×

জাতীয়

তফসিলের আগে নাশকতার ছক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২১ এএম

তফসিলের আগে নাশকতার ছক
তফসিলের আগে নাশকতার ছক

ফাইল ছবি

বিএনপি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে ঢাকায় জমা করা হচ্ছে অবৈধ অত্যাধুনিক অস্ত্র

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা চলছে। পরস্পরবিরোধী প্রধান দুটি দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। এসব কর্মসূচি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেকটা নির্ঘুম রাত কাটছে। এ অবস্থায় ভোটের মাঠ উত্তপ্ত করতে মরিয়া একাধিক চক্র। তারা অবৈধ অস্ত্রের মজুত ও নাশকতার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে খবর রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি অস্ত্রসহ ৬ ছাত্রদল নেতা গ্রেপ্তারের পর অপরাধ জগতের নতুন চিত্র বেড়িয়ে এসেছে। এদের মধ্যে দুইজন অস্ত্র মামলায় রিমান্ডে থাকা অবস্থায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।

যাতে নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুতের তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। গত দুই মাসে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ছাত্রদলের ক্যাডারদের হাতে এসেছে ১১টি অবৈধ অস্ত্র। তন্মধ্যে রয়েছে পিস্তল ও রিভলবার। এই গ্রুপকে ভোটের তফসিল ঘোষণার আগে ২০টি অস্ত্র আনতে টার্গেট দেয়া হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় একটি পর্যায় থেকে। ১১টি সংগ্রহের পরই তারা ধরা পড়েছে। তাদের দেয়া তথ্যের সূত্রে নির্বাচন ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে কি পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র দেশে ঢুকেছে এবং সেগুলো কারা কীভাবে এনেছে সে ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রিমান্ডে থাকা ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিনুল ইসলাম ওরফে জিসান অস্ত্র মজুতের একটি চক্রের মূল ভূমিকায় ছিলেন। সাড়ে ৫ মাস আগে থেকে টেকনাফের এক শীর্ষ মাদক কারবারির মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে জিসানের খোঁজ মেলে দেড় মাস আগে। ওই মাদক কারবারি অন্য একজনকে ফোন করে জানায়, ‘একটা রাইখা আসছি, আরেকটা নিয়ে আসছি’। তখন সন্দেহ ঢোকে তদন্তকারী টিমের। কারণ ইয়াবার চালান ঢাকায় এসে ফেরত গিয়েছে এমনটি হওয়ার কথা নয়। পরে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে ডিবির টিম জানতে পারে, ওই কারবারী মাদকের পাশাপাশি অন্যতম শীর্ষ অস্ত্র কারবারী। তখন গোয়েন্দা তথ্যে খোঁজ মেলে জিসানের। এরপরই অভিযান পরিচালনা করে লালবাগের একটি বাসা থেকে জিসানসহ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বাসায় অস্ত্রগুলো লোড করে রাখা হয়েছিল। চিলেকোঠার ওই বাসাটিতে ছাত্রদলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা আসা যাওয়া করলেও অস্ত্রের বিষয়টি জানতেন না সবাই।

তবে একটি অস্ত্র রিমান্ডে থাকা সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আরিফ বিল্লাহর জিম্মায় ছিল। অন্য ৪ জন অস্ত্রের কারবারে জড়িত না থাকায় এবং এ সম্পর্কে না জানায় তাদের বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জিসান জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা নভেম্বরে। এর আগেই বিএনপির একটি শীর্ষ পর্যায়ের রেফারেন্সে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় এক নেতার মাধ্যমে নির্দেশনা আসে কমপক্ষে ২০টি অস্ত্র মজুত রাখার। এরপর তিনি পাবনার এক ছাত্রদল নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই ছাত্রদল নেতার সঙ্গে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির একটি কর্মসূচি চলার সময় পরিচয় হয়েছিল জিসানের। পাশাপাশি টেকনাফের ওই অস্ত্র কারবারির সঙ্গে যোগাযোগ করেন জিসান।

চলতি বছরের ২১ জুন অস্ত্রের প্রথম চালান হাতে পান জিসান। এরপর পর্যায়ক্রমে পাবনার ওই ছাত্রদল নেতা ও টেকনাফের ওই অস্ত্র কারবারির মাধ্যমে একে একে ১১টি অস্ত্র ঢাকায় আসে। এর মধ্যে মহানগর ছাত্রদলের এক নেতার কাছে রয়েছে ২টি অস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের এক ছাত্রদল নেতার কাছে রয়েছে একটি অস্ত্র। বাকি ৫টি অস্ত্র ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও যুবদলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে জিসানকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল, অস্ত্র আনতে পারলে আরো বড় নেতা বানানোর সুপারিশ করা হবে।

ডিবি বলছে, জিসানকে জিজ্ঞাসাবাদে ও তার ফোনে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১১টি অস্ত্র ঢাকায় ঢুকেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে তাকে গ্রেপ্তারের সময় ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্রগুলোর মধ্যে ৩টি অস্ত্র মহানগর ও ঢাবির একটি হলের দুই নেতার কাছে রয়েছে বলে তথ্য মিলেছে। এই দুইজন ও পাবনার এক ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে টেকনাফের ওই অস্ত্র কারবারি অন্য কারো কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য নেয়া হচ্ছে। ডিবি আরো জানায়, যে ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো পাকিস্তান, ভারত ও মিয়ানমারে তৈরি। ওগুলোর মধ্যে দুটির দাম ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা। একটির দাম ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছে। অস্ত্রগুলোর সঙ্গে উদ্ধার হওয়া ৩৬ রাউন্ড গুলির জন্য আলাদা কোনো টাকা দিতে হয়নি বলে রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন জিসান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম ভোরের কাগজকে বলেন, জিসান ও আরিফ রিমান্ডে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে। তদন্তের স্বার্থে এখনই কিছু বলতে চাচ্ছি না। তবে, যাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। জিসানকে গ্রেপ্তারের পর লালবাগ থানায় দায়ের হওয়া অস্ত্র মামলার তদারকি কর্মকর্তা ডিবি গুলশান বিভাগের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) বার্নাড এরিক বিশ্বাস ভোরের কাগজকে বলেন, অবৈধ অস্ত্র সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে জিসান। পাবনা ও টেকনাফ থেকে অস্ত্র এনে মজুত করার ক্ষেত্রে সে মূল ভূমিকা পালন করেছে।

এছাড়াও আরো বেশ কয়েকজনের কাছে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাদের উপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। পাশাপাশি দুই দিনের রিমান্ড শেষ হওয়ায় আজ (বুধবার) তাদের আদালতে পাঠানো হবে বলেও জানান এসি বার্নাড এরিক বিশ্বাস।

উল্লেখ্য, গত শনিবার লালবাগ কেল্লার প্রধান ফটকের বিপরীত পাশের গলির একটি বাসা থেকে জিসান ও আরিফসহ ৬ ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার অন্য ৪ জন হলেন- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক মো. আরিফ বিল্লা, ছাত্রদলের ঢাবি শাখার সহসভাপতি মো. হাসানুর রহমান ওরফে হাসান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সহসাংগঠনিক সম্পাদক মো. শাহাদত হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর এবং ঢাবি শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল্লাহ আর রিয়াদ।

অস্ত্র মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়েছে, জিসান ও আরিফ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ জানায়, বিএনপির হাইকমান্ড ও ছাত্রদলের হাইকমান্ডের নির্দেশে ছাত্রদলের ঢাবি শাখাসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় রাজপথে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া প্রদর্শনের মাধ্যমে জনমনে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা করছিল। তারা আরো জানায়, যদি সরকার নির্দলীয় নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া তফসিল ঘোষণা করে তাহলে সারা বাংলাদেশ থেকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা ঢাকায় একত্রিত হয়ে বিভিন্ন প্রকার অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নাশকতা ও জনমনে ত্রাস সৃষ্টির করে সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে বাধ্য করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App