×

জাতীয়

৯৫ শতাংশ ডায়বেটিস রোগীই চিকিৎসক হতে পারেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩৮ এএম

৯৫ শতাংশ ডায়বেটিস রোগীই চিকিৎসক হতে পারেন

ডা. শক্তি রঞ্জন পাল

ডা. শক্তি রঞ্জন পাল। ব্যাংকক হাসপাতালে একমাত্র বাংলাদেশি চিকিৎসক। তিনি একজন ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। জাতিসংঘে কাজের সুবাদে নোয়াখালীর এই কৃতী সন্তানের রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের অভিজ্ঞতা।

সম্প্রতি ভোরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, তার অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনার কথা। তার মতে, রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও ইনস্টিটিউশন আন্তরিক হলে রোগী বা তার স্বজনকে ৯৫ শতাংশ ডাক্তার করে দেয়া সম্ভব। কারণ চিকিৎসার পাশাপাশি এক্ষেত্রে রোগীদের আরো দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো ডায়েট অন্যটি ব্যায়াম। এই দুই ক্ষেত্রে রোগী বা তার স্বজনদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ চিকিৎসক দেখবেন। ডা. শক্তি রঞ্জন পালের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার সেবিকা দেবনাথ।

ভোরের কাগজ : অসংক্রামক রোগের বোঝা বেড়েই চলছে। এর মধ্যে ডায়বেটিস অন্যতম। বাংলাদেশে এ রোগের পরিস্থিতি কেমন?

শক্তি পাল : ডায়বেটিস বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যখাতের ওপর বড় বোঝা। বাংলাদেশেও প্রচুর রোগী আছে। এটি আগেও ছিল। দিন দিন ডায়বেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ার মূল কারণ হচ্ছে-লাইফস্টাইল। বংশগত কারণও আছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম; তখন খাবারের এত বৈচিত্র্য ছিল না। অনেকে পেট ভরে খেতেও পেত না। এখন মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। খাবারে বৈচিত্র্য এসেছে। খাদ্যাভাসও বদলে গেছে। মানুষ এখন ফাস্টফুড বেশি খাচ্ছে। যা মানুষের মেটাবলিক সিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলছে। ধীরে ধীরে সমস্যাটা প্রকট আকার ধারণ করছে।

ভোরের কাগজ : দেশে ডায়বেটিক রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন?

শক্তি পাল : বাংলাদেশে ডায়বেটিসের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। অনেক উন্নত ওষুধও বাজারে আছে। ডায়বেটিস রোগীদের চিকিৎসায় অনেক হাসপাতাল আছে। বারডেম হাসপাতাল আছে। দেশজুড়ে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা রয়েছে। অন্যান্য হাসপাতালেও এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে। ব্যাংকক হাসপাতালে গড়ে ১৫ জন ডায়বেটিস রোগী পাই আমরা, যারা বাংলাদেশি। দেশে অধ্যাপক পর্যায়ের চিকিৎসক দেখালেও তাতে তারা সন্তুষ্ট নন। দেখা যায়, অনেকেরই ‘সুগার লেবেল’ কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অন্যান্য অসুবিধা যেমন- কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত, চোখ, ফুসফুস বা হার্টে সমস্যা হচ্ছে।

ভোরের কাগজ : আপনি বলেছেন দেশে ডায়বেটিস রোগের চিকিৎসা অনেক উন্নত। তাহলে এই রোগের জন্য কেন বিদেশ যাচ্ছে?

শক্তি পাল : চিকিৎসক ডায়বেটিসের চিকিৎসা করছেন ঠিকই কিন্তু রোগীকে চিকিৎসার মূল তথ্য জানাচ্ছেন না। ব্যাংককে আমার কাছে বাংলাদেশ থেকে যেসব রোগী যান তারা এমনটাই বলছেন। তাদের অভিযোগ-চিকিৎসক তাদের কথা মন দিয়ে শুনেন না। ডায়বেটিস চিকিৎসা আরো সহজ করে আনতে হবে। আমি মনে করি, এ রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসক, ইনস্টিটিউশন আন্তরিক হলে রোগী বা তার স্বজনকে ৯৫ শতাংশ ডাক্তার করে দেয়া সম্ভব। কারণ চিকিৎসার পাশাপাশি এক্ষেত্রে রোগীদের আরো দুটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো ডায়েট অন্যটি ব্যায়াম। এই দুই ক্ষেত্রে রোগী বা তার স্বজনদের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ চিকিৎসক দেখবেন। কারণ কখন কোন ওষুধ দেবে, ওষুধের কারণে কোনো পার্শ^প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলো চিকিৎসক দেখবেন। রোগীকে এই তথ্যগুলো দিলে হাসপাতালে বা চেম্বারে ডায়বেটিস রোগীর চাপ কমবে। আর ডায়বেটিস থেকে জটিলতাগুলোও কমবে।

ভোরের কাগজ : একটি ধারণা প্রচলিত আছে, একবার ইন্সুলিন নিলে রোগীকে সারা জীবন তা চালিয়ে যেতে হয়। এই ধারণা কতটা সত্য?

শক্তি পাল : ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে ইন্সুলিন অবশ্যই একটি সমাধান। তবে একবার ব্যবহার করলে তা সারাজীবন নিতে হবে এটি ঠিক নয়। রোগীর অবস্থা বুঝে ইন্সুলিনের বদলে ওরাল মেডিসিনও দেয়া যায়। টাইপ-১ ডায়বেটিসের ক্ষেত্রে শরীরে ইন্সুলিন উৎপন্ন হয় না। সেক্ষেত্রে ইন্সুলিন দিতে হয়। এটি শিশুদের ক্ষেত্রে হয়। আর প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে যেটি হয় তা হচ্ছে শরীরে ইন্সুলিন আছে কিন্তু তা পুরোপুরি কাজ করছে না। একে ইন্সুলিন রেজিস্ট্রেন্স বলা হয়। এটি টাইপ-২ ডায়বেটিস। এই দুই ধরনের রোগীকেই ইন্সুলিন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে ৪ বারও ইন্সুলিন নিতে হয়। সুঁইয়ের খোঁচায় শরীরে দাগ হয়ে যায়। রোগী মনে করেন তিনি অসুস্থ এবং ইন্সুলিন নিয়েই তাকে বাঁচতে হবে। এতে রোগীর মানসিক চাপ হয়। তবে এই ইন্সুলিন নির্ভরতা কমানো যায়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ইন্সুলিন ৩ গুণ বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। আমি ইন্সুলিনের বিরুদ্ধে নই। তবে এটি যদি বুঝে দেয়া হয় তাহলে এর পরিমাণ কমে আসবে।

ভোরের কাগজ : অনিয়ন্ত্রিত ডায়বেটিসের কারণে অনেক সময় অঙ্গহানির ঘটনা ঘটে। এ থেকে উত্তরণের উপায় আছে কী?

শক্তি পাল : ডায়বেটিস হলো অনেকটা শরীরে ঘুণে ধরার মতো। ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন অংশকে যেমন- কিডনি, হার্ট, চোখ, নার্ভসহ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। অনেক সময় শরীরে ঘা হয়। পচন ধরায় সেই অংশ কেটে ফেলতে হয়। চিকিৎসক ভালো হলে এবং রোগী সহযোগিতা করলে এমনটা হওয়ার কথা না।

ভোরের কাগজ : সহজে ডায়বেটিস নির্ণয়ের কোনো পদ্ধতি আছে কি?

শক্তি পাল : চিকিৎসক একজন রোগীকে প্রথমে খাওয়ার আগে একবার এবং ৭৫ গ্রাম গøুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর পুনরায় ডায়বাটিস পরীক্ষা করতে বলেন। দ্বিতয়য়বারের পরীক্ষাটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন নেই। সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে এ পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। কারণ, খালি পেটে সুগারের পরিমাপ এবং ৩ মাসের সুগারের গড় (হিমোগেøাবিন-এ ওয়ানসি) পরীক্ষা রিপোর্ট দেখেই রোগীর অবস্থা বোঝা যায়। ২য়বারের পরীক্ষাটি টাইপ-১ ডায়বেটিসে আক্রান্ত, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়ে। তবে যারা হাসপাতালে ভর্তি, অস্ত্রপচার হবে কিংবা সুগার লেবেল বাড়তি থাকলে ইন্সুলিন দিয়ে তা সঠিক মাত্রায় আনতে হবে সেক্ষেত্রে এই পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে।

ভোরের কাগজ : এই পরীক্ষা যদি অপ্রয়োজনীয়ই হয় তাহলে কেন করা হচ্ছে?

শক্তি পাল : আমেরিকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে ২য়বারের পরীক্ষাটি রুটিন চেক-আপে করা হয় না। আমি ২০ বছর ধরে ব্যাংকক হাসপাতালে আছি। সেখানে এই পরীক্ষাটি ডায়বেটিসে আক্রান্ত শিশুদের করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মেডিকেল প্র্যাক্টিসে এটি দীর্ঘ সময় ধরে চলছে। ডায়বেটিস নির্ণয়ে এই অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বন্ধে একটি ক্যাম্পেইন হওয়া দরকার। এই অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা বন্ধ হলে হাসপাতালগুলোতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ডায়বেটিস রোগীর চাপ কমবে। এর জন্য যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে সেটিও বাঁচবে। আর ২ ঘণ্টা অপেক্ষার জন্য রোগীরা যে মানসিক চাপে ভোগেন তাও থাকবে না। এই পরিবর্তনটা জরুরি। এতে প্রতিষ্ঠান ও রোগী উভয়েই উপকৃত হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App