×

জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর থেকে কী আশা করছে বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪০ এএম

প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর থেকে কী আশা করছে বাংলাদেশ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে জি-২০ সামিটে অংশ নিতে শুক্রবার দিল্লি যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে এটি তার শেষ ভারত সফর।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এমন এক সময়ে এই সফরটি করছেন, যখন আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকার কিছুটা আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। খবর বিবিসির

ফলে জি-২০ জোটের সদস্য না হলেও পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলোর এ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ কোন রাজনৈতিক অর্জন ঘরে তুলতে পারবে কী-না তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষন রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকদিন ধরেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর দৃশ্যমান চাপ প্রয়োগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই ধারণা, নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিপরীতে ভারতকে সক্রিয় করতে সক্ষম হবেন শেখ হাসিনা।

আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতা বলেছেন, জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশের নেতারা আসবেন, যেখানে ‘বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ভুল বুঝাবুঝি থাকলে সেটিরও অবসান হবে-এমন প্রত্যাশাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না’।

দলটির সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্ল্যাহ বিবিসিকে বলেছেন, “আজকে যার সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি, কে জানে কাল হয়তো তার অবসানও হতে পারে।”

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলছেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুধু বাংলাদেশকেই সামিটে আমন্ত্রণ করা হয়েছে যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এই সুযোগে বাংলাদেশ সাইড লাইনে প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিজেদের বিষয়ে কথা বলার সুযোগ তৈরি করে নিতে পারবে।

“অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে বিশ্ব নেতারা কী ভাবছেন, সেটি যেমন জানার সুযোগ আসবে, তেমনি রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলার সুযোগ হবে আনুষ্ঠানিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায়। আমার মতে বাংলাদেশের জন্য এগুলো গুরুত্বপূর্ণ,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে তিনটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে - যার মধ্যে একটি করা হচ্ছে রুপি ও টাকায় বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার পারস্পারিক লেনদেন সহজ করার জন্য।

পাশাপাশি কিছু জরুরি নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে ভারত যেন বাংলাদেশের জন্য একটি কোটা সংরক্ষণ করে, এমন প্রস্তাবও  মোদীর সাথে আলোচনায় তুলে ধরবেন শেখ হাসিনা।

এটি হলে ভারত কোন পণ্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশে সেটি আমদানি বন্ধ হবে না।

জি-২০ সামিট ও নির্বাচন: পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর মধ্যেই নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিসহ কিছু সিদ্ধান্তে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীন মহলে।

কিন্তু শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারতের বর্তমান সরকারকে এসব বিষয়ে এখনো সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। যদিও আগের দুটি নির্বাচন, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা ছিলো অনেকটা প্রত্যাশিত।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের পেছনে ভারত সরকারের সহায়তাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এখন নির্বাচনের আর মাত্র তিন মাস বাকী।

এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের ইস্যুটি দিল্লি সফরে আলোচনায় উঠে আসবে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, জি-২০ সামিট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশ ‘আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা’র কথাই তুলে ধরবে।

“বাংলাদেশ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। ইন্দো প্যাসিফিকে কোনো প্রক্সি ওয়ার আমরা দেখতে চাই না। পাশাপাশি ভারতের সাথে তিস্তা ও রোহিঙ্গা ইস্যুসহ যতগুলো দ্বিপাক্ষিক ইস্যু আছে সবই আমরা তুলে ধরবো,” বলেন তিনি।

নির্বাচন নিয়ে অন্যদের চাপকে 'অপ্রাসঙ্গিক' উল্লেখ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “গত ১৪ বছরে আমরা ভালো কাজ করেছি। জনগণ পছন্দ করলে ভোট দিবে। আমরা চাই ফ্রি, ফেয়ার ও স্বচ্ছ নির্বাচন। কোন ধরণের কারচুপি চাই না। আমরা সবচেয়ে সুন্দর নির্বাচন চাই। সেখানে কেউ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলে স্বাগত জানাবো। কিন্তু কেউ যদি মাতব্বরির ভূমিকা চান, সেটা হবে না। শেখ হাসিনা কাউকে ভয় পায় না।”

“অন্যরা পছন্দ করলেন কী করলেন না, সেটা বিষয় নয়। কে কোন চাপ দিলো এটি অপ্রাসঙ্গিক। এ দেশের মানুষই এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে”।

প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এ সফরে নির্বাচন ইস্যুটি, বিশেষ করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালী দেশগুলোর নেয়া পদক্ষেপগুলোও আলোচনায় আসবে বাংলাদেশ-ভারত শীর্ষ বৈঠকে।

বিশেষ করে, চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের উদ্বেগ, এবং নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কিছু পদক্ষেপ -এসব ইস্যু দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় আসতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহা. রুহুল আমীন বলছেন, বাংলাদেশের জন্যও এ সামিটে অংশ নেয়ার সুযোগটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আলোচনা কিংবা দরকষাকষির মাধ্যমে কারও সাথে দূরত্ব তৈরি থাকলে সেটি কমিয়ে আনার সুযোগ পাবে বাংলাদেশ।

তবে প্রধানমন্ত্রী দিল্লির উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই ঢাকায় এসেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। আবার জি-২০ সামিটে যোগ দিতে ভারতে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

অর্থাৎ খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে শেখ হাসিনার দেখা হচ্ছে, যারা কোনো না কোনো ভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে উৎসাহী।

এর আগে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার সমালোচনা করে রাশিয়া একে 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের চেষ্টা' হিসেবে আখ্যায়িত করে সমালোচনা করেছিলো। প্রায় একই ধরণের বক্তব্য এসেছিলো চীনের তরফ থেকেও ।

তবে, চীন এবং রাশিয়া বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার সমালোচনা করলেও শেখ হাসিনার মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারতের নরেন্দ্র মোদীর সরকারের দিক থেকে নির্দিষ্ট কোন মন্তব্য বা তৎপরতা দেখা যায়নি।

এখন শেখ হাসিনার এবারের সফরের পর ভারতের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসে কি-না সেদিকেও দৃষ্টি থাকবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের।

আলোচ্যসূচিতে যা থাকতে পারে নরেন্দ্র মোদীর বিশেষ আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা জি-২০ সামিটে যোগ দিতে যাচ্ছেন-এটিই একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে, বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের অন্যতম সিনিয়র নেতা কাজী জাফর উল্লাহ।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেছেন “দুই নেতার মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে এবং এ বৈঠকটি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তিস্তার পানি ছাড়াও বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করছি।”

বিশেষ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশ চায় ভারত থেকে যে কোন পরিস্থিতিতে জরুরি পণ্য আমদানির সুযোগ তৈরি করা। অনেক সময় পেঁয়াজ, চিনি বা চালের মতো জরুরি পণ্য ভারত হুট করে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশে এসব পণ্যের সংকট দেখা দেয়।

এজন্য বাংলাদেশ আগেই একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে যাতে করে এসব পণ্য রপ্তানি ভারত বন্ধ করলেও বাংলাদেশের জন্য যেন কোটা রাখা হয় যাতে করে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই বাংলাদেশ তা আমদানি করতে পারে।

এর আগে করোনা মহামারির সময়েও আগে অর্থ পরিশোধ করে বাংলাদেশ ভ্যাকসিন পায়নি ভারত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কারণে।

“সেজন্য আমরা চাইছি এ ধরণের পণ্য বিষয়ে দু সরকারের মধ্যেই চুক্তি হোক, যাতে বাংলাদেশের জন্য একটি কোটা সংরক্ষণ করা যায়,” কাজী জাফর উল্লাহ বলছিলেন।

যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন তার সংবাদ সম্মেলনে চুক্তির বিষয়ে কোনো ধারণা দেননি।

মোমেন বলেছেন, সফরে তিনটি সমঝোতা স্বাক্ষরিত হবে- এগুলো হলো কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং দুই পক্ষের মধ্যে রুপি ও টাকায় পারস্পারিক লেনদেন সহজ করা সম্পর্কিত সমঝোতা।

জি-২০ সামিটে যা হচ্ছে ভারতের সভাপতিত্বে এবারের জি-২০ সামিটে বাংলাদেশসহ মোট নয়টি দেশকে অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

অন্য দেশগুলো হলো মিশর, মরিশাস, নেদারল্যান্ডস, নাইজেরিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর, স্পেন এবং আরব আমিরাত।

এর মধ্যে জি-২০ সংক্রান্ত সব সভাতেই বাংলাদেশ অংশ নিয়েছে।

কর্মসূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী আজ শুক্রবার দিল্লি যাবেন এবং বিকেলেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। এ বৈঠকের আগেই অবশ্য তিনটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবার কথা রয়েছে।

শনিবার জি-২০ সামিটের আওতায় দুটি অধিবেশনে বক্তব্য রাখবেন শেখ হাসিনা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, করোনা মহামারি পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, ইউরোপে যুদ্ধের কারণে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ও সারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যাহত হবার মতো চ্যালেঞ্জ গুলো তুলে ধরবেন প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া দু অধিবেশনের মধ্যবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী সৌদি আরব, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেয়াটা শেখ হাসিনা সরকারের ১৪ বছরের সাফল্যেরই স্বীকৃতি এবং এটি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করছেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App