×

জাতীয়

বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ নেতৃত্বের সংকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৫ এএম

বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ নেতৃত্বের সংকট
  • সমন্বয়হীনতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, হতাশা-সংশয়
বিএনপির মূল কাণ্ডারি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতলের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। শারীরিক অবস্থা, আইনি জটিলতাসহ পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার রাজনীতিতে ফেরা অনিশ্চিত। খালেদা জিয়ার অবর্তমানে একক কর্তৃত্ব ধরে রেখে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন লন্ডনে পালিয়ে থাকা তারেক রহমান। বিকল্প এমন কেউ সামনে নেই যিনি দলের হাল ধরতে পারেন। এই সুযোগে বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব -কোন্দল, সন্দেহ-সংশয় ও সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিনকে দিন। নেতৃত্ব সংকটের এমন চরম মুহূর্তে কী হতে পারে বিএনপির ভবিষ্যৎ? এমন প্রশ্নের মুখে প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরে এসে এক কঠিন সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপি। রাজপথে ‘এক দফা দাবিতে গণঅভ্যুত্থ্যানের’ স্বপ্ন দেখা এবং তা বাস্তাবে রূপ দেয়া; দলটির আগামীর রাজনীতির জন্য এ যেন রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। তবে লক্ষ্য পূরণে চূড়ান্ত আন্দোলনে রাজপথে সফলতার বিকল্প ভাবছেন না বিএনপির সিনিয়র নেতারা। ‘সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে সমাজতন্ত্র’- এই চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি গঠন করেছিলেন প্রয়াত জিয়াউর রহমান। ৪৫ বছর পরও বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বিএনপি আজো দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল। ২০০৬ সালে ক্ষমতা হারানোর পর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দলটি নানা সংকটে ধুঁকছে। নেতৃত্ব সংকটের চাপা আক্ষেপ বিরাজ করছে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে। প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরে এসে বিএনপি সামনে চ্যালেঞ্জ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোরের কাগজকে বলেন, এই মূহর্তে চ্যালেঞ্জ একটাই- এক দফা দাবি আদায়। দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নিরপেক্ষ ভোটের পরিবেশ তৈরি ও দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করা। তিনি বলেন, গত ৪৫ বছরে বিএনপি কঠিন দুঃসময় অতিক্রম করছে। তবুও জিয়াউর রহমানের নীতি এবং আদর্শ থেকে এক পা-ও নড়েনি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ লড়াই করে যাচ্ছে। বিএনপির সামনে মূল চ্যালেঞ্জ : বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ- নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে রাজপথে সর্বশক্তি নিয়ে সরব থাকা। তবে এর আগে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য জনমত তৈরি করা। সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ হলো- দলের অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্ব-কোন্দল, সন্দেহ-সংশয় ও সমন্বয়হীনতা পাশ কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা। তৃণমূল নেতারা বলছেন- শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষে দলের যে শক্ত অবস্থান; শীর্ষ নেতারা শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, দলটির একাংশ নির্বাচন বয়কটের পক্ষে নয়। সংলাপের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে তারা ভোটে যাওয়ার পক্ষে। এসব নেতার দাবি- সরকার যদি অতীতের মতো আরেকটি নির্বাচন করে উতরে যায়, তাহলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ভবিষ্যৎ কী হবে; এর উত্তর নেই দলটির কাছে। এছাড়াও বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলোর মধ্যে এখনো অটুট ঐক্য গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকে সামনে রেখে ছোট দলগুলো নানা হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। গুঞ্জন রয়েছে- যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতে নানা উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। অনেক দলকে চাপের পাশাপাশি নানা সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দিয়ে জোট থেকে বের করে নেয়ার চেষ্টা চালাবে। কোনো দল যুগপৎ আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গেলে সেটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। এমন অবস্থায় আন্দোলনে সফলতা আদায়ে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর মধ্যে ঐক্য ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ। জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, শুধু বিএনপি নয়, জাতির সামনে এখন একমাত্র চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এ অবৈধ সরকারের পতন। তাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার নিশ্চিতে এর কোনো বিকল্প আমরা ভাবছি না। দলটির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপির সামনে চ্যালেঞ্জ যাই থাকুক, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছি। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট নিশ্চিত করা গেলে নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক চ্যালেঞ্জই সহজ হয়ে যাবে। বিশ্লেষকদের পরামর্শ : অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগোনোর পরামর্শ দিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। দলের শীর্ষ নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণের পাশাপাশি নেতাকর্মীদের ক্ষমতায়ন করে অধিকতর গণতান্ত্রিক আবহ আনতে হবে দলটির ভেতরে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিশোধন করতে হবে। অভ্যন্তরীণ নীতি বলতে দলীয় কর্মসূচি প্রণয়ন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রা কী হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এর পাশাপাশি বিএনপির নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো দাঁড় করাতে হবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, সময় খুবই কম। এক দফা দাবিতে বিএনপিকে রাজপথে সরব থাকতে হবে। শক্ত হাতে দলের বিরুদ্ধে যে কোনো অপপ্রচার মোকাবিলা করতে হবে নেতাদের। দল ভাঙার ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। কারণ, এবারের পেক্ষাপট ভিন্ন। ক্ষমতাসীন মহল চেষ্টা করবে প্রলোভন দেখিয়ে বিএনপি থেকে কাউকে নিয়ে দলে ভেড়ানোর। পাশাপাশি দলটি আওয়াম লীগের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার যে অঙ্গীকার করেছে; এই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে। তিনি বলেন, গত ৪৫ বছরে বিএনপির সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে- বামসহ ব্যাপকসংখ্যক রাজনৈতিক দলকে তারা নিজেদের দাবির পক্ষে এক করতে পেরেছে। বাধা পেরিয়ে বিএনপির অর্জন : নেতাদের দাবি- নানা প্রতিবন্ধকতায়ও অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপি এখন বেশি শক্তিশালী। দলের প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ১ লাখের বেশি মামলা ঝুলছে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে মামলার খড়গ ঝুলছে। তারপরও বিএনপি পোক্তভাবেই টিকে আছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এখন ক্ষমতাসীনদের দাপট, মামলা, হামলা, পুলিশি হয়রানির ভয় উপেক্ষা করে এবং নানা ঝুঁকি নিয়ে বুক চিতিয়ে মাঠে নামছেন। অতীতের সব সমালোচনা পাশ কাটিয়ে গত ১ বছর বিএনপি দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে রয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তারা দেখাতে সক্ষম হয়েছে, তারা অহিংস পথে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। ফলে সাধারণ জনগণও তাদের রাজপথের কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হতে শুরু করেছে। নেতারা বলছেন, এই ৪৫ বছরে বহুবার বিএনপিকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়নি। বিএনপিতে ভাঙন ধরাতে পারেনি। সেটাই এখন বিএনপির বড় শক্তি। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান ভোরের কাগজকে বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একটা কথা বলেছিলেন- ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’। জনগণকে নিয়ে তার দেশ গড়ার যে চিন্তা ধারা; সেই পথেই বিএনপি এগোচ্ছে। দল হিসেবে বিএনপির অর্জন কি- সেটা বুঝতে হলে ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বশেষ বছরের যে কার্যক্রম সেটা বিশ্লেষণ করলেই সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপির জন্ম হয়েছিল এই সময়ে এসে গর্ব করে বলা যায়, সবার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি সফল। আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য : নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচনে নয়; এমন অটল অবস্থানে বিএনপি। এ লক্ষ্যে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনের পরিণতি দেখতে চায় দলটি। এমন চিন্তা থেকে যুগপৎ আন্দোলনকে অক্টোবরের মধ্যেই চূড়ান্ত ধাপে নিতে কৌশলের অংশ হিসেবে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে এমন বার্তা দেয়া হয়েছে তৃণমূলে। দলটির নেতারা মনে করছেন, সরকার এবার বিনা চ্যালেঞ্জে একতরফা নির্বাচনের দিকে যাতে এগোতে না পারে, সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে নির্বাচন ঠেকানো কঠিন হবে। সে জন্য তফসিল হওয়ার আগেই এক দফা দাবিতে ফয়সালা চাইছেন তারা। তবে মাঠের আন্দোলনে সরকারকে কতটা টলানো যাবে, এমন ঘোর সন্দেহ রয়েছে তৃণমূলে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরে একটা পর্যায় পর্যন্ত গণমিছিল, পদযাত্রা ও সমাবেশের মতো যুগপৎ কর্মসূচির পরিকল্পনা করছে বিএনপি। সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে অবস্থান ও সবশেষ অবরোধ কর্মসূচির কথা ভাবা হচ্ছে। তবে টানা এ ধরনের কঠোর কর্মসূচি দেয়ার সময়টাকে বিএনপি নেতারা একটা ‘মোক্ষম ক্ষণ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, কর্মসূচি অব্যাহত রেখে তারা এই বিশেষ সময়ের জন্য অপেক্ষা করবেন। আন্দোলনের মাঠেই টানা কর্মসূচি দেয়ার ‘মোক্ষম ক্ষণ’ চলে আসবে। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক টানা কর্মসূচি দিয়ে অক্টোবরে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা তাদের থাকবে। এ লক্ষ্যে দলটি প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠা বাষির্কীর কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ভোর ৬টায় দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে বিএনপি। দুপুর ১২টায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও বিশেষ দোয়া করবেন। বিকাল ৩টায় নয়াপল্টন থেকে শোভাযাত্রা বের করবে। পাশাপাশি ২ সেপ্টেম্বর শনিবার বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়াও দলীয় পোস্টার ও ক্রোড়পত্র প্রকাশসহ সারাদেশে সব ইউনিট বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App