিনি একাই চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে ঝুলন্ত লাশ ফ্যান থেকে নামিয়েছেন। তবে তা করার দৈহিক শক্তি তার আছে কিনা তা পুলিশ টেস্ট করার জন্য ডক্টর মামুনকে চেয়ার এবং টুলের উপর দাঁড়িয়ে একটা ভারী কিছু নামাতে বলেছিলেন কিন্তু তিনি তা করতে পারেননি। এটাতে পুলিশ প্রমাণ করেছেন যে মামুন রশীদের দৈহিক ক্ষমতা নেই ঝুলন্ত লাশ নামানোর। আর তাতে মামুন রশীদের দেয়া স্টেটমেন্টের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, কোহিনুর বেগম ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, তদানীন্তন যশোর নিবাসী অবসরপ্রাপ্ত সাব-ডেপুটি কালেক্টর ও যশোর জেলা জজ কোর্টের সম্মানসূচক ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রহমতুল্লাহর কন্যা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি অনুষদ থেকে স্নাতকোত্তর করেছিলেন। নিহত কোহিনূর বেগম স্বনামধন্য একাধিক ওষুধ কোম্পানিতে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি প্রথমে টিবিএল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে প্রোডাক্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন, পরে এসিআই ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার ও তারও পরবর্তীতে রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে মার্কেটিং ম্যানেজারের পদে প্রায় দশ বছর কর্মরত ছিলেন। ফার্মাসিস্ট কোহিনূর বেগম রেনাটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে ‘ম্যাক্সপ্রো’ এবং ‘ফ্লনটিন’ ওষুধগুলোর গুণগত মান এবং কার্যকারিতার সুফল ব্যাখ্যা করে, অত্যন্ত সুলভ মূল্যে সারা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মার্কেটিং করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সবশেষে তিনি নিজেই একটি স্বাধীন ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি তার কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে গাজীপুরে সাড়ে তিন বিঘা একটি জমিও ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তার স্বামী ডক্টর কে বি এম মামুন রশীদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এবং মেয়ে ফাইজা নূর রশীদ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বাংলাদেশ-আইসিডিডিআরবি ঢাকার কর্মকর্তা ছিলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App