×

জাতীয়

ব্রিকস থেকে কী পেল বাংলাদেশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১০:০৯ এএম

ব্রিকস থেকে কী পেল বাংলাদেশ

কৌশলগত কারণে বাংলাদেশই ব্রিকসের সদস্যপদ নিতে আগ্রহ দেখায়নি। তবে যদি প্রয়োজন মনে করে অবশ্যই ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই জোটের সদস্য হতে পারবে। সব মিলিয়ে ব্রিকসে অংশগ্রহণ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো লাভ হবে না, বরং ওই সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ একের পর এক চ্যালেঞ্জের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পথ নির্ধারণ করে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, সদস্যপদ পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ‘পাস-ফেইল’ বিচার করা ঠিক হবে না। আন্তজার্তিক পরিমণ্ডলে ব্রিকসকে ব্যবহার করে পরিকল্পনামাফিক ফায়দা তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। যার ফলে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে। পাশাপাশি আফ্রিকা মহাদেশে বাংলাদেশ নতুন বাজার খুলতে পেরেছে। এছাড়া এবার ‘ব্রিকসের সদস্য হবে না’- এটা জেনেই বাংলাদেশ সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। এরফলে বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির কিছু নেই। যারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্রিকস থেকে কিছুই পায়নি, তারা না জেনে ভুল তথ্য প্রচার করছেন।

প্রসঙ্গত, এর আগে বাংলাদেশ এই জোটের অধীনে থাকা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয়েছে। গত ২৩-২৫ আগস্ট পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস সম্মেলন হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমন্ত্রিত হয়ে সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সম্মেলন শেষে আজ রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার কথা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্রিকস সম্মেলন থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে সম্পর্ক ঝালাই করে নিয়েছে। এই সম্পর্কোন্নয়নের জেরে ব্যবসাবাণিজ্যে মুনাফা পাবে বাংলাদেশ। এই সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা ও কথা হয়েছে। অন্য নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আফ্রিকা মহাদেশে থাকা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে দূত সম্মেলন করেছেন।

এসব বৈঠকের ফাঁকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা এক্সে (টুইট) লিখেছেন, আমি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস এজেন্ডাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের সঙ্গে দেখা করেছি। আমরা উভয় দেশের জনগণের নীতির মাধ্যমে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ব্রাজিল ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেছি। শিগগিরই আমি ব্রাজিল এবং এর ফুটবলের প্রতি অনুরাগী এই দেশটিতে যেতে চাই এবং আমি প্রধানমন্ত্রীকে আমাদের দেশে সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছি।

জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন কৌশলের সমন্বয় জোরদার করতে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তব সহযোগিতা গভীর করতে, দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক। এর ফলে দুদেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা আসবে। এতে দুদেশের জনগণ উপকৃত হবে।

এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব আনাম খান ভোরের কাগজকে বলেন, নির্বাচনের আগে এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের অংশ নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ বড় বড় দেশগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বিশেষ করে চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠককে খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, সেখানে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানসহ ব্যবসা-বিনিয়োগ নিয়ে কথা হয়েছে। অথচ অনেকেই বলেছেন, ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশ ফেইল করেছে। যারা এসব কথা বলেছেন, তারা আংশিক ভুল বলেছেন। কারণ বাংলাদেশ সদস্যপদ পাবে না জেনেই ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সদস্য না হওয়ায় এটিকে ফেইল বলা হয় কীভাবে- পাল্টা প্রশ্ন তার। তিনি বলেন, এই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের অনেকগুলো অর্জন আছে। যার কিছুটা রাজনৈতিক এবং কিছুটা অর্থনৈতিক।

এদিকে গতকাল শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী সিনেট ভবনে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ আয়োজিত ‘গণহত্যা ও বিচার : রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের অবস্থান’ শীর্ষক এক আলোচনা শেষে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ব্রিকস জোটে যোগ দেয়ার জন্য ৪০টি দেশ আবেদন করেছে, সেখান থেকে ছয়টি দেশকে নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও নেয়া হবে। সুতরাং এখনই অন্তর্ভুক্ত না হওয়া অনেক দেশের জন্যই প্রযোজ্য। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে কিন্তু ব্রিকসে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সমগ্র বিশ্বে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই। সবার সঙ্গে সম্পর্ক, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা চলছি।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ব্রিকসে বাংলাদেশ সদস্য হতে না পারলেও নতুন ছয়টি দেশ যুক্ত হয়েছে। তবুও এসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে আমদানি-রপ্তানি নাটকীয়ভাবে বাড়বে। বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে থাকা এই জোটের দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সংযোগ জোরদার হলে সদস্য হিসেবে বাংলাদেশকে যুক্ত করার তাগিদ আপনাআপনিই চলে আসবে। তখন বাংলাদেশ হতে পারে ব্রিকস প্লাসের মূল কেন্দ্র। কারণ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে তাদের সমুদ্রবন্দর সংযুক্ত করা হলে পুরো অর্থনৈতিক চিত্র পাল্টে যেতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশ একাধিক ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে অনেক দেশকে একত্রিত করতে পারে।

এছাড়া, বাংলাদেশ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ার এবং প্রায়ই নিরাপত্তা হুমকির বিষয়ে সোচ্চার থাকে। বাংলাদেশ কীভাবে হিংসাত্মক চরমপন্থা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা ভাগ করে ব্রিকসকে সহায়তা করতে পারে এবং বৈশ্বিক পরিবেশগত নীতির বিষয়ে সোচ্চার থাকতে পারে তা ব্রিকস অবশ্যই জেনে নেবে। এর ফলে ব্রিকস ও বাংলাদেশ উভয়েরই উপকারে আসবে। তবুও বাংলাদেশকে অবশ্যই তার কৌশলগত আচরণ অনুযায়ী ব্রিকসের প্রতি সাড়া দিতে হবে। তখনই প্রশ্ন আসবে, ব্রিকস কী সরবরাহ করতে পারে এবং বাংলাদেশ কী দাবি করতে পারে।

এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ বলেন, ব্রিকসের সদস্য হতে না পারায় তেমন ক্ষতিকর কিছু হওয়ার কোনো আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে না। কারণ ব্রিকস এখন পর্যন্ত যুগান্তকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি কিংবা সে ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। ব্রিকসের উল্লেখ করার মতো একমাত্র সাফল্য হলো নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এ ব্যাংকের সদস্য হয়েছে।

গত প্রায় ১০ বছরে এ ব্যাংকটি বিভিন্ন দেশে যে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়েছে, তার চেয়েও অনেক গুণ সহযোগিতা দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফ। নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বা আইএমএফের সঙ্গে সে অর্থে তুলনীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারেনি। তিনি বলেন, ব্রিকসের বর্তমান বাস্তবতা যদি আমরা দেখি, এখানে রাশিয়া, চীন ও ভারতই মূল শক্তি হবে। আমরা এর সদস্য হলে ব্রিকসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব কিংবা তারা সব সময় আমাদের কথা শুনবে- এমনটিও নয়। তবে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হলে আমাদের একটা অ্যাভিনিউ খুলে যায়, যেখানে আমরা সমস্যার কথা বলতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কিছুতে সমর্থন দিতে বা পেতে পারি। এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে তারা ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং সে দেশগুলোর পূর্ণ সদস্যভুক্তি আগামী জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশকে আরো কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দেয়ায় সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এখন ব্রিকস ব্যাংক বা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্য হিসেবে ব্যাংকঋণ, অন্যান্য আর্থিক সুযোগ এবং উন্নয়নমূলক নীতি তৈরিতে আরো বেশি প্রবেশাধিকার পেয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যেই নয়, কৌশলগত রাজনৈতিক কারণেও সেখানে অংশ নিতে পারে। কারণ ঢাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও অনেক মন্তব্য আছে বলে মনে করে উন্নত দেশগুলো। এ রকম পরিস্থিতিতে ব্রিকসে যোগ দিলে বাংলাদেশ রাজনৈতিক সমর্থন পাবে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য এবং ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। পাশাপাশি বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনীব্যবস্থার বিষয়ে চীন ও রাশিয়া নমনীয়। নয়াদিল্লি ও ঢাকার সরকার এবং প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ব্রিকসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন বাংলাদেশকে যে কোনো ধরনের পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা করতে পারে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App